–গা টায় ভালো কইরে সাবান ঘষ নাই নকি?
–হুঁ, ঘষ্যেছিত। দ্যাখঅ।
মঙ্গলাকে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে নিতাই। বলিষ্ঠ বাহুর বাঁধনে ছটফট করে ওঠে হালকা শরীরের মঙ্গলা।দুই হাতের জোরে ঠেলে সরিয়ে দেয় নিতাইকে।
নিতাই অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে তুমার! অ্যামন কইরছ ক্যানে আইজ?
মঙ্গলা বিছানায় উঠে বসে। গায়ের কাপড়টা ঠিক করে পাশে ঘুমিয়ে থাকা তিন বছরের ছেলেটার দিকে তাকায়। অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। একটু ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে, শরীলটা ভাল লাইগছ্যা নাই। গা টা ক্যামন ক্যামন কততিছে।
নিতাই উদ্বিগ্ন গলায় বলে, আইজকেও বাসি ভাত খায়েছিলে ন কি? কতবার বল্যেছি বাসি ভাত খাইও না । তুমার শরীরে সয় নাই।
মঙ্গলা উত্তর দেয় না।
একটু পরে নিতাই বলে, চিনি আছে ঘরে? অ্যাল্প নুন চিনির সরবত কইরে দুব?
মঙ্গলা বারণ করে। বলে, কিছু কইরতে হবেক নাই তুমাকে। টুকচ্যা বাদেই ঠিক হইয়ে যাবেক।
নিতাইয়ের তবু দুশ্চিন্তা কমে না। উদ্বিগ্ন গলায় বলে,অ্যাকবার তবে বিরাই। মোড়ের অষুদের দকানটা ঢের রাত পর্যন্ত খুলা থাকে। তুমার জন্যে কিছু অষুদ লিয়ে আসি। রাত ভিত কিছু হল্যে কাছে কন ডাক্তার নাই।
নিতাই আর কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তি। দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমের দেশে পৌঁছে যায় নিতাই।
মঙ্গলা ঘুপচি ঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে।আজ বোধহয় পূর্ণিমা। জোছনা উঠেছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে বাইরের জগত। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও জোছনার আলো তার এক খুপরি ঘরে এসে ঢুকতে পারেনি।
অন্ধকার ঘরে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে দু’ চোখ জলে ভরে উঠতে থাকে মঙ্গলার। কান্না পাচ্ছে তার। ভীষণ কান্না। হাউ হাউ করে কেঁদে এই পৃথিবীটা ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। পারে না। খোকা জেগে যাবে। নিতাইয়ের কাঁচা ঘুম ভেঙে যাবে। মানুষটা কত ক্লান্ত।
কত স্বপ্ন নিয়ে নিতাইয়ের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল মঙ্গলা। একটা বিয়েবাড়িতে নিতাই আর তার প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতেই দুজন দুজনকে মন দিয়েছিল। দিনকয়েক পর থেকে মঙ্গলাদের বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে বসে থাকত নিতাই। চেয়ে থাকত, কখন মঙ্গলা বাইরে আসবে।মঙ্গলাও উশখুশ করত কথা বলার জন্য। স্বপ্ন দেখত নিতাইকে নিয়ে রঙিন ঘর বাঁধার।
মা মরা মঙ্গলা। সৎ মায়ের চক্ষুশূল মঙ্গলা। নিতাইয়ের এত ভালোবাসা তার ছোট্ট বুকটাকে জুড়িয়ে দিত। এমন করে,এত ভালোবেসে কেউ কখনো তার সঙ্গে কথা বলেনি। নিজেকে রাজরানী মনে হত মঙ্গলার।
একদিন মেলা দেখতে যাওয়ার নাম করে নিতাইয়ের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল মঙ্গলা। দশ টাকা দিয়ে এক কৌটো সিঁদুর আর প্লাস্টিকের শাঁখা-পলা পরিয়ে মঙ্গলাকে নিজের বৌ করে নিয়েছিল নিতাই। বলেছিল, তুমি নিশ্চিন্তি থাক। আমার ঘরে তুমার খাওয়া পরার কন অভাব হবেক নাই।
মঙ্গলা খুব খুশি হয়েছিল নিতাইয়ের কথায়। তখন কি আর জানত…..
নতুন শহরে এসে সংসার পেতেছিল ওরা দু’জন। কত স্বপ্ন চারটি চোখে! সকাল হলেই নিতাই বেরিয়ে পড়ত কাজের খোঁজে। ফিরত সেই সন্ধ্যেতে। যা রোজগার করে আনত দুজনের দিব্যি চলে যেত। মঙ্গলা বারকয়েক জিজ্ঞেস করেছিল, তুমাকে কী কী কাজ কততি হয় গো?
নিতাই প্রতিবারই হেসে বলত, উসব জান্যে তুমার কন লাব নাই। তবে সৎপথেই ট্যাকা আনি গো। ই টুকুন ভরসা রাখতি পার।
মঙ্গলা এইটুকু ভেবেই নিশ্চিন্ত ছিল, আর যাই হোক, মানুষটা খারাপ নয়। সৎপথে তো চলে।
দেখতে দেখতে দুটো বছর পার হল। মা হল মঙ্গলা। খোকা আসার পর সংসারের খরচ বাড়ল। ঘরে বসে বিড়ি বাঁধার কাজ করতে শুরু করেছিল মঙ্গলা। সেই সময়ে সুধা দিদির সঙ্গে আলাপ।
একটু দূরেই বাজার। সেখানে টেলারিংয়ের দোকান আছে সুধাদিদির। অনেক মেয়ে কাজ করে দোকানে। মঙ্গলাও ইদানিং কিছু কিছু কাজ শিখেছে। হেম সেলাই, বোতাম ঘর বাঁধা এসব টুকটাক কাজ করে কিছু টাকা হাতে আসে। কাটিংয়ের কাজও শুরু করেছে। আজকাল স্বপ্ন দেখে মঙ্গলা—-নিজের একটা সেলাই মেশিন… একটা টেলারি়ংয়ের দোকান…..
অন্যদিন অর্ডারি মালগুলো নিতে লোক পাঠায় সুধাদিদি। আজ কেউ আসেনি বলে সব কাজ গুছিয়ে মঙ্গলা নিজেই পৌঁছে দিতে গিয়েছিল । কত বড় বাড়ি! মঙ্গলা অবাক হয়ে দেখছিল। এত বড় ঘরের মেয়ে। তবু এতটুকু অহঙ্কার নেই সুধাদিদির। মঙ্গলাকে উপরের ঘরে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে এক প্লেট মিষ্টি খেতে দিয়েছিল। খুব লজ্জা পাচ্ছিল মঙ্গলা। দিদি জোর করে সব মিষ্টি খাইয়েছিল। ছেলেটার হাতে একটা নতুন একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ওকে কিছু কিনে দিও মঙ্গলা।
বেরিয়ে আসার সময় একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে ঠেকতেই মঙ্গলা বলল, ইটা কিসের গন্ধ দিদি? দমে খারাপ গন্ধ।
সুধাদিদি বলল, আর বলো কেন, সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কার হচ্ছে ওই যে।
দোতলার বারান্দা থেকে নিচের বাগানে চোখ রেখে চমকে উঠেছিল মঙ্গলা।
নিতাই!
সেপটিক ট্যাঙ্কের সেই নরকে মাখামাখি হয়ে বালতি করে কালো পিচের মতো নোংরা বাইরে থাকা একজনের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে নিতাই!
সেই দৃশ্য দেখে গা গুলিয়ে উঠেছিল মঙ্গলার। কোনমতে পালিয়ে এসেছিল সুধাদিদির বাড়ি থেকে। বাড়ি ফিরে এসে হড়হড় করে বমি করেছিল। উঠে এসেছিল সুধাদিদির এত ভালোবেসে খাওয়ানো মিষ্টিগুলো।
সন্ধ্যেবেলা কাজ থেকে ফেরার আগে নিতাই স্নান সেরে ঘর ঢোকে। আজকেও তার অন্যথা হয়নি। তবু রাতের বেলা মঙ্গলাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে যাওয়ার সময় মঙ্গলার নাকে সুধাদিদির ঘরের সেই পচা গন্ধটা যেন ঘুরে ফিরে আসছিল। গা ঘিন ঘিন করে উঠেছিল মঙ্গলার।
অনেক রাত হয়ে গেছে। চুপচাপ বসে আছে মঙ্গলা। পাশে শুয়ে থাকা নিতাইয়ের হাল্কা নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঘুমন্ত নিতাইয়ের মুখের দিকে তাকায় মঙ্গলা। আবছা আলো নিতাইয়ের মুখের উপর। আহা বেচারা! ঘুমে কাদা হয়ে আছে মানুষটা। মঙ্গলাকে সুখে রাখবে বলেই তো এত কষ্ট করে। এত ভালোবাসা যে তাকে কেউ কখনো দেয়নি। মানুষটাকে একবার আদর করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু সেই গন্ধটা মনে পড়ে গেল। ফের গুলিয়ে উঠল গা টা।
খোকার জন্য আনা সুগন্ধি পাউডারটা নিতাইয়ের সারা শরীরে ছড়িয়ে দেবে ভাবল। পরক্ষনেই মনে হল, না থাক। জেগে উঠবে মানুষটা।
নিতাইয়ের মাথার উপর ঝুঁকে গালে মুখে হাত বোলালো মঙ্গলা। একটা আশ্চর্য মায়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে বুকের ভেতর। একটা ভীষণ কষ্টও। দু’ চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মঙ্গলা।
ঘুম ভেঙে যায় নিতাইয়ের। অবাক হয়ে মঙ্গলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কী হইয়েছে সোনা! তুমি কাঁইদছ ক্যানে?
মঙ্গলার কান্নার বেগ বাড়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমারে উ কাজ কইরতে দুব নাই। একটা মিশিন কিইনব। অনেক খাইটব আমি। এত নরক ঘাইটতে দুব নাই তুমাকে। এত নরক….
হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে মঙ্গলা।আর কোনো কথা বলতে পারে না। নিতাইয়ের কাছে এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। দুই হাত দিয়ে বুকের ভেতর টেনে নেয় মঙ্গলাকে।
নিতাইয়ের বুক ভেসে যেতে থাকে মঙ্গলার প্রতি ভালোবাসায়। আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে মঙ্গলাকে। বলে, যা করি সৎ কাজ করি গো। আমি ত কুনো অন্যেয় পথে ট্যাকা আনি নাই। তবে তুমি যকন বারণ কইরেছ, উ কাজ আর কইরব নাই আমি।
মঙ্গলার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,তুমি এত কান্দ্যনা। তুমার চখের জল আমি সইতে লারি সোনা।
নিতাই আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে মঙ্গলাকে। মঙ্গলা ছোট্ট শরীর মিশে যেতে থাকে নিতাইয়ের বলিষ্ঠ বুকের মাঝে।
নাহ্, নিতাইয়ের গায়ের সেই খারাপ গন্ধ আর পাচ্ছে না মঙ্গলা। খোকার পাউডারের সেই মিষ্টি গন্ধ এখন যেন তাদের দুজনকে ঘিরে রেখেছে।