আমি অপর্ণা দি কে চিনি; জানি ওর গল্প । খুব ছোট বেলা থেকে লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল । বিখ্যাত বিখ্যাত সব লেখকের বই পড়তে । ছোট বয়স থেকে পড়ত বড়দের উপন্যাস ও । লাইব্রেরি থেকে হোক বা কারো কাছে চেয়ে চিন্তে । বাবা সরকারি কর্মচারী ছিলেন । তখনকার দিনের সামান্য বেতনে বই কিনে দেবার সামর্থ্য ছিল না । তাছাড়া ওনার কাছে গল্পের বই পড়া মানে বিলাসিতা ছিল ।
লেখকদের লেখা পড়তে পড়তে একদিন নিজেই লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখল ।
সেও লিখবে ; লেখক হবে !
লুকিয়ে লুকিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যেত । পয়সা জমিয়ে সে সব পত্রিকার অফিসে পাঠাত ।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে ।
বয়স যখন কুড়ি ; বিয়ে হয়ে গেল এক সরকারি চাকুরের সাথে ।
সেই সংসারের আবর্তে ঢুকে গেল অপর্ণা দি । শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী সন্তান নিয়ে ভরা সংসার তার ।
একমাত্র কন্যা সন্তান কে খাওয়ানো পড়াশোনা শেখানো স্কুলে নিয়ে যাওয়া গান শিখতে নিয়ে যাওয়া ড্রইং শিখতে নিয়ে যাওয়া — একা হাতে সবটা সামলানো ! তারপর শ্বশুর মশাই শাশুড়ি মায়ের সেবা করা । রাতে স্বামী কে সঙ্গ দেওয়া ।
একটা মেশিনে পরিণত হয়ে গেল অপর্ণা দি ।
নিজের দিকে খেয়াল করার সময় নেই ।
তারপর বহু কাল কেটে গেল ।
শ্বশুর মশাই শাশুড়ি মা গত হলেন । স্বামীর অফিসের কাজে বাইরের ট্যুর বেড়ে গেল । একমাত্র মেয়ে অহনার ও ডানা গজিয়ে গেল । সে এখন একা একা সব জায়গায় যেতে শিখে গেছে । মা কে আর দরকার পরে না ।
ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে অপর্ণা দি ।
স্বামী অফিসের কাজে বাইরে । মেয়ে হস্টেলে । নির্জন নিঃসঙ্গ দুপুরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে অপর্ণা — একজন শ্বেত শুভ্র বস্ত্র পরিহিত বৃদ্ধ একটা লাল ভেলভেটের কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া বাঁধানো বই বাড়িয়ে ধরেছে তার দিকে ।
সূর্য অস্তাচলে । চারিদিকে একটা লাল আলো চুয়ে চুয়ে পরছিল সামনের দালান গুলোর গা বেয়ে । মায়াবী দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে চারি দিকটা ।
অপর্ণা দি ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে এসে বসল । ব্যালকনির সামনে একটা নিম গাছ । প্রায় মেয়ের বয়সী ।
ঘরে যখন কেউ কথা বলার থাকে না ; তখন এই গাছের সাথে কথা বলে অপর্ণা দি । নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব ওদের । আর সবার মতো এই গাছ বন্ধু অপর্ণা দি কে কখনো জাজ করে না ; বোঝে।
আজও অনেক খন বন্ধুর সাথে কথা বলল অপর্ণা দি ।
গাছ বন্ধু বলল — রাত হল ; ঘুমাতে চললাম । কাল আবার দেখা হয়ে ।
অপর্ণা দি উঠল না; ঠায় বসে রইল বেতের চেয়ারে ।
সামনে আজকের অর্থাৎ রবিবারের পেপার টা পড়ে রয়েছে অযত্নে । পেপার ওদের ঘরে আসে বহু দিন ধরে । কিন্তু খুলে দেখার সময় হয় না কোনো দিন ।
কিন্তু আজ নিঃসঙ্গতা কাটাতে পেপার খুলে বসল অপর্ণা দি । তারপর পাতার পর পাতা চোখ বোলাতে লাগলো ।
এ ভাবেই রবিবারের পাতায় গল্প টা এসে পড়ল চোখের সামনে । গোগ্রাসে গিলতে লাগলো গল্প টা । কী সুন্দর গল্প ! লেখক মেয়ে টার মনের মধ্যে ঢুকল কি করে ! সংসারে অবহেলিত নিঃসঙ্গ কৃষ্ণার হাতে বই ধরিয়ে দিল লেখক । বই পড়ে কৃষ্ণা উৎসাহিত হল । নায়িকা কৃষ্ণা সংসারের সবার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ছিল । কিন্তু এই বই ফিরিয়ে এনে দিল বিশ্বাস ; বই এনে দিল ভালোবাসা ; বই খুঁজে দিল হারিয়ে যাওয়া আলোর উৎস ; বই শিখিয়ে দিল কি করে পিছন দিকে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয় । বই এনে দিল মুক্তি আর স্বাধীনতা ।
যে কৃষ্ণা একদিন আত্মহত্যা করার কথা ভাবত ; সে আজ নিজেই গল্প লিখছে !
গল্প টা পড়ে অনেক খন গুম হয়ে বসে রইল ।
তারপর পেপার টা গুটিয়ে রাখার সময় দেখল এই লেখকের একটা গল্পের বই এর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে । বই টা পড়ে দেখার খুব ইচ্ছে হল ।
স্থানীয় লাইব্রেরি তে আমি প্রায় যাই । বই নিই পড়ি ; আবার ফেরত দিয়ে পছন্দ মতো অন্য বই নিয়ে আসি ।
আজ লাইব্রেরি নয় । দোকানে যাব ; আমার প্রিয়তম বিখ্যাত লেখক বিকাশ রঞ্জন চৌধুরী মহাশয়ের লেখা একটা গল্পের বই বেড়িয়েছে । সে টা কিনতে । এই লেখকের কোনো বই আমি ছাড়ি না । বাজারে বেরোন মাত্র হট কেকের মতো সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যায় । তাই আমি আর ঝুঁকি না নিয়ে চললাম দোকানে বই টা কেনার জন্য ।
আমি সামান্য লেখা লেখি করি । লিটল ম্যাগাজিনে কয়েক টা গল্প কবিতা বেড়িয়েছে । চেষ্টা করেছি খুব।
সত্যি কথা বলতে ওনাকেই আমি গুরু মেনেছি । ওনাকে আমি অনুসরণ করি । শিখছি ওনার কাছ থেকে ।
বুকস্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি । দোকানদার সুকান্ত দা বই টা আমার সামনে বাড়িয়ে দিল । বই টা ধরার আগেই দেখি আমার পাশে দাঁড়ান ভদ্রমহিলা বই টা প্রায় কেড়ে নিলেন ।
আমি আমতা আমতা করে বললাম — এটা আমার – – – – – ।
ভদ্রমহিলা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন — হ্যাঁ , মানে এই বই টাই আমি চাইছিলাম ।
সুকান্ত দা অবাক হয়ে বলল — কতখন ধরে ওনাকে আমি বইএর নাম জিজ্ঞাসা করছি ; কিছুতেই মনে করতে পারছেন না কি বই কিনবেন !
— ঠিক আছে ; এই বই আমাকে আর একটা দিন ; তাহলেই হবে ।
— দিদি আপনি তো জানেন এই লেখকের বই বেরলেই হট কেকের মতো সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যায় । সরি দিদি , বই টা আউট অফ মার্কেট । আবার প্রিন্ট হবে ; তবে আপনি পাবেন । কথা দিলাম — আপনার জন্য একটা বই রেখে দেব ।
আমার মাথায় তখন আর কিছুই ঢুকছে না । পাশের মহিলার ওপর খুব রাগ হল ।
তাকালাম ওনার দিকে । দেখলাম লেখক বিকাশ রঞ্জন চৌধুরীর লেখা বই উনি দু হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে আছেন ।
কেমন একটা মায়া হল । আমি ওনার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন — শোনো না; বই টা তুমি নাও। পড়ে আমাকে দিও তাহলেই হবে ।
একটু অবাক হলাম ! ওনাকে আমি চিনি না ! তাহলে- – – – – ।
চুপ করে আছি দেখে উনি বললেন — ‘ তুমি ‘ করে বললাম ; রাগ করলেন ?
— না না সে কি ; রাগ করব কেন ! আপনি আমার থেকে বড় ; ‘ তুমি ‘ বললে ক্ষতি নেই ।
— আমি তোমার দিদির মতো । বলো !
মাথা নাড়ালম ।
মূহুর্তে উনি আমাকে আপন করে নিলেন।আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।অসমবয়সী।
উনি বড় ; তাই বই টা কেনার অধিকার উনিই নিলেন । কিন্তু আগে পড়তে দিলেন আমাকে।
আমার প্রিয় লেখক বিকাশ রঞ্জন চৌধুরীর উপন্যাস “সেই তুমি এলে” এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম । খুব ভালো একটা উপন্যাস !
অসলে উনি ; মা বোন বউ মেয়ের ভিতরে ঢুকে হাতরে হাতরে একটা একেকটা আবেগ সযত্নে তুলে আনতে পারেন । তারপর বিছিয়ে দেন সবার সামনে । তাই বোধ হয় আমার মতো মেয়েরা ই ওর প্রধান পাঠক ।
দরজার সামনে গিয়ে নাম টা মিলিয়ে নিলাম” অপর্না মিত্র ” কলিং বেল টেপার আগেই দরজা খুলে গেল ।
— এসো এসো;আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি ।
— আপনি কি করে জানলেন আমি আজই আসব !
— মন বলছিল । জানো !
আমি তাকিয়ে রইলাম!বেশি দিনের তো চেনা নই !
ভেতরে ঢুকে সোফার ওপর গুছিয়ে বসলাম । তারপর বই টা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম ।
বই টা হাতে নিয়ে বলল — খুব ভালো না !
মাথা নাড়লাম।
সে দিন অনেক কথা হল দু জনের মধ্যে ।
এত দিন সংসারের মধ্যে ডুবে ছিলেন । কত নতুন নতুন লেখক বাজারে এসেছেন ; তারা কত সুন্দর সুন্দর বই লিখছেন । উনি কিচ্ছু জানেন না । আক্ষেপ করে বলল — কত মূল্যবান সময় তার জীবন থেকে চলে গেল । কিছু করতে পারলেন না ।
এক সময় লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ; তাও বলল ।
আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হয়ে গেল । দুই অসময়সি বন্ধু ডুবে গেল দুজনার মধ্যে ।
আমরা ‘ তুমি থেকে তুই আর আপনি থেকে তুমি ‘ হয়ে গেলাম ।
প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে দেখা হতে লাগল ।
একদিন অপর্ণা দি আমাকে ওর সেই স্বপ্নের কথা টা বলল ।
— বলতো সেই সাদা পোশাকে লোকটা আসলে কে !
আমি বললাম — তোমার আবেগ । তোমার অবচেতন মনের ইচ্ছা । তোমাকে জাগিয়ে দিয়ে গেল । বই টা আসলে প্রতীক মাত্র ।
অপর্ণা দির ভেতরে লুকিয়ে থাকা লেখক সত্ত্বাকে বেড় করে আনার চেষ্টায় লেগে গেলাম । খাতা কলম সব জোগার করে ছিলাম । বিভিন্ন লেখকের বই জোগান দিল সুকান্ত দা ।
অপর্না দি লিখল ।
অপর্না দি আর আমার একটা করে লেখা গল্প লিটল ম্যাগাজিন ‘নতুন সূর্য’তে পাঠিয়ে দিলাম ।
অপর্না দি র লেখা ছোট গল্প ” শেষ থেকে শুরু ” আর আমার গল্প টাও পত্রিকায় নির্বাচিত হল।
আমরা দুজনেই খুব আনন্দিত হলাম । ঠিক হল আগামী কাল সন্ধ্যায় অপর্না দি একটা পার্টি দেবে । থাকব আমি অপর্না দি আর – – – – আর সুকান্ত দা । আমাদের সব চাইতে বড় সমর্থক ।