• Uncategorized
  • 0

গল্পে তরুণকুমার সরখেল

তরুণকুমার সরখেল শিশু-কিশোরদের জন্য লিখছেন প্রায় তিন দশক ধরে। ইতিমধ্যে ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন প্রায় তিন ডজন শিশুতোষ বই (গল্প, ছড়া-কবিতা, লিমেরিক ও উপন্যাস মিলিয়ে)। এছাড়া ছোটদের জন্য নির্ভেজাল একটি শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘সঞ্চিতা’র সম্পাদনা করে আসছেন ১৯৯৫ সাল থেকে। অপর একটি জনপ্রিয় শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘টুকলু’র তিনি অন্যতম সম্পাদক। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা গল্প-ছড়া ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার (রবিবাসরীয়), আনন্দমেলা (পাক্ষিক), কিশোর ভারতী, শুকতারা, চির সবুজ লেখা (শিশু কিশোর আকাদেমি), সন্দেশ, ছেলেবেলা (স্বর্ণাক্ষর প্রকাশনী), ডিঙিনৌকো (পারুল প্রকাশনী), গণশক্তি(নতুন পাতা বিভাগ) প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মান। উল্লেখযোগ্য পুরস্কার – পূর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি পুরস্কার (উলুবেড়িয়া), নির্মাল্য চ্যাটার্জী স্মৃতি পুরস্কার (কিশোর ভারতী পত্রিকা আয়োজিত), ভাস্করলাল রায় পুরস্কার (বিজ্ঞান ভিত্তিক সেরা লেখার জন্য)। এছাড়া বেশ কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিনের পুরস্কার যেমনঃ শঙ্খ পত্রিকা, বাইদ বহাল পত্রিকা, ভোরের সানাই পত্রিকা, রেণু পত্রিকা, সুতপা পত্রিকা (ঝাড়খন্ড) প্রভৃতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল – আমি পলাশ (গল্প সংকলন), অঙ্কের ভূত (গল্প সংকলন), ম্যাজিক ছাতা (গল্প সংকলন), লেজকাটা শেয়াল (গল্প সংকলন), অলৌকিক ছাতা (কিশোর উপন্যাস), সবুজ ভূতের গল্প (গল্প সংকলন), বটেশ্বর পণ্ডিতের মোহর (গল্প সংকলন) প্রভৃতি।

ভবঘুরে ও গেছো

বত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে বিশাল একটি অমলতাস গাছ ছায়া বিছিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেই গাছের ছায়ায় লম্বা হয়ে শুয়েছিল একটি লোক। রোদের তাপ বেশ কড়া। অমলতাসের হলুদ ফুলের পুরো গাছ ঢেকে গেছে। থোকা থোকা ফুল ঝাঁড়-বাতির মতো ঝুলছে। এদিকের লোকেরা এই অমলতাস গাছটাকে‘বাঁদরলেজা’ নামে ডাকে। এর কারণ হল হলুদ ফুল ঝরে গেলে গাছ থেকে বাঁদরের লেজের মতো লম্বা লম্বা ফল বের হয়। ফলগুলো এতটাই লম্বা সে গুলোকে বাঁদরের লেজের সঙ্গে তুলনা করা চলে।

হলুদ ফুলগুলো দেখতে দেখতে লোকটি ভাবল, “আচ্ছা এই গাছে এখন যদি একটা বউ কথা কও পাখি এসে বসে তাহলে সেটাকে ফুলের ভীড়ে খুঁজে পাওয়া খুব মুস্কিল হবে। কেননা বউ কথা কও পাখির সঙ্গে অমলতাস ফুলের রং মিলেমিশে এক হয়ে যাবে।”

হলুদ পাখিটা কখন গাছে এসে বসবে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল লোকটি।
কিন্তু বউ কথা কও পাখির জায়গায় গাছে পা ঝুলিয়ে বসেছে একটি সিড়িঙ্গেপনা লোক। নীচের লোকটি উপরের লোকটিকে বলল, “তুমি আবার কখন গাছে উঠে পড়লে? বেশ ভালোই গাছে চড়া অভ্যেস আছে দেখছি তোমার।”

লোকটি বলল, “গাছে চড়বার কী দরকার? আমি তো গাছেই থাকি। গাছেই আমার ঘর বাড়ি সব। আমাকে তাই ‘গেছো’ জাতীয় কিছু একটা নামে ডাকলেই চলবে।”

নীচের লোকটি বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, “সে আবার কী কথা। গাছের উপরে কি সারাদিন কেউ থাকতে পারে? খিদে-টিদেও তো পায় ? তাছাড়া ঘুম পেয়ে গেলে একেবারে পপাত ধরণীতলে । তখন ?”

“ওসব তোমার মতো মানুষদের জন্যে, আমাদের জন্য নয়। ও বলাই হযনি আমি তো এখন আর মানুষ নই। আগে ছিলাম। তখন বনমালি নামেই সকলে আমায় ডাকতো। এখন স্রেফ গেছোভূত।”

এতক্ষণ ভবঘুরে লোকটি ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে ছিল। গেছোর কথা শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর দু-চোখ ভালো করে রগড়ে আবার গাছের উপরে তাকাল।

গেছো বলল, “কী এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি তাইতো? আচ্ছা এই দেখো…” এই বলে গেছো অমলতাস ফুলের একটি ছোট্ট ডাল ধরে দোল খেতে লাগল। ডাল থেকে বেশ কিছু খুচরো ফুল নীচে পড়ল। কিন্তু অত সরু ডালে ঝুলে থাকলেও বনমালী নীচে পড়ল না। সে একটুখানি দোল খেয়ে সোজা মগডালে উঠে গেল।

ভবঘুরে দেখল আট-দশ জন লোকের একটি দল নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে।

লোকগুলো হঠা‌ৎ গাছের নীচে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই তুই এখানে কী করছিস?”

ভবঘুরে কোন কথা না বলে একবার উপরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলোও উপরে তাকাল।

ভবঘুরে বলল, “ওই যে গেছোটার সঙ্গে কথা বলছিলাম।”

লোকগুলো তাকে বদ্ধ পাগল ধরে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে গেল।

ভবঘুরে বলল, “সে তো তোমার জন্যেই। নিশ্চয়ই ওরা তোমাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু ওরা ওভাবে উত্তেজিত হয়ে কোথায় গেল?”

গেছো বলল, “ঐ যে জাতীয় সড়কের উপর একটা লোক মরে পড়ে আছে। ওরা সেখানেই গেল। লোকগুলোর ধারণা ওকে কেউ মেরে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে। আসলে লোকটার আঘাতটা লেগেছিল মাথার পিছনে।”

“কিন্তু কে আঘাত করল তাকে?” ভবঘুরে শুধালো।

“মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল যো লোকটা। তখন সবে দশটা কি সাড়ে দশটা বেজেছে। লোকটা মোবাইল নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিল যে কোন সময় পেছনে একটা লরি চলে এসেছে বুঝতেই পারেনি। এক ধাক্কায় গাড়ির নীচে পড়ে গেল। মোবাইলটা ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তার পাশে বনতুলসীর ঝোপে।”

ভবঘুরে বলল, “আহা বেচারা বেঘোরে প্রাণটা হারাল।”

কথা শেষ হতে না হতেই লোগগুলো আবার ভবঘুরের কাছে ফিরে এল।

একজন বলল, “হতে পারে এই লোকটা খুনির দলের কেউ। এখানে আগে তো দেখা যায়নি একে।”

আরেকজন বলল, “শুনেছি খুনিরা বেশ কিছুক্ষণ খুনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। এও সেরকম এখানে ঘুর ঘুর করছে।”

এরপর একটা মোটা মতো লোক ভবঘুরের জামার কলার চেপে ধরে বলল, “বল বিনোদকে কে খুন করেছে, বল?”

ভবঘুরে দেখল, “আচ্ছা ঝামেলায় পড়ে গেলাম।” সে আরো একবার গাছের উপরে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের বিনোদকে কেউ খুন করেনি। ও গাড়ির ধাক্কায় রাস্তা থেকে গড়িয়ে নীচে পড়ে গেছে। মাঝরাস্তায় ওভাবে কেউ মোবাইলে কথা বলতে বলতে হাঁটে?”

লোকগুলো সব চুপ করে গেল। মোটা লোকটা কিন্তু জামাটা সজোরে চেপেই থাকল। সে এবার বলল,   “কে বলেছ তোকে বিনোদ মোবাইলে কথা বলছিল? তুই দেখেছিস ?”

ভবঘুরে বলল, “হ্যাঁ আমি জানি ও কথা বলতে বলতে হাঁটছিল।”

লোকগুলো এবার অনেকটা নরম হল। বলল, “কিন্তু ওর মোবাইলটা তো কোথাও পাওয়া যায়নি। সেটা সুইচ অফ হয়ে আছে।”

মোটা লোকটা কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, “তুই যখন জানিস ওকে গাড়িতে ধাক্কা মেরেছে সেটা কাউকে জানালি না কেন?”

ভবঘুরে আরো একবার গেছোর দিকে তাকাল। ও দিব্যি গাছে বসে দোল খাচ্ছে। তাকে দেখে ভবঘুরে একটু সাহস পেয়ে বলল, “আমি অতশত জানিনে বাপু। রাস্তার পাশে গিয়ে দেখো বনতুলসীর ঝোপে বিনোদের মোবাইল পড়ে রয়েছে। আমি ভবঘুরে মানুষ । আমি সাতেও নেই পাঁচেও নেই।”

এ কথা শুনে দু-জন লোক সোজা ছুটল বনতুলসীর বনে। অন্যরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল। একজন বলল, “দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে লোকটা হাফ-পাগল। দেখছো না কেমন আকাশপানে তাকাচ্ছে।”

আরেকজন বলল, “হয়তো লোকটা সত্যিই নিজের চোখে সব দেখেছে। তাই তো আমাদের সব কথা বলতে পারল। পাগলদের এতে করবার কী আছে। বিনোদটার কিন্তু ঐ একটা বদঅভ্যাস ছিল। কান থেকে ফোন সরাত না।”

পুরো দলটি ভবঘুরেকে ছেড়ে দিয়ে আবার রাস্তার ওপাশে চলে গেল।

ভবঘুরের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সে এবার গাছের উপরে তাকিয়ে গেছোটাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সব ভোঁ-ভাঁ।

“গেছোটা গেল কোথায়?”

“লোকগুলো ফিরে আসার আগেই তাকে এই ভূতুড়ে জায়গা থেকে সরে পড়তে হবে।” এই বলে লোকটা দ্রুত হাঁটা শুরু করে দিল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।