মোটামুটি পূর্ণবিকশিত মস্তিষ্কের একটি বাঙালি ছেলে বা মেয়েকে যদি প্রথম দেখায় প্রশ্ন করেন যে জীবনে সে কী হ’তে চায়, দেখবেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর আসবে, “ডাক্তার, প্রযুক্তিবিদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক ইত্যাদি”। তাদের অভিভাবকদেরও জিজ্ঞাসা ক’রলে শুনবেন, “হ্যাঁ ঐজন্যই তো বিজ্ঞান পড়াচ্ছি”। এঁদের কথাবার্তা শুনলেই সেই বিখ্যাত ইতালীয় শিল্পীর কথা মনে প’ড়ে যায়, যিনি ব’লেছিলেন পাথরের মূর্তি ব’লে তিনি কিছু তৈরী করেননা, মূর্তির গা থেকে পাথরের অপ্রয়োজনীয় অংশগুলিকে কেটে বাদ দেন মাত্র। পৃথিবীকে দূরে ঠেলে সন্তানকে ইঁদুরদৌড়ে বাধ্য করা এহেন অভিভাবকদের পক্ষে আসলে ঐ কাটছাঁটই বটে। তাঁরা আদপে একটি ডাক্তার বা প্রযুক্তিবিদকেই জন্ম দিয়েছিলেন, যার শরীর থেকে ‘সহজাত মনুষ্যত্বের অংশগুলি’ এভাবে বাদ দিচ্ছেন তাঁরা। যদি পাথর নরম হয়, অর্থাৎ সন্তান ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়’ ভালো হয় এবং নিজের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে সহমত হয় তাহ’লে তাঁদের আপন সন্তানের চরিত্রগঠন সার্থক আর নয়তো ব্যর্থ। তাছাড়া স্থির বিশ্বাসও বর্তমান যে গতানুগতিক পথে চ’লতে থাকলে কাঙ্ক্ষিত জীবন নিশ্চিত। যারা ভালোবেসে স্বেচ্ছায় বিষয় শিখে কিছু ক’রতে চায় তাদের কথা এখানে আমি রাখছিনা। অপরদিকে ভারতবর্ষের অবাঙালি অংশে যারা নবীন প্রজন্মের প্রতিভূ (অবাঙালি মানেই কেবল হিন্দী বলয় নয়) তাদেরকে একবার ঐ সমান প্রশ্ন ক’রে দেখুন, গলা সপ্তমে তুলে ব’লবে, “সরকারী নৌকরি করেঙ্গে”। কিন্তু সারা ভারতবর্ষের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ সরাসরি সেই ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়, অতএব কাঙ্ক্ষিত অভীষ্টে যদি পৌঁছোনো না হয় তবে? তখন তাদের অভিভাবকসহ সমস্ত পরিবার একবাক্যে ব’লবে, “আরে তো কেয়া হো গেয়া? আপনা খেতিবাড়ি করেঙ্গে, দুকান সামহালেঙ্গে”। ভারতবর্ষের ন্যায় কৃষিপ্রধান দেশে এই জীবনদর্শন নিয়েই এঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম সুখে জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন। আমি নয় অতি সরলীকরণই ক’রছি, কিন্তু আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বহুকাল আগেই তাঁর ‘বাঙালির মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার’ প্রবন্ধে আপামর ভারতবর্ষের সঙ্গে বাঙালিদের এই পার্থক্য দেখিয়ে গিয়েছেন। এমনটি নয় যে বাঙালি ব্যবসাদার বা অবাঙালি বেতনভোগী আজকের দিনেও একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ, তবুও এখানে যাঁদের কথা বলা হ’চ্ছে তাঁরা মূলতঃ সমাজের তথাকথিত উচ্চস্তরের অন্তর্গতঃ।
এমনটি কেন হ’লো তার উত্তর পেতে হ’লে আমাদের দেশীয় ইতিহাসের ২টি প্রান্ত ছুঁয়ে যেতে হয়, ব্রিটিশ-পূর্ব ভারত এবং ব্রিটিশ-উত্তর ভারত। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষবেলায় অখণ্ড ভারতে যখন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য ক’রতে আসে, তখন বার্ণিয়েরের কথামতো মণিমুক্তো রাস্তাঘাটে ছড়ানো থাক আর না’ই থাক, প্রাকৃতিক সম্পদের এখানে অভাব কোনোকালেই ছিলোনা। শ্রেণীবৈষম্য পৃথিবীর প্রতিটি দেশের চিরকালীন বিষয়, কিন্তু বাংলার বণিক শ্রেণী যে একপ্রকার বিনা বাধায় ফুলেফেঁপে উঠেছিলো তাতে তৎকালীন আর্থসামাজিক পরিকাঠামো সম্পর্কে খুব বেশী সন্দেহ জাগবার কথা নয়। তবে একথাও অবশ্যই ঠিক যে সংখ্যাধিক্য থাকলেও শোষণের বিরূদ্ধে সহ্যশক্তি শ্রমজীবী শ্রেণীর মজ্জাগত, তা না থাকলে কিছু মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষীর সাহায্যে কেবল ভারতবর্ষের বাণিজ্যকে ভিত্তি ক’রে প্রথম বিশ্বের দেশ হিসাবে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেতোনা ইংল্যাণ্ড। কিন্তু কোম্পানির আমলে দেশ অখণ্ড থাকাকালীন অবাঙালি বলয়ের মধ্যে যে রাজানুগ্রহতা আর বাঙালি বলয়ের যে বাণিজ্যপ্রধান অর্থনীতি তার সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিলো কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অবস্থান। ঔরঙ্গজেব নিজের শেষ জীবনে বাংলা থেকে এতো কর পেয়েছিলেন যে এর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ ছিলোনা তাঁর। এমতাবস্থায় মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসাবে দিল্লী ও তার পার্শ্ববর্তী উত্তর-পশ্চিম ভারত স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রাজকোষের ওপর নির্ভরতায় অভ্যস্ত ছিলো, কিন্তু ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য যেই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা কোম্পানির হাত ধ’রে পূর্ব-ভারতের কলকাতায় স্থানান্তরিত হ’লো প্রথম পক্ষ প’ড়লো আতান্তরে আর দ্বিতীয় পক্ষের হ’লো পৌষমাস। রাজধানী নিয়ে তারপর মেলাই টানাহ্যাঁচড়া হ’য়েছে, কিন্তু পূর্ববঙ্গের গুরুত্ব ব্রিটিশ ভারতে কমেনি কোনোদিনও। যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই অভ্যাসেরও মেরু পরিবর্তিত হ’য়েছে। ১৯০ বছর ধ’রে শাসন (আদপে শোষণ) করার পর আমাদের দেশকে টুকরো ক’রে দিয়ে তারা যখন চ’লে গেলো, তখন উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় বা অবাঙালি কৃষকদের সমস্ত কৃষিযোগ্য জমি প’ড়ে র’ইলো পশ্চিম পাকিস্তানে আর বাঙালি কৃষকদের সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে গেলো পূর্ব পাকিস্তানে। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশভাগ হ’য়েছিলো ব’লেই চরিত্র ও ভাষাগত বৈচিত্র্যে গুরুত্ব আরোপ করা যায়নি, ক’রতে গেলে ‘ভারতবর্ষ’ বিষয়টিই একটি গল্পকথা হ’য়ে যেতো।
১৯৪৮এ সমস্ত খুইয়ে দাঙ্গার ভয়ে যখন রেলপথে ভারতবর্ষে এসে জড়ো হ’চ্ছে অসংখ্য উদ্বাস্তু, তাদের মধ্যে মূলতঃ উপস্থিত ছিলো এই ২টি রাজ্যের বাসিন্দারাই, ১। পশ্চিম পাঞ্জাব, ২। পূর্ববাংলা। রাজধানী তখন দিল্লীতে, কেন্দ্রে আসীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জাতীয় কংগ্রেস সরকারের সামনে তখন চরমতম পরীক্ষা। চরমতম এই কারণেই যে টুকরো কেবল ভারতবর্ষকেই করা হ’য়েছে এবং এই যারা উদ্বাস্তু আসছে তারা হিন্দু বা মুসলিম যা’ই হোকনা কেন, তারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে আসছে এবং কোথাও না কোথাও এদেশের মাটিতে অধিকার তাদেরও। পাকিস্তান ঘোষিত মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ায় একদিকে হিন্দু মহাসভার চাপ, অন্যদিকে সর্বধর্মসমন্বয়ের গান্ধীবাদী দর্শন, সব মিলিয়ে নেহরু পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পূর্ব পাঞ্জাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত শিখদের পুনর্বাসনে অতিরিক্ত মনোনিবেশ ক’রলেন। একঢিলে প্রায় খানতিনেক পাখি মেরে ব’সলেন তিনি, যেমন- সরকারী দায়িত্ব পালন, আপামর ভারতবর্ষের হিন্দী বলয়ের পরোক্ষ ইচ্ছাপূরণ, হিন্দু মহাসভার প্রত্যক্ষ ইচ্ছাপূরণ, সর্বোপরি উৎপাদনে বৃদ্ধি (উদ্বাস্তুদের কর্মদক্ষতায় নেহরুর পূর্ণ বিশ্বাস না থাকলেও অবিশ্বাস অন্ততঃ ছিলোনা)। যদিও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেস একরকম নিশ্চিতই ছিলো, তা সত্ত্বেও এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে দেশব্যাপী তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি ক’রলো। নেহরুর আরো সুবিধা হ’লো, যখন তিনি দেখলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানে স্বেচ্ছায় চ’লে যাওয়া মুসলিমদের জমিগুলিই তাঁরা নিশ্চিন্তে উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে এই জমিগুলি কিন্তু সেই সময় একেবারেই কৃষিযোগ্য ছিলোনা। ভারত সরকার একপ্রকার নিজদায়িত্বে একে দেশীয় শস্যভাণ্ডারে রূপান্তরিত ক’রলেন (এবং সময়মতোই তা প্রাপ্তদের এক নির্দিষ্ট অংশের কুক্ষিগত হ’য়ে গেলো)। একে ঘিরে শুধু পাঞ্জাবই নয়, প্রায় গোটা পশ্চিম ভারতে একটি বৃহত্তর অর্থনীতির জন্ম হ’লো এবং এটিই হ’চ্ছে ভারতবর্ষের প্রথম সরকারগঠিত ‘তথাকথিত আত্মনির্ভর’ শ্রেণী, যারা আজ সত্তর বছর পরেও নিশ্চিন্তে মুখের ওপর ব’লতে পারে, “নৌকরি নেহি মিলেগা তো খেতিবাড়ি করেগা”। কৃষির পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্যনগরী গ’ড়ে ওঠা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত বিষয় এবং এভাবেই স্বয়ং রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রচেষ্টায় স্বাধীন ভারতবর্ষে আত্মনির্ভরতার পাশাপাশি প্রথমবার সৃষ্টি হ’লো সংগঠিত একটি বৃহত্তর পরজীবী পুঁজিবাদী শ্রেণী বা ‘ইন্ডিয়ান বুর্জোয়াঁস’। সেই সময়ও আর্থিকভাবে যারা তথাকথিত উচ্চস্তরীয় ছিলো তারা তো ছিলোই, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কবরে এই পদক্ষেপ আরো গভীরতা বৃদ্ধি ক’রলো, দেখতে দেখতে তৈরী হ’লো পুঁজির নূতনতর ব্যবহার, আপাতদৃষ্টিতে যার নাম দেওয়া হ’লো কর্মসংস্থান। আগেই ব’লে রাখি যেখানে শ্রম দেওয়াতে অপরের ব্যক্তিগত সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটে তাকে কর্মসংস্থান নয়, সোজা কথায় ‘পরোক্ষে শোষণ’ ব’লে। আসল কর্মসংস্থানে কোনো ব্যক্তির নয় গোষ্ঠীর স্বার্থ বর্তমান থাকে, সেক্ষেত্রে গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে শ্রমিক সেখানে আপন অগ্রগতির উদ্দেশ্যেই কাজ করে। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রে সে অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, পরিহার্য বা পরিবর্তনীয় অংশ নয় এবং ঠিক এই কারণেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অপসারণকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় যাতে শ্রেণীবৈষম্য অপসৃত হ’তে পারে। প্রয়োগ তর্কসাপেক্ষ হ’লেও তত্ত্ব এখানে একশোভাগ সমর্থনযোগ্য।
ঠিক এইবারে আমরা তত্ত্ব ছেড়ে শেষবারের মতো ঢুকবো ইতিহাসের অন্য অভিমুখে, যেখানে ভারত সরকার মানুষকে প্রথম পক্ষের মতো তথাকথিত আত্মনির্ভরতাটুকুও দেয়নি। সেইসময় পশ্চিমবঙ্গ আর পাঞ্জাবের মূল যে পার্থক্যগুলি মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিলো সেগুলি হ’লো, ১। পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের ঢালাও পুনর্বাসন দেওয়ার মতো ফাঁকা জমি পশ্চিমবঙ্গে আদৌ ছিলোনা, ২। ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে বাকি জনগোষ্ঠীগুলির কাছ থেকে বাঙালিরা পাঞ্জাবের সমতুল সমর্থন পায়নি, ৩। আনুগত্য দেখানো দূরে থাক, এরা কলকাতায় এসে পৌঁছোনোর কয়েকদিনের মধ্যেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সরকারের বিরোধিতা শুরু ক’রেছিলো এবং সর্বোপরি ৪। বাঙালি জনগণের তোলা নেহরুর প্রতি শ্রী সুভাষচন্দ্র বসুসংক্রান্ত অভিযোগের ক্ষত জাতীয় কংগ্রেসের মন থেকে তখনও শুকোয়নি, অতএব “বড্ড বেড়েছে, ম’রুক শালারা” (এ আমার নিছক অনুমানও হ’তে পারে) যা জাতীয় কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপেও শ্রী ভগৎ সিংহকে হারিয়েও পাঞ্জাব কোনোদিন তোলেনি। কিন্তু এসব কষ্টকল্পনা যদি বাদও দিই এর পেছনে এক অত্যন্ত ঘৃণ্য রাজনীতি উঠে আসে যে চিন্তা ও দর্শনসংক্রান্ত প্রেক্ষিতে বাঙালি অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশী বুদ্ধিমান আর কর্মসংস্থানের নামে পুঁজিবাদের বৃদ্ধিতে এদের মস্তিষ্ক রাষ্ট্রের যেমন ক’রে হোক চাই। মাথায় তো এরা এগিয়ে আছেই, পেটে যদি খেতে না পায় এই আলস্যপ্রিয় জাতির প্রত্যেকটি মানুষ কায়িক শ্রমও দেবে, যেমন ক’রে বাকি রাজ্যগুলির অন্যান্য মানুষেরা দিচ্ছে। অতএব রাষ্ট্রযন্ত্র কেবল একটিমাত্র সংখ্যালঘু শ্রেণীর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এক বিশাল সংখ্যক মানুষকে বলি ক’রে দিলেন এবং তার নাম দিলেন ‘আর্থসামাজিক সম্পর্ক’। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমরা তাতে সহমতও হ’য়ে গেলাম আর বিগত সত্তর বছর ধ’রে “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চ’লিতেছে”। কীভাবে চ’লিতেছে তা ব’লেই আজ শেষ ক’রবো।
অন্যান্য সমাজের মতো বাঙালিদেরও ঠিক ২টি আপাত দৃশ্যমান ভাগ আছে, ১। উচ্চবিত্ত, ২। নিম্নবিত্ত। উচ্চবিত্ত নিজের প্রেক্ষিতে পুঁজি বৃদ্ধি ক’রতে নিম্নবিত্তকে ব্যবহার করে এবং উদ্ভূত পুঁজিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে নিজস্ব অবস্থার উন্নতিতে (মূলতঃ শিক্ষাখাতে) ব্যয় করে, অর্থাৎ অবস্থাপন্ন কৃষক তার সন্তানকে প্রযুক্তিবিদ বানায়, কারণ এর বেশী শিক্ষা দেওয়া বা পাওয়া সম্পর্কে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষেরই কোনো ধারণা নেই (শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে)। সন্তানও ঐ পরজীবী শিক্ষাতেই তথাকথিত শিক্ষিত হ’য়ে আসে এবং যন্ত্রসভ্যতার উন্নতির নামে নিম্নবিত্তকে নিজের পরবর্তী প্রজন্মের উন্নতির উদ্দেশ্যে শোষণ করে। তবে মালিকানা বাদে প্রযুক্তিবিদ হিসাবে সে কীভাবে নিজের পুঁজি বৃদ্ধি করে? সে’ই যে তথাকথিত আত্মনির্ভরদের কথা ব’লছিলাম তাদের পুঁজিবৃদ্ধিতে সাহায্য ক’রে। এমনভাবেই প্রতিদিনের চাপে নিম্নবিত্ত ক্রমাগতঃ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হ’য়ে যেতে থাকে আর কোনোভাবে তাদের একজনও যদি প্রখর মেধাকে ব্যবহার ক’রে প্রতিষ্ঠিত হয় সে’ও ঠিক একইভাবে নিজের তুলনায় নিম্নবিত্তদের শোষণ করা চালিয়ে যেতে থাকে, কারণ এইভাবেই সে অতীতের ওপর প্রতিশোধ নেয় (এবং স্বজাতির প্রতি এহেন অসভ্যতার অভ্যাস ভারতবর্ষে মূলতঃ আমাদেরই আছে আর কারোরই নেই)। শ্রী নন্দরাম সেনকে যখন হিসাবরক্ষক ক’রে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তার মাত্র বছরদেড়েকের মধ্যেই তহবিল তছরূপের অভিযোগে তিনি বহিষ্কৃত হন এবং জনৈক মারোয়াড়ীকে তাঁর স্থানে এনে বসানো হয়। তারপর সেই অবাঙালি পরিবার সেখানে এমনই সমৃদ্ধিশালী হ’য়ে ওঠে যে তাঁদের নিজ নিজ দেশোয়ালি ভাইয়ের গদিতেই আজকের ‘বড়োবাজার’ ভর্তি আর নন্দরাম সেনের জাতভাইরা তাঁদের বেতনভোগী মাত্র। যে জাতি শ্রী সুভাষচন্দ্র বোসের মতো এক নেতার জন্মদাতা, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দার্শনিক যাদের মাঝে জ’ন্মেছেন, ভাবা যায় সে জাতির একতায় দেশীয় সৈন্যবাহিনীর কোনো বিশ্বাস নেই? আত্মনির্ভরতা পাওয়ার বহু আগেই কেবল ব্যবহার ক’রতে আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হ’য়েছে ঠিকই, কিন্তু তারপরে আমরাও আর এক হ’তে চেষ্টা ক’রেছি কি? ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ তত্ত্বে বিশ্বাসী যে জাতি পরার্থপরতা ব’লে কিছু বোঝেইনা, তাদের পক্ষে সকলে মিলে রাষ্ট্রনেতাকে জোর গলায় বলবার মতো সাহস কোথায় যে চরম বিপদে যাতে ‘আত্মনির্ভর’ হ’তে না হয় সেইজন্যই সকলকে বাদ দিয়ে ঐ আসনে তাঁকে নির্বাচিত করা হ’য়েছে? “হয় খাও, নয়তো খাবার হও” এ নীতি জঙ্গলে চ’লতে পারে সভ্য মানবসমাজে নয়। কেবল পেটের টানে সাড়ে ছয়শো কিমি পথ যাদের পায়ে হেঁটে মজুর খাটতে আসতে হয় তাদের কীসের আত্মনির্ভরতা? কীসের আশ্বাস দিচ্ছে রাষ্ট্র? বীজাণুর প্রভাব ছেড়ে দিন, সুস্থ সময়ে কোন পরিষেবা আমরা পেয়েছি ব’লতে পারেন? কাদা না ছুঁড়লে তো রাজনীতি হয়না আজকাল। ভারতে থেকেও বাংলায় কথা ব’লি তাই আমরা বাঙালিরা বাংলাদেশী। সর্বধর্মসমন্বয়ে বিশ্বাস ক’রি তাই আমরা দেশদ্রোহী। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে মৌলিকত্ব আছে তাই আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী। আমাদের সমস্ত কেড়ে নিয়ে আমাদেরই কাছে বিক্রীতে আমরা সন্তুষ্ট, তাই আত্মনির্ভরতা আমাদের (মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের) মজ্জাগত।
আজ থেকে বহুকাল আগে জনৈক আত্মনির্ভর ব্যক্তিত্ব তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “যে অন্ধকার অতীত থেকে স্বচেষ্টায় উঠে এসেছি তার উন্নতিসাধনেও আমি কোনোদিন সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে চাইনা আর। পাছে বর্তমানে ঐ জীবনের স্পর্শ লেগে যায়।” তিনি বিশ্বাস ক’রতেন, তাঁর মতোই যে বাঁচার যোগ্য সে’ই বাঁচবে, নয়তো পৃথিবীকে ছাড়তে হবে পুরোপুরি। দৃষ্টিভঙ্গীর পাশাপাশি নিজের নৈতিকতাতেও পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো তাঁর…