লেখক – বিজন দাশ প্রকাশক – পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি
‘মাইহার’ শব্দটি শুনলেই সুরের মূর্চ্ছনা এসে আপনার শ্রবণযন্ত্রে একটি পরশ বুলিয়ে যাবে। ভারতীয় মার্গ সংগীতের বিষয়ে আপনার যদি খুব বেশি জ্ঞান নাও থাকে, তাহলেও সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে শোনা সেতারের সুর আপনার মনে পড়ে যাবে। আপনি জানেন, পন্ডিত রবিশঙ্কর এই চলচ্চিত্রে সুরস্রষ্টা ছিলেন। আপনি হয়তো পন্ডিত আলী আকবর খাঁ সাহেবের নামও শুনেছেন। এই দুই সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের নাম জানার সাথে সাথে আপনি এটাও জানেন এঁরা দুজনেই বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের শিষ্য, যিনি মাইহার ঘরানা সৃষ্টি করেছিলেন। ব্যাস ,এই পর্যন্ত যদি আপনার ধারণা হয় তবে আপনি হাতে তুলে নিতেই পারেন শ্রী বিজন দাশ মহাশয়ের লেখা সুরের সন্ধানে বইটি।
আসলে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত বিষয়ে আমার জ্ঞান প্রায় না-বাচক। তাই এই বইটি যখন আমার এক সহকর্মী আমায় দিলেন, তখন আমার মনে হল, এই গ্রন্থ লইয়া আমি কি করিবো। বই হাতে নিয়ে পড়তে হয় বলে, আমি পৃষ্ঠা উল্টোলাম,এবং তারপর বইটিতে মগ্ন হয়ে গেলাম।
সুরের সন্ধানে বইটি পন্ডিত আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জীবনী গ্রন্থ। স্বল্প পরিসরে বিরল প্রতিভার এক বিশাল মাপের ব্যক্তিত্বের জীবনকে বর্ণনা করা হয়েছে খুবই সহজ ভাষায়। ভাষার কারণে বইটি খুব সাবলীল ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যায় পাঠককে।
আসলে বইটি সম্পর্কে বলার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার ইচ্ছাকে বাড়িয়ে তোলা। যে অসাধারণ মনি -মানিক এই সংস্কৃতির অঙ্গ তাদের সম্পর্কে জানা আমাদের কর্তব্য।
পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রামে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জন্মগ্রহণ করেন। তখন তাঁর নাম ছিল আলম। বাড়ির পরিবেশ ছিল সংগীতময়। কিন্তু তাঁর সুরের তৃষ্ণা ছোট পরিসরে আটকে থাকার নয়। তাই বাড়ি থেকে পালালেন আলম।
সংগীতের প্রতি এক অসীম পিপাসায় পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাড়ি থেকে পালিয়ে মাইহার এ থিতু হওয়ার যে অসামান্য সংগ্রাম বৃত্তান্ত তা প্রতি মুহূর্তে চমকিত করে। কন্ঠ সংগীত, যন্ত্র সংগীত যার মধ্যে বাঁশি, সেতার, ব্যানজো, ম্যানডোলিন, সানাই, মৃদঙ্গ, তবলা, বেহালা , সরোদ ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র ছিল, তা আলাউদ্দিন এমনভাবেই আত্মস্থ করেন, যাতে তাঁকে স্বয়ং সরস্বতীর বরপুত্র বললেও অত্যুক্তি হয় না। কখনো কোনো সহৃদয় ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন, খেয়েছেন পথের ধারে একবেলা, কখনো মিনার্ভা থিয়েটারে তবলা বাজানোর চাকরি করেছেন, কখনো গুরুর কৃপা পাওয়ার জন্য তাঁর জন্য ফাইফরমাস খেটেছেন, যদি সুর জগতের কোনো চাবিকাঠি তাঁর হাতে আসে।
এই সাধনা যে কত কঠিন ছিল তা জানতেই পারতামনা এই বইটি না পড়লে। সংগীতের মধ্যে যে ঈশ্বর আছেন তাঁকে লাভ করতে গেলে নিজেকে যে এমন ভাবে উজাড় করে দিতে হয় বা দেওয়া যায় তা আমার মতো সাধারণের বোধের বাইরে ছিল।
এই বইটি ঈশ্বর প্রাপ্তির একটি journey। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ পরবর্তী কালে যে আলোকপ্রভা সৃষ্টি করেছিলেন তা আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ‘চন্দ্রসারং’, ‘সুরশৃঙ্গার’ বাদ্যযন্ত্র ছিল তাঁর নির্দেশে বানানো বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে অন্যতম। হেমন্ত, মেঘবাহার, মদনমঞ্জরী, শোভাবতী, মোহাম্মদ, চন্ডিকা ইত্যাদি হল তাঁর সৃষ্ট রাগ।
বাবা কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে তাঁর শিষ্যদের তৈরি করেছিলেন। শ্রী তিমিরবরন, পন্ডিত আলী আকবর খাঁ, পন্ডিত রবিশঙ্কর, পন্ডিত নিখিল বন্দোপাধ্যায়, কন্যা অন্নপূর্ণা তাঁর সুযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম।
বাবা আলাউদ্দিন জীবনে অনেক সম্মান ও খেতাব পেয়েছেন পরবর্তীকালে। সেই সাফল্যমন্ডিত সময়কালের পিছনে যে পরিশ্রম, যে সাধনা রয়েছে তা আমাদের শিক্ষণীয়। চিরন্তন শিল্পীর এই জীবনআলেখ্য সাধারণের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে সংগীত ঈশ্বরের কাছে নিজেকে নিবেদনের জন্য।