• Uncategorized
  • 0

গল্পে শুভ্র মৈত্র

এইম ইন লাইফ…

হাজার জিভের ঘষায় কাহিনীটায় নানা রঙ লেগেছিল। আবার কিছু রঙ হয়তো ঘষা খেয়ে উঠেও গেছে। তবু কাহিনীটা  নিয়ে নাড়াচারা হয়। এই মাধ্যমিক পরীক্ষাই নাকি রূপাতনের জীবনের বাঁক বদলে দিয়েছিল। বলা ভালো পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে ধরা পড়াটা। ওই যে অভয় মাষ্টারের হাতে চলে এলো বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ‘মাই এইম ইন লাইফ’, আর জীবনের ‘এইম’ টা বদলে গেল রূপাতনের। ধ্যুশ, শালা, থাকলো তোমার পরীক্ষা, বলে সেই যে হল ছাড়লো রূপা, একদম সোজা গিয়ে বাদলদার ঠেকে। বাদলদা’র ওখানে অনেক ছেলে। কথা বলে, বিড়ি-খৈনি খেয়ে সময় কেটে যায়। তারপর সেখান থেকেই নাকি একদিন বাদলদার নজরে পড়ে যাওয়া। ব্যস, পালটে গেল জীবন। 
এ সংসারে যা কিছু ঘটে তা সবই যে হওয়ার কথা ছিল তা নয়, তবে রূপাতনের জীবনের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। সবাই জানে, রূপা যা, মানে যা কিছু ঘটে ওর সাথে, সেসবের মধ্যে খুব চমক নেই। এই যেমন ওর নামটা। কোলেরটাকে দেওয়ালের দিকে ঠেলে সদ্য বিয়োনো বউয়ের গতরে যে রাতে আবার ঘাই মারল হারাধন, রূপাতন নামটা তখন চিড়িক মেরেছিল কিনা কেউ জানে না। সেই সময় আসলে মাথার কাজ তো কম, তাই সেখানে কিছু আসে কিনা তার কোন হিসেব রাখা হয় নি। তবে হারাধন মন্ডলের বড় ছেলের নাম যখন সনাতন রাখাই সাব্যস্ত হলো, ঐ বুড়ো বটের পাতায় নাকি সেদিনই লেখা হয়ে গেছিল পরেরটার নাম হবে রূপাতন। 
আবার রূপাতন নামটাও রাস্তার ধুলা বালিতে ঘষা খেয়ে শুধু ‘রূপা’য় এসে পৌঁছুবে সেটাও নাকি জানাই ছিল। নারায়ণকে নাড়ু, গদাধরকে গেদু বা পঞ্চাননকে পাঁচু বলার জন্য কবে আর অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হলো! 
এমনিতে ঝিম মারা গঞ্জের হইচই বলতে তখন মনসার গান, বুধবারের হাট, বন্যা আর ব্রাহ্মন বাড়ির মেয়েকে নিয়ে মন্ডলবাড়ির ছেলের পালিয়ে যাওয়া। হ্যাঁ, আর ছিল এই ইস্কুল। সে যুগে অনিল মাষ্টারের কালো পাম্প শু ইস্কুলের দরজা পর্যন্ত আসতে ধুলো মেখে সাদা হয়ে থাকতো। পরে সে জুতা লাল হলো, রাস্তায় মোরাম পড়েছিল। আর এখন তো পাকা রাস্তা, মাষ্টারদের গাড়ির চাকা দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। 
রূপা অবশ্য সেই ধুলা যুগেই গেছিল ইস্কুলে। সেটাই হওয়ার ছিল। আসলে গাঁয়ের সব ছেলে তখন এই ইস্কুলেই হাফ প্যান্ট পরে লাট খেত। তখন এত বড় দালান ছিল না। শ্যাওলা গায়ে সাদা রংটাই বোঝা যেতো না, তো নীল সাদা! আর দুপুরে খিচুড়ি তো শুরু হলো এই সেদিন। ভর্তি হওয়ার যেমন কোন উৎসব ছিল না, যাতায়াত বন্ধও হতো এক আশ্চর্য নির্লিপ্তিতে। কেউ কেউ শেষমেশ টানতো। রূপাও টেনেছিল। অবশ্য তার মধ্যে, ঐ যে বলে, পড়াশুনোয় আগ্রহ, সেসব কিছু নয়, নেহাৎই আর কিছু করার  ছিল না, তাই ইস্কুল শেষ  করে ফাইনাল দিতে গিয়েছিল রূপা। 
অন্য ইস্কুলে পরীক্ষা। তবু আজকাল যেমন বাপ-মা সঙ্গে যায়, তিনঘন্টা ঠায় বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে, পারলে হলে ঢুকে পরীক্ষা দিয়ে দেয়, সেসময় তেমন কিছু ছিল না। দু একটা বাপ যেত, তা হারাধনের তেমন কোনও আগ্রহ থাকার কথা ছিল না। রূপা যেত গাঁয়ের আর পাঁচজনের সাথে, সাইকেল ক্যারিয়ারে বই থাকতো। পরীক্ষা শুরুর আগে দেখার জন্য। আর থাকতো পকেটে, জ্যামিতি বক্সে বিভিন্ন মাপের কাগজ। কিন্তু শেষমেশ ওই যে পরীক্ষা হলে নকল বের করার আগেই ধরা পড়ল, তাতেই বন্ধ বই গুলো আর খোলা হলো না। 
এসব কাহিনী নিয়ে জিভের আড় ভাঙে গাঁয়ের মানুষ। চা-বিড়ির ধোয়ায় সাত সকালের বাসি আলসেমি কাটায়। আগেই বলেছি, কাহিনীতে জিভের ঘষায় রঙ লাগে, খসেও কিছু। যেমন বাদল’দা ঠিক কী দেখে রূপাকেই গাড়ির পাশের সীটটায় বসাতো বা কীভাবে রূপার কপালেই জুটলো ভোটের টিকিট—এসব কাহিনীর পুরোটা কিছুতেই জানা যায় না। এখন রূপা’র চলাফেরা নিয়ে চর্চা হয়, অতীত নিয়ে কম। এখন রূপা’র সাথেও অনেক ছেলে। ইস্কুলে এখন খেলার আসরে বা নিরঞ্জন মাষ্টারের বিদায়ের দিনে রূপা’কে ডাকাই দস্তুর। মাষ্টাররা তো কত সব গয়না জোড়ে রূপা’র নামের সাথে! সে তখন ‘বিদ্যালয়ের প্রাক্তনী’ রূপাতন মন্ডল। মাইকের সামনে কঠিন করে বলে। —-শুনে মনে হয় তিনদিনের বাহ্য পরিষ্কার হয় নি। কথাটার মানে যে এই ইস্কুলেই পড়েছে রূপা, সেটা বুঝতে দুই বিড়ি শেষ হয় পঞ্চাদের। 
এই ইস্কুল গেটের উলটো দিকে কার্তিকের চা গুমটিই ওদের সাতসকালের ঠিকানা। কাঠের তক্তায় ঠেস দিয়ে বসার সময় কারো পাশে পড়ে থাকে কোদাল ঝুড়ি, কেউ বা যত্ন করে কুর্নি গামলা রাখে একপাশে। কারো বা কিছুই নেই, শুধু দুইটা হাত নিয়েই গাড়ি ধরবে টাউনের। তার আগে গাঁয়ের খানিক ভালো মন্দের খবর নিয়ে নাড়াচাড়া। বলে বিপিন, সাদ্দাম, পঞ্চা, নিরাপদ রা, শোনেও ওরাই। না, ভুল হল, শোনে আরও কয়েকজন। ইস্কুল দেয়ালের গায়ে আঁকা ছবিগুলো। মুখ গুলি চেনে না ওরা, তবে সবাই ড্যাবড্যাব করে চায়ের দোকানেই তাকিয়ে থাকে, কারো হাসি মুখ, কেউ গম্ভীর। সত্যি কথা বলতে কী, ওদিকে তাকাতে খানিক ভয় ভয় লাগে পঞ্চাদের। নানা কিসিমের কথা হয় কিনা, রতনের বউ এর চরিত্র, বিনপাড়ায় বোতলের দাম বেড়ে যাওয়া, মোক্তারের আর একটা বিয়ে—সবই উঠে আসে এই কার্তিকের দোকানে। আসলে এই ফাগুন মাসে বোধহয় গল্পের ডালপালাও খানিক তরতরিয়ে বাড়ে। 
তবে আজকে, শুধু আজকেই বা কেন, কয়েকদিন ধরেই রূপা’কে নিয়ে চর্চা বেশি হচ্ছে। আসলে গাঁয়ে নতুন কিছু হলে রূপার কথাই হয় বেশি। এখন যেমন পরীক্ষা। এই ইস্কুলে  এবার মাধ্যমিকের ‘সিট’ পড়েছে। মানে অন্য ইস্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা এই ইস্কুলে আসবে পরীক্ষা দিতে। গাঁয়ের পক্ষে বড় খবর বটে। এতদিন এমন হয় নি। আর শুধু কি ছেলেমেয়েরা? পরীক্ষা দিতে আসে যারা, তাদের বাপ-মা-ভাই-বোন-পাড়ার দাদা—এসব মিলিয়ে তো আরও কত মানুষ আসবে। যে তিনঘন্টা ভিতরে পরীক্ষা চলবে, সেই সময় তো বাইরে ঠায় অপেক্ষা করবে সবাই। তাদের তেষ্টা পাবে না? চা মুড়ি খাবে না ওরা? সেই জন্যই শঙ্কর ঠেলা গাড়ি নিয়ে সকাল থেকেই হাজির। মুড়ি-ঘুগনি, তেলেভাজা। কার্তিকের দোকানেও নতুন বয়াম এসেছে বিস্কুটের। বেশ একটা মেলা মেলা ভাব। 
সকালে চায়ের দোকানে এসেই ধাক্কা খেতে হলো পঞ্চাদের। বেঞ্চিগুলো সব দখল। এতো ভোর ভোর চলে এসেছে পরীক্ষা দিতে? না, ভিড় করে আছে গাঁয়ের ছোঁড়া গুলোই। সাবির, কল্যান, ইলিয়াস। নিজের ব্যাটাকেও দেখতে পেল পঞ্চা। ‘কাকা, আজকে তোমাদের বস্যা হব্যে না গো’, বিপিনের ব্যাটার গলা শোনা যায়, ‘রূপা’দা আসছ্যে’। পঞ্চা’রা আপত্তি করে না, করতে পারেও না। শুধু ভুরুক করে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, ‘রূপা’’ও কী পরীক্ষা দিছ্যে?’ ছোঁড়া গুলো খুব ব্যস্ত। প্রায় সবাইকেই চেনে পঞ্চা। একসময় রূপা যেমন বাদল’দার উঠোনে গিয়ে বসতো, ওরা এখন রূপার বারান্দায় বসে। অপেক্ষা করে ‘দাদা’ কখন ডাকবে। কিন্তু কার্তিকের দোকানের সকালটা তো পঞ্চাদের। সে কথা আর বলতে পারে না। 
‘আবে, ফেস্টুনটা মের‍্যেছিস? দাদা, কিন্তু চল্যে আসবে’, কার গলা বোঝা গেল না। আর তিনচারজন ছুটে গেল ইস্কুলের গেটে। একজন চড়ে গেল উপরে, বাকীরা নীচে। বড় একটা কাপড় ওদের হাতে। আর পঞ্চাদের হাঁ করা মুখের সামনে ইস্কুলের দেয়ালের সবগুলো মুখ ঢেকে গেল ঐ বড় কাপড়টায়। 
“আগত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের শুভেচ্ছা জানাই… 
—-শ্রী রূপাতন মন্ডল, মাননীয় পঞ্চায়েত সদস্য।“  রূপা’র বড় একটা ছবি, হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে।  
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।