মেহফিল -এ- কিসসা নুসরাত রীপা

টুসীর গল্প

১)
ডিসেম্বর মাস।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ফুপির বাসায় বেড়াতে এসেছে টুসী।
টুসী এবার ক্লাশ ফাইভে উঠবে। ও খুব লক্ষ্মী আর মিষ্টি মেয়ে। প্রতিবছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে আব্বু আম্মুর সাথে দেশের কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়।গত বছর ওরা সেন্টমার্টিন গিয়েছিলো। তার আগের বছর গিয়েছিলো বিরিশিরি। চিনেমাটির পাহাড় দেখতে।
আব্বু বলেছে, টুসী যতোদিন পরীক্ষায় ফার্স্ট হবে ততোদিন ওকে বার্ষিক পরীক্ষার পর বেড়াতে নিয়ে যাবেন।টুসীর বেড়াতে ভীষণ ভালো লাগে। ও তাই সারাবছর খুব মন দিয়ে পড়ে। যাতে পরীক্ষায় প্রথম হতে পারে।
টুসীরা এবার ঢাকায় মনি ফুপির বাসায় বেড়াতে এসেছে। মনি ফুপি আব্বুর কাজিন। অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলেন। এবার দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে এসেছেন। ফ্ল্যাট কিনেছেন। দেশে ফিরেই ফুপি টুসীদের এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। বেশ অনেকদিন বেড়িয়ে ফিরে যাবার সময় বারবার করে আব্বু আম্মুকে তার ওখানে বেড়াতে যেতে বলে গেছেন। আর টুসীকেও বলেছেন অনেক করে।
আব্বু আম্মুও কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু টুসীর পরীক্ষার জন্যই যা একটু দেরি হলো।
টুসীর আব্বু উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তিনি দুলালপুর সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। টুসীর আম্মুও দুলালপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
ঢাকায় টুসী আগে কখনো আসে নি। অফিসের কাজে আব্বু আম্মু কখনো এলে টুসীকে মিনু খালার বাসায় রেখে আসতেন। মিনু খালাটা ভীষণ আদর করে টুসীকে। উনার কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। একা একাই থাকেন। টুসী তার বাসায় গেলে তিনি উৎসব আয়োজন শুরু করেন। আর প্রায়ই টুসীর জন্য ওর প্রিয় খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দেন।
মনি ফুপির বাসাটা একটা এপার্টমেন্ট হাউজ। কুড়িতলা একটা বিল্ডিং এর উনিশ তলা। লিফট ছাড়া ওঠা নামা করা যায় না। বিশাল ড্রইং রুম। একটা মস্তো অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছেরা ঘুরে বেড়ায়। ফুপির মেয়ে জিনিয়া আপু এবার এ লেভেল করছে। আর ভাইয়া তানভি ভার্সিটি ভর্তির জন্য পড়াশোনা করছে। টুসীকে সবাই ভিষণ আদর করে। ভাইয়া আপু বাইরে থেকে ফেরার সময় টুসীর জন্য অনেক রকম চকলেট,বাদাম,আইসক্রীম নিয়ে আসে। আর ফুপা কিনে দিয়েছেন অনেকগুলো খেলনা আর ইয়া মস্তো একটা বিদেশি পুতুল! ফুপি দিনের বেলা মাকে সাথে নিয়ে মজার মজার বিদেশি খাবার রান্না করেন আর প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই সবাই মিলে ফুপার মস্তো কালো গাড়িতে করে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যায়। ফেরার সময় বিশাল নামি দামি কোনো রেস্টুরেন্ট এ খেয়ে দেয়ে আসে।
ঢাকায় বেড়াতে খুব ভালো লাগছে টুসীর। ন্যাশনাল মিউজিয়াম, জু,বোটানিক্যাল গার্ডেন, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর আর বঙ্গবন্ধুর যাদুঘর দেখে তো রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লো টুসী। বইতে কতো স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধের কথা আর বঙ্গবন্ধুর কথা পড়েছে। চোখের সামনে সে সব স্মৃতি!
ঢাকায় রাতের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে দারুণ লাগে ওর। বড় বড় সব বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, রঙিন ঝলমলে আলোয় শহরটাকে স্বপ্নের মতো মনে হয়।মনে মনে ভাবে, ইস্ আমরা যদি ঢাকায় থাকতাম!
২)
টুসী বাংলা মিডিয়ামে পড়ে এটা মনি ফুপির মোটেও পছন্দ নয়। তিনি আব্বু আম্মুকে খুব করে বলতে থাকেন টুসীকে ঢাকায় কোনো ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে দিতে। ফুপির সাথে ফুপাও গলা মেলান। তিনি বলেন, এখন বিশ্বায়নের যুগ।ইংলিশ ভালো না জানলে জীবনে কিসসু করা সম্ভব না ইত্যাদি ইত্যাদি আরো সব ভারি ভারি কথা। এসব বিষয় নিয়ে বড়দের কথা টুসী ঠিক বোঝে না। তবে এটা বোঝে, মনি ফুপি আর ফুপা আব্বু আম্মুকে প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছে টুসীকে ঢাকার স্কুলে ভর্তি করার ব্যাপারে।
টুসীকে বলতেই ও ঢাকায় পড়তে রাজি হয়ে গেলো। মনে মনে ঢাকার স্কুল ,পড়াশোনা এসব নিয়ে একটু একটু ভাবতে শুরু করলো। ঢাকা ওর ভালো লেগেছে। কতো বড় শহর। কতো মানুষ বাস করে এখানে। প্রতিদিন বের হচ্ছে। মার্কেটে যাচ্ছে। খাবার দোকানে যাচ্ছে, মুভি দেখছে অথচ কোনো মানুষকে দ্বিতীয়বার চোখে পড়ে নি। অার দুলালপুরে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে।
ও জানে পড়াশোনায় ওকে কেউ হারাতে পারবে না। ওর কেবল একটু ভয় হয় আব্বু আম্মুকে ছাড়া ও ঢাকায় থাকতে পারবে তো!
৩)
এক দুপুরে বাসায় একা টুসী। আম্মু আব্বু শপিং এ গেছে। ফুপিও গেছে কোথাও। বাসার অন্যরাও নেই। টুসী বেশ কিছুক্ষণ টিভি দেখলো। তারপর ঘুরে বেড়ালো এঘর ওঘর। বারান্দার টবে লাগানো ফুল গাছগুলি দেখলো কিছুক্ষণ। বুকসেল্ফে সব মোটা মোটা ইংরেজি বই। দুয়েকটা বই নামিয়ে পড়ার চেষ্টা করলো। অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়ে রেখে দিলো জায়গামতো।
সময় যেন কাটছেই না। ভাবতে লাগলো কী করা যায়। ফ্রিজ থেকে বের করে একটা স্যান্ডউইচ খেলো কয়েক কামড়।
ক্রিম কেক থেকে খানিকটা ক্রিম তুলে খেলো। তবুও ভালো লাগছে না কিছু।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। নীচে রাস্তায় চলাচল করা মানুষ আর যানবাহনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। প্রথমে মনে হলো ওগুলো সব খেলনা, পুতুল তারপর চলাচল দেখে মনে হলো শব্দহীন চলচ্চিত্র!
সেদিক থেকে দৃষ্টি ফেরালো টুসী। আশে পাশের সব বিল্ডিংগুলো যেন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্য দুপুরের শীতের হলুদ রোদ অবিরাম গলে পড়ছে তাদের গা গড়িয়ে রাস্তায় টুকরো টুকরো হয়ে। আকাশের দিকে তাকালো। শান্ত স্থির হালকা আকাশী আসমান। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে দেখছে ব্যস্ত শহর!
দুলালপুরের কথা মনে পড়লো টুসীর। পরীক্ষা শেষের এই রকম বন্ধের দিন গুলোয় হসপিটালের কম্পাউন্ডে ওদের কোয়ার্টার এর সামনে সমবয়সীরা ব্যাডমিন্টন খেলে। কখনো নিজেরা মাটি খুঁড়ে গর্ত করে চুলো বানিয়ে বনভোজন করে। স্কুলের মাঠে গিয়ে মাঝে মাঝে সবাই মিলে গল্প করে। ঘুড়ি ওড়ায়। আর মজার মজার বই পড়া তো আছেই। এছাড়া সুমিদের বাসার ছাদে বসে নিজ হাতে বরই পেড়ে নুন মরিচ মেখে খেতে খেতে সুমির নানুর কাছে গল্প শোনা কতই না মজা!
দুলালপুরের কথা মনে হতেই মন খারাপ হয়ে গেলো টুসীর। আকাশ ছোঁয়া এই বাসাটায় বন্দী বন্দী মনে হতে লাগলো নিজেকে!
৪)
রাতে খাওয়ার টেবিলে টুসীকে ঢাকার স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার কথাটা আবার তুললেন মনি ফুপি। বললেন, আমি স্কুলে কথা বলেছি। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল তানভি আর জিনিয়ার পাপার খুব ভালো বন্ধু। উনি টুসীর প্রিভিয়াস রেজাল্ট গুলো শুনে টুসীকে ভর্তি করে নিতে রাজি হয়েছেন।আর টুসী তো ঢাকায় থাকতে রাজিই। এখন তোমরা বললেই হয়।
আম্মু একটু চিন্তিত কন্ঠে বললেন, সে না হয় হলো। কিন্তু ওকে দূরে রেখে আমার থাকতে কষ্ট হবে।
ফুপি বললেন, দেখো শিরিন, আজকাল ইংলিশ মিডিয়ামে না পড়লে জীবনে দাঁড়ানো যায় না। আমার কাছে টুসীর মোটেও অযত্ন হবে না। রোজ তোমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেবো। এভাবে গ্রামের স্কুলে পড়িয়ে মেয়েটার মেধা নষ্ট কোরো না।
মনি ফুপির কথা শুনে আম্মু আমতা আমতা করতে লাগলো। টুসীর ও এখন ঢাকায় থাকার ইচ্ছে হচ্ছে না মোটেই। কিন্তু আগে রাজি হয়ে এখন রাজি নই বললে যদি সবাই ওকে ভীতু ভাবে। তাই কিছু বলতেও পারছে না মুখে। কিন্তু মনে মনে ভাবছে, ইস আম্মু যদি বলতো টুসী দুলাল পুরেই পড়বে। ঢাকায় ওকে পাঠাবো না- তাহলে বেশ হতো!
আব্বু আপনমনে ভাত মাখাচ্ছিলেন। এবার মুখ তুলে বললেন, পড়াশোনা মানে তো মানুষ হওয়া আপা। পড়াশোনা মানে দেশ আর দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শেখা। আমাদের দুলালপুরে হয়তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নেই। কিন্তু ওখানে ফসলের মাঠ আছে, নদী আছে, বিশাল খোলা আকাশ আছে আর আছে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা। মানুষ কিন্তু প্রকৃতির কাছ থেকেই প্রকৃত শিক্ষা পায়।ওখানকার মানুষগুলোর মধ্যে কৃত্রিমতা কম। আমার ইচ্ছে টুসী সাধারণ মানুষের সাথে মিশে বড় হোক। ও জীবনে কী হবে সেটা নির্ভর করবে ওর পরিশ্রম আর ইচ্ছের ওপর। কিন্তু মাটি আর মানুষের সাথে মিশতে না পারলে সবই মিছে।আমি চাই দুলালপুরে যেটুকু পড়ার সুযোগ আছে টুসী সেখানে ততটুকু পড়বে। তারপর ও ঢাকায় বা প্রয়োজনে দেশের বাইরে পড়তে যাবে। আমি চাই আমার মেয়েটার মধ্যে মাটি ও মানুষের জন্যে ভালোবাসা জন্মাক।
আব্বুর কথা শেষ হতেই ফুপা হেসে বললেন, তার মানে তুমি এখন টুসীকে ঢাকার স্কুলে ভর্তি করাবে না, তাই তো!
আব্বু ও মুখে ভাত তুলতে তুলতে বললেন হুমম। আর সন্তানদের বাবা মায়ের ভালোবাসা পাবার,কাছে পাবারও দরকার আছে। যার মাধ্যমে তাদের মধ্যে মায়া মমতার বোধ সৃষ্টি হয়।
কথা শেষ হতেই টুসী দৌড়ে এসে আব্বুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, থ্যাংক ইউ আব্বু। আমিও দুলালপুরেই এখন পড়তে চাই। আমার ক্লাসের আর পাড়ার বন্ধুদের আর স্কুলের বিশাল মাঠে খেলার মজাটা আমি হারাতে চাই না!
আর মিনু খালা? প্রশ্ন করলেন আম্মু।
টুসী হেসে বললো, ওফস প্রত্যেক শুক্রবারে মিনুখালার হাতের পোলাও গোস আর আদর খাওয়াটাও আমার চাই ই চাই —
তাহলে আর কী! তোমার যা ইচ্ছে। এখন চিংড়ির মালাইকারি টা খেয়ে দেখো এটা মিনু খালার রান্নার চেয়ে কম মজা নয়– টুসীর প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন মনি ফুপি।
নুসরাত রীপা
মোহাম্মদপুর
ঢাকা
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।