• Uncategorized
  • 0

গল্পে সুজাতা রায়

দূরারোগ্য

যতন প্রথম যেদিন আমাদের বাড়িতে এলো সেই সন্ধ্যায়  কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি!উঠোন পেরিয়ে গোয়ালঘর তার পাশে পাঁচিল, সেই পাঁচিলের ওপারের পুকুর সেই পুকুরের জল একেবারে সব টপকে খিড়কির দোরে ঘাই মারতে লাগলো।গোয়ালের আজার পার করার বড়ো নর্দমা দিয়ে পুকুরের কই-মাগুরগুলো কিলবিলিয়ে গোয়ালে ঢুকে পড়লো, সেই সঙ্গে নাগাড়ে লোডশেডিং,না বাপু সে আমলে ইনভার্টার বলে কিছু ছিলো না,গাঁ -ঘরের বড়লোকদের বাড়িতে ডায়নামো চলতো, জেনারেটর তখনও এসে পৌঁছেয়নি,আমাদের বাড়িতে হ্যারিকেন আর লম্ফ, সেই সব জ্বালিয়ে মা -কাকিমা -ঠাকুমারা উঠোনের আরেক পাড়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় বৃষ্টির ছাট আটকাতে আর  সন্ধ্যার জলখাবার গোছাতে ব্যস্ত। আমরা তুতো-খুতো এক কিল্লি ভাইবোন পাকা বারান্দার মধ্যিখানে লম্ফ নিয়ে বই খুলে জলখাবারে মুড়ির সঙ্গে কি আসছে সেই চিন্তায় উশখুশ করছি, এমন সময় বাবার বন্ধু তারাপদ সমাদ্দারের পেছন পেছন একটা বোঁচকা হাতে গুটিসুটি মেরে যতনের  প্রবেশ।কালো-রোগা-ঢ্যাঙ্গা-বোকাসোকা যতনকে দেখে আমরা সবাই বইপত্র শিকেয়  তুললাম।বুঝলাম একটা জম্পেশ গল্প ঘনিয়ে এসেছে, এমন বৃষ্টির সন্ধ্যা বৃথা যাবার নয়।
তারাপদ সমাদ্দার যে কি করে বাবার অমন জিগরি দোস্ত হয়ে উঠেছিল সে আজও রহস্য।আমার অমন গ্রাম্ভারি বাবার কিনা অমন একটা উনপাঁজুরে ফক্কিকাড়ি বন্ধু?শুধু কি বন্ধু !যাকে বলে ফ্রেন্ড -ফিলোজফার এন্ড গাইড।আমরা আড়ালে তারাপদকে টর্পেডো করে কাকুটা বাদ দিয়ে ডাকতাম।কবে কোন ছোটবেলায় বাবাকে পুকুরে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে ছিলো তাই ঠাকুমারও এক্কেবারে নয়নের মনি। যে কোনো বিষয়ে তার কথাই শেষ কথা।বিয়ে থা করেনি,দিন রাত টংটং করে ঘুরে বেড়ানো আর কার ছেলের পিলে বেড়েছে,কার মায়ের বুক ধড়ফড়,কে বই এর অভাবে পড়তে পারছে না, কার ভাই গলিতে ঢুকে বিড়ি ফুঁকেছে সবেতে তার মাথাব্যথা। মা -কাকিমারা বাবা আর ঠাকুমার ভয়ে কিছু  বলতে পারতো না কিন্তু আড়ালে  হাসাহাসি করতো টর্পেডোকে নিয়ে।যতন হলো টর্পেডোর দূরসম্পক্কের মামতো ভাই এর ছেলে।ভবঘুরে বাবা- মৃত মায়ের একমাত্র সন্তান।অবিবাহিত টর্পেডোর নিজের কোন ঠাঁই ঠিকানা নেই তাই যতনকে ঠাকুমার কাছে এনে ফেললো,আমাদের বাড়িতে থেকে  সবার ফাইফরমাস খেটে থাকা খাওয়াটা জুটে যাবে এই ভেবে।বারোভূতের হেঁসেলে একটা ভূতের পেট আপসে ভরে যাবে কেউ টেরও পাবে না,মাঝখান থেকে হাত-নুরকো একটা পাওয়া গেল, এই ভেবে ঠাকুমা বাবা -কাকাদের ফেরার আগেই যতনকে ঠাকুমার ঘরে পোটলাটা রেখে ভিজে গা মাথা মুছে আসতে বললো।টর্পেডো রাত্তিরে খিচুড়ির বরাত দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।আমরা মুড়ির বাটি আর যতনকে নিয়ে পড়লাম। ‘যতন তোর নাম কি?’ ফিক করে হেসে বললো -‘যা বললে তাই সরকার’।বুঝলাম যতোটা দেখতে লাগে ততটা বোকা নয়।
আমাদের মিষ্টির দোকান।বাবা-কাকা-জ্যাঠা মিলে পাঁচ ভাই আর একটি মাত্র পিসি।সে পিসি বাড়ির সকলের নয়নের মণি।আমাদের এই মিঠাগড়িয়া গ্রাম থেকে পিসির বাড়ি প্রায় বাইশ কিলোমিটার হবে। ধান-চালের বিরাট ব্যবসা পিসেমশাই এর, চার মেয়ে এক ছেলে জা-জাউরি নিয়ে ভরন্ত সংসার,পিসি কোনও উৎসব নৈলে অঘটন ছাড়া আসে না।কথায় কথায় বেরোলো ঐ পিসির গাঁয়েই যতনের বাড়ি।রাতের দিকে বৃষ্টিতে একটু টান ধরলে বাবা কাকারা দোকান থেকে ফিরতেই টর্পেডো হাজির।যতন এর কথা উঠতেই বাবা সব শুনে ওকে কাজের লোক হিসেবে রাখতে নারাজ, যতোই হোক বন্ধুর নিজের লোক তার ওপর বোনের শ্বশুরবাড়ির দেশের বারো তেরো বছরের একটা পুচকে ছেলে।কিন্তু অনাথ একটা বাচ্চাকে তো আর ঝেড়ে ফেলা চলে না,মানে সেকালে চলতো না,টর্পেডোর সম্মানের কথা ভেবে শেষে সবাই মিলে ঠিক হলো যতন এ বাড়িতেই ছেলে হয়ে থাকবে। একটা পেট আর বছরে দুটো জামা ই তো লাগবে তার বদলে কতো কুইন্টাল পূণ্যি হবে সেটা হিসেবে রাখতে হবে না?পরদিন সকালেই ঠাকুমার সঙ্গে গিয়ে  যতন আমাদের জগদানন্দ বয়েজ হায়ার সেকেন্ডারী ইস্কুলে ক্লাস ফাইভে মানে আমার সঙ্গে ভর্তি হয়ে এলো।আস্তে আস্তে ঝাঁকে মিশে যতন হালদার বাড়ির সদস্য হয়ে গেল।ওর আর আমাদের মধ্যে যে টর্পেডো ছিলো, সবাই, বিশেষ করে যতনও সেটা ভুলে গিয়ে আড়ালে জ্যাঠার বদলে টর্পেডো ডাকা শুরু করলো।সারাটাদিন একসঙ্গে নাওয়া-খাওয়া -পড়াশুনো চললেও রাতে কিন্তু যতন ঠাকুমার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় একটা চৌকিতে শুতো।সেই যে প্রথম দিন ঠাকুমার ঘরে ওর পুটুলি রেখেছিল সেদিনই কোন অলিখিত নিয়মে যতন যতটা আমাদের হলো তার চেয়ে একটু বেশি ঠাকুমার হলো।বাধ্য-বুদ্ধিমান-মৃদুভাষী-রসিক যতন খুব সহজেই সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেও ওর কিন্তু যতো ভালোবাসা ঠাকুমার ওপর, আমি কেমনকরে যেন বুঝতে পারতাম।আস্তে আস্তে আমরা ভুলে গেলাম যতন আমাদের কেউ না।
 ক্লাস নাইনে আমি সায়েন্স নিলাম,যতন আমার চেয়ে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কমার্স নিলো।হায়ার সেকেন্ডারিতে ভালো রেজাল্ট করে আমি জেলা সদরে অনার্স পড়তে চলে গেলাম আর সবাই কে অবাক করে দিয়ে যতন পড়ায় ইতি টানলো।বাড়ির বড়দের বোঝানো-বকুনি, ঠাকুমার রাগারাগি সবেতে চুপ থেকে যতন বাবা-কাকাদের সঙ্গে দোকানে জুড়ে গেলো।বাবা জ্যেঠাদের বয়স হচ্ছে,আমরা ভাই বোনেরা পড়াশুনোর জন্য সবাই গ্রাম ছাড়া, বাড়িতে  একটা জোয়ান ছেলে থাকার উপযোগিতা বুঝতে পেরে সবাই যতনের এই সিদ্ধান্তে খুশিই হয়েছিল নিশ্চিত, অবশ্যই ঠাকুমা বাদে।দোকানেও চাপ বাড়ছে আস্তে আস্তে।মানুষ বাড়ছে সেই সঙ্গে গাড়ি ঘোড়া যোগাযোগ।গ্রামেও শহরের আঁচ লেগেছে,দূরদর্শন এসে গেছে।নীলিমা সান্যাল-ইভা নাগ- -দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় -উপেন তরফদারদের জায়গায় ছন্দা সেন-রমেন পাইন –  কমলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়(যাকে বয়কাট চুলের জন্য যতন ফিচলেমি করে মিস্টার কমলিকা বলতো),হিন্দীতে মঞ্জরী যোশী,সালমা সুলতান  এদিকে চৈতালি-শাশ্বতী সব হইহই করে হেঁসেলে ঢুকে গেছে।আমাদের দোকানেও জেম কোম্পানির ফ্রিজ এসে গেছে।একতলা পাকাবাড়ি তিনতলা হয়েছে।ঠাকুমা ঝুঁকে আসছে মা -জ্যেঠিরা সংসারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।গাঁয়ের ঝি বৌরা সন্ধ্যা বেলায় অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ‘ঢাকায় থাকি’ দেখবে বলে বিকেলে রান্না সেরে নিচ্ছে -শনি-রবিবার ঘরে বসে সিনেমা দেখা ভাবা যায়?এতোকিছু বদলের মধ্যেও কিন্তু  আমাদের যৌথ পরিবার ঠাকুমাকে কেন্দ্র করে শক্তপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে রইলো। আগের মতোই দিনের শেষে ঠাকুমাকে দোকানের পাওনাগন্ডা বুঝিয়ে দিয়ে দোকানের  চাবি টাকা ঠাকুমার হাতে দিয়ে বাবা নিজের ঘরে যায়।মাসকাবারি সংসার খরচ মা ঠাকুমার হাত থেকে নিয়ে মাসের শেষে হিসেব বুঝিয়ে দেয়।এখনো টর্পেডো নিয়মিত এসে ঠাকুমার আদরখেয়ে  মা -জ্যেঠিমাদের হাসির খোরাক জুটিয়ে যায়।বাইরের সব বড়ো বড়ো   বদলগুলো আমাদের খিড়কির পুকুরের ওপারে এসে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু ঐ একবারই এক বর্ষার সন্ধ্যায় জলের তোড়ের মুখে ভেসে যে যতন এই উঠোন টপকে এই বারান্দায় এসে উঠেছিলো সে এখনো ঠাকুমার ঘরের বারান্দার সেই চৌকিতেই ঘুমায়।
ঠাকুমা একমাস ধরে অসুস্থ।শরীরেরই বা দোষ কি চুরাশির কাছাকাছি বয়স।প্রায়ই ঘুষঘুষে জ্বর আসে বিছানাতেই পায়খানা – পেচ্ছাব।গত তিনদিন ধরে কোনও সারাশব্দ নেই শুধু ধুকপুক করে বুকের ওঠানামা জানান দিচ্ছে – প্রাণ আছে।আমাদের খবর দিয়ে আনানো হয়েছে।দোকান -সংসার সব নিজের নিয়মে চলছে। শুধু যতন এখন বারান্দার চৌকি থেকে ঠাকুমার খাটে উঠেছে।ঘন্টায় ঘন্টায় গু – মুতের কাঁথাকানি পাল্টায়,ভেজা তুলো দিয়ে ঠোঁট মোছায়,ধূপ ধরিয়ে দুর্গন্ধ তাড়ায়। বাড়ি জুড়ে একটা প্রতীক্ষার বাতাস বয়ে যাচ্ছে – মৃত্যুর  প্রতীক্ষা।
অবশেষে এক অঝোর বর্ষার ভোরে ঠাকুমা মারা গেল।জ্ঞানত সেই প্রথম আমাদের বাড়িতে মৃত্যুশোক।দাদুর মৃত্যুর সময় আমরা নাতিপুতিরা অধিকাংশ ই জন্মাইনি যারা জন্মেছে তারা নিতান্তই শিশু।মাসাধিক কালের প্রতীক্ষার অবসান।শোকের তলেতলে কোথাও একটা মুক্তির চোরাস্রোত ও বইতে লাগলো।ব্যতিক্রম যতন।ও কোনোদিনই বেশি কথা বলতো না এখন কেমন গুম খেয়ে গেছে।ঘোলাটে চোখে কেমন সুদূরের চাউনি।শুধু মনে হয় ও যেন তলে তলে কার সঙ্গে লড়াই করছে।
রাত পোয়ালেই বাড়ি খালি হয়ে যাবে।কাল আমরা যে যার জায়গায় ফিরে যাবো।আত্মীয় স্বজনরা আগেই চলে গেছে।ঠাকুমা মারা যাবার পর থেকে যতন ঠাকুমার ঘরেই শুচ্ছিল কাল থেকে বাবা মা ওই ঘরে শোবে,যতন আবার বারান্দায় ফেরত যাবে,চাইলে ও আমার ঘরেও শুতে পারে রাতে খেতে বসে জানানো হলো।ঘাড় দুমড়িয়ে খেতে খেতে যতন একবার শুধু ঘাড় নাড়লো মানে ও বারান্দাতেই ফেরত যাবে।সবাই চুপ করে গেল।
পরদিন আমাদের কারো যাওয়া হয় নি।সারারাত অঝোর বৃষ্টির পর ভোরবেলায় উঠে সদর দরজা খুলতে গিয়ে মা হতবাক, দরজা হাট করে খোলা।পুকুরের জল রাস্তা ছুঁইছুঁই, মাঝের রাস্তা এখন অনেক উঁচু  হওয়ায় আর টপকাতে না পারলেও চেষ্টা চালিয়ে যায়।মা দৌড়ে ঘরে এসে বাবা কাকাদের ডাকতে সোরগোল পরে গেলো,হঠাৎ সবার খেয়াল হলোএতো চেঁচামেচিতেও যতনের ঘুম ভাঙলোনা!সন্দেহ হওয়ায় ঠাকুমার ঘরের দরজা ধাক্কাতেই দরজা খুলে গেলো -ভেতরে কেউ নেই।অবাক হয়ে দেখলাম বাবা হঠাৎ পাগলের মতো ঠাকুমার খাটের নিচে ঢুকে পালঙ্কের নিচের দিকের পাল্লা টানতেই পালঙ্কের গায়ে আটা চাপা সিন্দুক খুলে বেরিয়ে এলো।শূণ্য।পাঁচ বৌয়ের বিয়ের গয়না,চার মেয়ের বিয়ের জন্য গড়ানো গয়না,সত্তর বছর আগে ঠাকুমার বিয়ের গয়না সব।
এর পর বাবা আর বেশিদিন বাঁচেন নি।যতন কেও আর পাওয়া যায় নি।আমরা সবাই যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছি।শুধু একটা পরিবারের সবকটা সদস্য চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম,আমরা মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারালাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।