চৈত্র সংক্রান্তি | বিকেলে ফেসবুকে উঁকিঝুকি মারছি | হঠাৎ একটা পোস্ট চোখে পড়ল | পোস্টটা এইরূপ – ” আজ ( ১৩.৪.১৮ ) মঞ্জু ভট্টাচার্য নামক এক বৃদ্ধার জীবনাবসান হয়েছে একটি বৃদ্ধাশ্রমে | ছেলে মস্ত বড় ডাক্তার | কলকাতায় গোটা দুই ফ্ল্যাট | সেণ্ট্রাল এসি সহ | গত পরশু (১১.৪.১৮ ) শরীর খারাপ শুনে সস্ত্রীক দেখতে আসেন | ডাক্তার হিসেবে বুঝতে পারেন মায়ের আয়ু আর বেশিদিন নেই | বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষকে বলে যান , আমাকে আর বিরক্ত করবেন না | মারা যাওয়ার পর আপনারাই যা করার করবেন | আজ মারা যাওয়ার পর ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার একই উক্তি – আপনারা যা করার করুন | ডাক্তারি করে ছেলের সময় খুব কম | মাকে নিজের কাছে রাখাতো দূরের কথা , বৃদ্ধাশ্রমে মারা যাওয়ার পরও দেখতে আসার সময় নেই |
….এই মুহূর্তে পাওয়া খবর বার্ণিং ঘাটের নিয়মানুযায়ী সই সাবুদের জন্য ছেলে কাল আসতে পারেন | তাই দেহ আপাতত পিস হেভেনে | ”
ডাক্তার ছেলের নাম দেওয়া আছে -শিবাজী ভট্টাচার্য |
দিন কয়েক আগে বিকেলে টিউশনি বের হচ্ছি , মা বললেন , ” ….আজ মাকে মেরেছে | ” ছেলেটা ইলেভেনে পড়ে | বাবা কিছুদিন হল গত হয়েছেন | অবশ্য যখন ছিলেন তখন যে খুব ভরসার ছিলেন এমনটা নয় | যাইহোক মাকে শুধু বললাম , ” ছেলেটা খুব অন্যায় করেছে | ভগবান ওকে শাস্তি দিবে | ” মাকে তখন সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আমার আর কীই বা করার ছিল |
উপরের ঘটনা দুটো প্রমাণ করে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে !
দুই পুত্রই যথেষ্ট অন্যায় করেছে ; তা সত্ত্বে বলব এতে পিতামাতার ভূমিকাও যথেষ্ট আছে | ” শ্রী শ্রী ভাগবত মহাপুরানের ” একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে | যমুনার সংলগ্ন একটি হ্রদ ছিল | সেটি ছিল কালিয় নামে এক বিষধর সাপের আবাসভূমি | কালিয়ের বিষেয় প্রভাব এতটাই বেশি যে তার জল সর্বদাই টগবগ করে ফুটত | শুধু তাই নয় ওই হ্রদের ওপর দিয়ে কোনো পাখি উড়ে গেলে সেই তাপে দগ্ধ হয়ে তার মধ্যে পড়ে যেত | সেই হ্রদের বিষাক্ত জলের ঢেউ এবং তার উপর দিয়ে বয়ে আসা বায়ুর দ্বারা বাহিত জলকণার স্পর্শে তীরবর্তী গাছপালা , পশুপাখি সকলেই মারা পড়ত |
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এর প্রতিকার করার মনোবাসনা করলেন | কারণ এ ব্যাপারে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ | -পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম | ১ এই জন্য তিনি একদিন একটি কদম গাছ থেকে সেই বিষাক্ত হ্রদের জলে লাফিয়ে পড়লেন | কালিয় নাগকে তার খল স্বভাবের জন্য যথোচিত শিক্ষা দিলেন | আমরা এর বিস্তারিত বিবরণে যাব না | কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায় – কালিয় স্বজ্ঞানে কেন প্রভুর উপর কোপন স্বভাব প্রদর্শন করলেন ? ভাগবতে এর উত্তর দেওয়া হয়েছে – ” ভবান হি কারণং তত্র সর্বজ্ঞো জগদীশ্বরঃ | / অনুগ্রহং নিগ্রহং বা মনস্য তদ্ বিধেহি নঃ | ” ২ আমাদের এই ক্রোধন স্বভাবের জন্য আপনিই দায়ী | কারণ – ” ত্বয়া সৃষ্টমিদং বিশ্বং ধাতর্গুণবিসর্জনম্ | / নানা স্বভাব বীর্যৌজোযোনিবীজাশয়াকৃতি | ” ৩ আপনিই তো গুণভেদে এই জগতে নানা প্রকারের স্বভাব , বীর্য , বল , যোনি , বীজ , চিত্ত এবং আকৃতি নির্মাণ করেছেন | সুতরাং আপনি আমাকে যা দিয়েছেন তাই আমি আপনাকে নিবেদন করছি | এতে আমার দোষ কোথায় ? তদ্রুপ পিতামাতার কাছ থেকে সন্তান যেরূপ শিক্ষা লাভ করবে তদনুরূপ শিক্ষাই মা বাবাকে ফেরত দেবে | এতে আশ্চর্য হবার কী আছে ?
আজকের মা বাবারা সন্তানকে ডাক্তার করছে , ইঞ্জিনিয়ার করছে , মানুষ করতে পারছে না | আপনি সমাজটার দিকে তাকান , দেখবেন সমাজটা আসুরী সম্পদে ভরে গেছে | ” দম্ভো দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেব চ / অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম || ” ৪ মানুষ , মানুষ না হলে দম্ভ , দর্প , অভিমান , ক্রোধ , নিষ্ঠুরতা , অজ্ঞান তাকে ঘিরে ধরবেই | মানুষকে মানুষ হবার কথা আবার বলা কেন ? গোরু জন্মেই গোরু , কুকুর জন্মেই কুকুর , ছাগল জন্মেই ছাগল | কিন্তু মানুষ জন্মেই মানুষ হয় না | তাকে মানুষ হতে হয় | মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয় | যারা তাকে মানুষ করবে তারা নিজেরাই যদি ” দম্ভমানমদাম্বিতা ” হয় তাহলে সন্তান আর মানুষ হবে না | তাহলে মা বাবার বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না |
সংক্রান্তির বিকেলে বসে এর শিক্ষক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল যে সব পরিবারে দু’বেলা প্রার্থনা হয় তাদের ঘরের ছেলের সহজে অনৈতিক হবে না | ভোরে উঠে পরিবারের সকল সদ্যস মিলে একটু নামকীর্ত্তন , সদগ্রন্থ পাঠ , মন্ত্রোচারণ , প্রার্থনা করে নিজের নিজের কাজে চলে গেল | সন্ধ্যাতেও আবার সৎ সঙ্গ করল , তারা মার্জিত হবেই হবে |
অথচ আজকে ধনী , উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর দিকে তাকান , বিশেষ করে শহরাঞ্চলে দেখবেন গৃহকর্তা গিন্নিকে নিয়ে সন্ধ্যেবেলায় পার্টিতে যাচ্ছেন | মা বাবা যদি পার্টিতে যান ছেলে মেয়ে মানুষ হবে ? ” সংসারের ইতিউতি ” বলে একটা কবিতায় আমি লিখেছি –
বাবা যায় পার্টিতে
মা যায় নাচিতে
ছেলে করে উৎপাত
মেয়ে পড়ে প’ গ্রাফ |
চোখ কান খাড়া রাখলে এমন চিত্র খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবে না | পার্টিতে যাওয়া মা বাবার ছেলে শুভ ভবিষ্যতে কেমন হবে জানেন –
” কিন্তু , শুভ আজ গোধূলির আলো হতে চায় না |
প্রতিশ্রুতি নয় , সে এখন প্রতিশ্রুত
তাকে আরো বড়ো হতে হবে | ”
( কবিতা – প্রতিশ্রুত )
ছেলে বা মেয়ে যদি দেখে মা ভিখারী এলে কাউকে ফেরান না , তাহলে ” অতিথিদেবো ভব ‘ সংস্কারটা স্বাভাবিক ভাবেই সন্তানের মধ্যে এসে যাবে | কিন্তু মা যদি বলে হাতজোড়া , তাহলে সন্তানরাও মায়ের বার্ধক্যকালে বলবে হাতজোড়া | যার জলজ্যান্ত প্রমাণ আজকের বৃদ্ধাশ্রমগুলো |
সন্তান যদি দেখে বাবা ভোরে ঘুম থেকে উঠে দাদু ঠাকুমাকে প্রণাম করছে অথবা দু’বেলা স্বর্গীয় দাদু ঠাকুমার ফটোতে প্রণাম করছে , ধুপ দিচ্ছে তাহলে সন্তানের মধ্যে পিতৃমাতৃভক্তির সংস্কারটা আপনা থেকেই এসে যাবে | আলাদা করে ” পিতৃদেবো ভব ” ,” মাতৃদেবো ভব ” শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই | কিন্তু যদি বিপরীত আচরণ দেখে তাহলে তাকে হাজার বার শিক্ষে দেওয়া হোক মাতা পিতাকে দেবতার মতো ভক্তি করবে , কোনো কাজে আসবে না |
প্রতিবেশি কিছু একটা চাইতে এলে ঘরে থাকা সত্ত্বেও মা সরাসরি নেই বলে দিলেন অথবা বাবা কারুর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় অনেকগুলি মিথ্যে কথা বললেন | এরপরে সন্তানকে যতই শিক্ষে দেওয়া হোক – ” সদা সত্য কথা বলবে ” – কথাটা কতখানি বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় |
পিতামাতা যদি সন্তানের অন্যায় কাজ প্রশয় দেয় তাহলে কা কথা ! আমি নিজের চোখে দেখেছি একটি ইলেভেনের ছেলে মেস থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছে | সেদিন সে কৌশল করে বাসের ভাড়াটা বাঁচিয়েছে , আর তার বাবা সেজন্য তাকে বাহবা দিল | কারণ ছেলে নাকি এতদিনে একটু চালাক চতুর হয়েছে | সেদিনই বুঝলাম বাবা তার কচি ছেলের মাথাটি চিবিয়ে খেতে শুরু করেছেন | ” চালাকীর দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয়নি না | ” – এ স্বয়ং স্বামীজির শিক্ষা | ঠাকুরের কথাতেও আছে কাক নিজেকে খুব চালাক ভাবে কিন্তু সারাজীবন তু খেয়েই মরে | মহাপুরুষ বাক্য কখনো মিথ্যা হতে পারে না |
আপনি ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান করছেন , বিরাট তার জাকজমক , কিন্তু কোথাও ভারতীয় সংস্কারের ছোঁয়া নেই | পবিত্রতা নেই | ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে | কিন্তু প্রচলিত গতিপ্রকৃতির কথাটাই বোঝাতে চাইছি | কেক কাটা হচ্ছে | সন্তান ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভোচ্ছে | ভোজনে মাংসের ব্যবস্থা | প্রচুর উপহার | আপনার পয়সা আছে আপনি করতেই পারেন | কিন্তু এটা জেনে রাখুন এতে আপনার ছেলের কল্যাণ হবে না | মোমবাতি নিভাবেন কেন ? বরং একশো আট না হোক আটটা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালান | ঋষিদের প্রার্থনা ” তমসো মা জ্যোতির্গময় “| প্রদীপ জ্বালানো তার প্রতীকি ব্যবস্থা |
সন্তান শুধু উপহার নেবেই | কোনো আত্মীয় উপহার না দিলে আপনারও রাগ হয় | কিন্তু কেন ? বরং আপনি সন্তানের হাত দিয়ে দান করান | চিতহাত হওয়াটা মনুষ্যত্বের অপমান | মানুষের জন্ম দান নেওয়ার জন্য নয় – দান দেওয়ার জন্য | মনুষ্য জাতির ভগবান ব্রহ্মার এই নির্দেশ | বৃহদারণ্যক উপনিষদের পঞ্চম অধ্যায় , দ্বিতীয় ব্রাহ্মণে এইরূপ উল্লেখ আছে | মানুষেরা প্রজাপতিকে অনুরোধ জানালেন উপদেশ দেওয়ার জন্য | প্রজাপতি ব্রহ্মা শুধু বললেন ” দ ” | তারপর জিজ্ঞাসা করলেন , ” তোমরা এর অর্থ বুঝেছ ?” মানুষেরা বলল , “হ্যাঁ | দ মানে দান কর | ” প্রজাপতি বললেন , – যর্থাথই বুঝেছ | এখন আমরা বুঝলাম , কতটা বার্তা শিশু সন্তানের কাছে পৌঁছে দিলাম – সেটাই বড়ো কথা |
আপনি মাংসের ব্যবস্থা না করে বরং পরমান্নের ভোগ ভগবানকে নিবেদন করুন | তারপর প্রসাদ পান | আত্মীয়কেও দেন |
আপনি আয়োজনের বিলাসিতাকে একটু কেটে ছেটে যজ্ঞ করান | সমস্ত উৎসবের ফল যজ্ঞের মধ্যে দিয়ে ভগবানের চরণে নিবেদন করুন | আপনার সন্তানের আত্মীক কল্যাণ হবে | যজ্ঞ আমাদের সংস্কৃতির একটা অঙ্গ | আমার বলার উদ্দেশ্য এইমাত্র যে এককে বাদ দিয়ে শূন্যগুলোর কোনো মূল্য নেই | ধর্মকেন্দ্রিক জন্ম দিন পালন করুন | আপনার সন্তানও শিখে যাচ্ছে কোনো অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে ভগবান | কারণ ভগবান গীতায় বলছেন –
যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোসি দদাসি যৎ
যৎ তপস্যাসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম || ৫
এখানে অর্জুন উপলক্ষ্য | অর্জুনকে কেন্দ্র করে ভগবান সমগ্র জগৎবসীকেই বলছেন – তুমি যা কর্ম করো , যা আহার করো , যা হোম করো , যা দান করো , যে তপস্যা করো তা সবই আমাকে অর্পণ করো | কেন ? তাহলে আমি তোমার হৃদয়ে থাকব | – ” যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপহ্যম | “
আজকে আমাদের আধুনিক হবার মোহে এটাকে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে কিন্তু এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি |
—————————————————————
তথ্যসূত্র : ১| শ্রী শ্রী মদ্ভগবদগীতা – ৪/৮
২| শ্রীমদ্ভাগবত – ১০/১৬/ ৫৯
৩| ঐ – ১০/১৬/৫৭
৪| গীতা – ১৬/ ৪
৫| ঐ – ৯/২৭