• Uncategorized
  • 0

গল্পে তন্বী হালদার

ইন্দ্রজাল ইন্দ্রজাল

সভাটার সবার সামনে উবু হয়ে বসে নিবিষ্ট মনে নাক খুঁটছিল কেন্দু। কেন্দু সোরেন। বাবুগুলান কেন্দুপাতা, শালপাতার মাহাত্ম্য নিয়েই কথা কচ্ছে কিনা – নাকের গর্তে আঙ্গুল চালিয়ে কেন্দুর মাথার ভিতর চক্কর দিচ্ছিল – বাপরে বটে। কেন্দু নামের এতেক ওজন। সেই বাবু-বিবিগুলানের শুয়োর ছানার মতো তলতলে মসৃণ গোলাপী চামড়াগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল কেন্দু। একটা বাবু জুতো খুলে ঠ্যাং লম্বা করে বসে ঘাস ছেঁড়বার জন্য চারপাশ হাতড়াচ্ছিল। বাবুটার ঢপঢপে থোড় রঙের পা দুটোর দিকে চেয়ে ফিকফিক করে হাসি লাগছিল কেন্দুর। সিনেমার নায়িকা রিমকি একটু পুরোনো দিনের হলেও হারবাল স্পা থেরাপি আর হরমোন রিপ্লেসমেন্টের নিয়মিত প্রয়োগে এখনও যে কোন মুনি-ঋষির ধ্যান ভাঙিয়ে দেবে। আর সেখানে কেন্দুতো কোন ছাড়। কেন্দু তাই কুতকুতে চালসে পড়া চোখে সকলের দিকে চেয়ে ফিকফিক করে হাসছিল।
যে বাবুটার নাঙ্গা পাদুটো থোড় রঙের, সে অনেকক্ষণ ধরে কেন্দুকে খেয়াল করছিল। কেন্দুকে দেখার পর থেকে তার মাথায় একটা জিনিসই ঘুরছিল। তা হলো – ‘তথ্যচিত্র’। জঙ্গলমহলের কেন্দুকে নিয়ে একটা অসাধারণ তথ্যচিত্র হতে পারে। এদের জীবনসংগ্রাম, মূল্যবোধ, সর্বোপরি যৌথবাহিনী।
রিমকিকে কথাটা বলতে ও বলেছে – দারুণ আইডিয়া। তবে কি জানো সমীরণ, শুধু যৌথবাহিনীকে দেখালে চলবে না। মাওবাদীদের বিষয়টাও তোমাকে ফ্রন্ট লাইনে আনতে হবে। এমন জঙ্গলময় জায়গায় যৌথবাহিনীতো বেড়াতে আসেনি। কিন্তু কি প্রয়োজনে তারা এল সেটা তুমি না বোঝালে পাবলিক খাবে না। আবার মাওবাদীরা কেন এত অ্যাক্টিভ হয়ে উঠল সেটার ব্যাগ্রাউন্ডও …….।
সমীরণ চারপাশ একবার দেখে কুটুসের ঝোপটার আড়ালে রিমকিকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে একটা হামি খেয়ে ফেলেছিল। আচমকা হামিটা আপারলিপের ডানদিকে কালো তিলটার উপর পড়ে। রিমকি কপট রাগ দেখিয়েছিল – সমীরণ …
কিন্তু কেন্দুর এই ফিক্‌ ফিক্‌ করে হাসার ধরনটা আর হাতের কাছে ছেঁড়বার মতো একটা ঘাসও না পেয়ে রাগটা বশে রাখা দায় হয়ে পড়ে সমীরণের। তবু সংযত পেলব স্বরে বলে ওঠে – এই যে তোমাকে বলছি, তোমার নামতো কেন্দু, তাই না ?
কেন্দু তখন গো গো স্ট্যাচু খেলার মতো রামকিঙ্করের ভাস্কর্য।
সমীরণ আবার বলে – তোমাকেই বলছি, কেন্দুতো তুমি?
কেন্দুর হয়ে সভার আর একজন উত্তর করে – হ বাবু, এটি কেন্দুই বটে।
সমীরণ আবার জিজ্ঞাসা করে – তুমি তখন থেকে হাসছ কেন?
কে যেন ঠেলা দেয় কেন্দুকে – বাবুটো কি শুধোচ্ছে জবাব দে না কেনে?
কেন্দু সভার ভীড়ে মা মরা নিজের একমাত্র মেয়ে জবাকে খোঁজে। না জবা এই সভায় নেই। অতএব কেন্দুরও কাউকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে উবু হয়ে বসে থাকা থেকে অর্ধেকটা উঠে দাঁড়ায়। মুখটা ছুঁচোলো হয়ে ওঠে। কে যেন পেছন থেকে একটা আঙুল দিয়ে পাছায় খোঁচা দেয়। গাড়ির ব্রেক কষার মত কেন্দু খানিকটা সামনে ঝুঁকে পড়ে, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সকালে মাঠে যাওয়া হয়নি। তাই পেটের ভিতরটা ভুটভুট করে ওঠে। আর কেন্দু শাঁখ বাজানোর শব্দে পুঁ উ উ উ করে বদ গন্ধে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছেড়ে দেয়।
কেন্দুর ঠিক পিছনে যুধিষ্ঠির বসে ছিল। সে গন্ধ বাতাসে মাখামাখি হয়ে রাগে সটান উঠে দাঁড়িয়ে চোখ গোল্লাগোল্লা করে চীৎকার করে ওঠে – বাবু উটি পাদ মারিল।
সমীরণ একবার রিমকির দিকে তাকিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে ওঠে – আচ্ছা বাস্টার্ডদের পাল্লায় পড়া গেল।
নবীন এখনকার উঠতি লেখক। এই জঙ্গলমহলের জনজীবনকে সামনে থেকে একবার দেখে জম্পেশ কিছু লেখবার আশা নিয়ে এসেছে। সমীরণ যে এন.জি.ও.টা চালায়, নবীন আগে ওখানেই কাজ করতো। নবীনের এখন নবীন চোখ, মন, প্রাণ। তাই শেষ পর্যন্ত চলেই এসেছে। অগ্রজ লেখকরা তো বলেনই – ‘এক্সপেরিয়েন্স বাড়াও, এক্সপেরিয়েন্স বাড়াও’।
সত্যিই তো, বাড়িয়ে ছিল বলেই না তার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘লাজবতী কন্যা’য় নায়িকা পারুলের সঙ্গে মাসতুতো জামাইবাবু সুশীলের পরকীয়া প্রেমের বেডসীনটা অমন মারকাটারী ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিল। ফেসবুকে কম ফিটব্যাক পেয়েছে? রম্ভা নামে একটা মেয়ে লিখেছিল – আপনার উপন্যাসে পারুলের কামনাবাসনা যেন আমার কামনাবাসনা হয়ে উঠেছে। পারুলের শীৎকার যেন আমারও শীৎকার। প্লিজ একটা বিষয় শুধু আমাকে জানাবেন – আপনি কি সত্যিই অমন কোন কালো লেজ দেওয়া গোলাপী ব্রেসিয়ার শপিং কমপ্লেক্সে দেখেছেন? দেখলে প্লিজ শপিং কমপ্লেক্সটার নাম জানাবেন …………… হি হি হি।
এরপর থেকে নবীনের কোন কিছুতেই কোন কুণ্ঠা নেই। তার ভিতরে যেন ‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে’ এমন একটা ভাব। একসময় নবীন সমীরণের সঙ্গে পোস্টারের মতো সেটে থাকত। হাড়েমজ্জায় সমীরণের মেজাজ বোঝে। তাই খুব মিষ্টি করে বলে – আপনারা প্লিজ অন্য কোন বিষয় নিয়ে কথা বলবেন না। আপনারা তো জানেন কত দরকারী বিষয় নিয়ে আমরা আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। কেন্দুদা, আপনাকে সমীরণদা কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে। ঠিকঠাক উত্তর দেবেন।
কোন একটা টিভি চ্যানেলের যেন পিছন দিককার রিপোর্টার বনলতা। আগেই ফেসবুকে পরিচয় হয়েছিল নবীনের সঙ্গে। এখন এই জঙ্গলমহল অভিযানে এসে সম্পর্কটায় গুটি ধরেছে। নবীন ঈশারায় বনলতাকে মোবাইলটা নিয়ে কেন্দুর সামনে যেতে বলে। বনলতা নীল জিন্স আর লাল টাইট টপ পরে এসেছে। ঝুলুর ঝালুর চুলগুলোকে খামচি ক্লীপে আটকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালে কেন্দু কুৎকুতে চোখে আবার ফিকফিক করে হাসতে শুরু করে। সমীরণ আর ধৈর্য্য রাখতে পারেনা। ফর্সা মুখটা রাগের তাঁতে লালচে হয়ে উঠেছে। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে – এই এই তুমি তখন থেকে হাসছো কেন বলতো?
এমন প্রশ্নে কেন্দু ঘাবড়ে না গিয়ে আরও আরও ফিক ফিক করে হাসতে লাগে।
সমীরণ প্রায় দাবড়ে ওঠে – এই হাসছো কেন তুমি?
কেন্দু বেশ হেলে দুলে গলাটাকে খেলিয়ে নিয়ে বলে – বাবু তু তখন থিক্কা মাটির উপর কি হান্তরাইছিস বটে? কি খুঁজিস? ঘাস?
সমীরণ অবাক হয়ে যায়। কি আশ্চর্য লোকরে বাবা! থট রিডিং জানে নাকি! সত্যিই তো সে তখন থেকে নিজের অজান্তে ঘাস ছেঁড়বার চেষ্টাই করে যাচ্ছে। কিন্তু গম্ভীরভাবে বলে – যদি তাই হয়ও তার সঙ্গে তোমার হাসির সম্পর্ক কি?
ঘাড় নাড়ে কেন্দু – আছেক।
বনলতা মোবাইলের সুইচটা অন করে বলে – কি রকম?
কেন্দু টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে – তুরা কোন্‌ গাছের তলায় বসে আছিস বটে?
সমীরণদের দলটা সকলে একসঙ্গে উর্দ্ধমুখে তাকায়।
রিমকি বলে – এটা তো ইউক্যালিপ্টাস গাছ।
কেন্দু অভিজ্ঞের মত মাথা দোলায় – হ দিদি উটি এমন একটা গাছ বটে যিখানে থাকবে আশপাশের সব জমির জল খেয়ে লিবে। মাট্টিকে রুখাশুখা করে পাত্থর বানিয়েক দিবে। আশপাশে কোনো গাছতো হবেক লাই, এমনকি ইয়ার লিচে ঘাসও হয় না। বাঁজা গাছ।
সকলের চোখেমুখে বিস্ময়ের রামধনু রং ছড়ায়। রিমকি গালে টোল খেলিয়ে হেসে বলে – স্ট্রেঞ্জ! তাহলে জঙ্গলে এত ইউক্যালিপ্টাস গাছ কেন?
কেন্দু এখন বেশ সহজ। তাই গড়গড় করে বলতে থাকে – চোরাকারবারীগুলান শাল-সেগুনের জঙ্গল কাটি লিছে। আর বন দফতর এসে ইউক্যালিপ্টাস চারা লাগানছে। জঙ্গলমহল বাঁজা গাছের জঙ্গলে ভর্তী হয়ে যান্‌ছে।
রিমকি সমীরণ দুজনেই একসঙ্গে বলে – কেন এত গাছ থাকতে ইউক্যালিপ্টাস গাছ কেন?
কেন্দু এখন বেশ নেতানেতা গোছের ভাব দেখায়। বিজ্ঞের মত হাসে।
– বুঝলি না কেনে? আমরা হলাম গে বঞ্চিত বাঞ্চোতের দল ……।
কেন্দুর কথা শেষ হওয়ার আগে খানিক দূরে চোখ পড়ে। দেখে জবা! গত সনের টুসু পরবের মেলায় খুকরির লড়াইতে নিজের খুকরিটাকে দিয়েছিল বলে মহাজনের কাছ থেকে এই লালডুরে শাড়ি আর নগদ একশ টাকা পেয়েছিল, সেই শাড়িটা পরে দাঁড়িয়ে আছে। জবা খরদৃষ্টিতে তার বাপের দিকেই তাকিয়ে আছে। বারবার নিষেধ করেছিল – বনপার্টির লোকরা চায় না। তু এ সভায় আসবিক লাই।
কিন্তু কেন্দুর কাছে দীনু মাহাতো খবর দিয়েছিল – বাবুরা শহর থিকা চিকনাই চাল আনিছে অনেক, মশলা আনিছে, দেশী খুকরার ঝোল হবেক। মিটিনে যারা যাবেক তারা খাবে বটে।
এমন লোভ সামলাতে পারেনি কেন্দু। তাই জবাকে অমান্যি করেই চলে এসেছিল। এখন জবার চোখে চোখ পড়তেই খাওয়া ভুলে যায়। সকলের দিকে একবার তাকিয়ে চোঁচোঁ দৌড় দেয়। দৌড় দৌড় দৌড় ……………।
পুরো সভাটা যেন মুহূর্তের মধ্যে ওলোট-পালোট হয়ে যায়। রিমকি, বনলতার সামনে কেন্দুর এ হেন আচরণ যেন ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে হয় সমীরণের। রাগে গা চিড়বিড় করে। কত উঁচু জায়গা থেকে সমীরণকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এখানকার জংলী ভূতগুলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুপথে নিয়ে আসার, সন্ত্রাসবাদীদের থেকে দূরে রাখার। ধ্যাৎ কাদের সঙ্গে কি আলোচনা করবে।
বিনয় এতক্ষণ ঝিম ধরে বসেছিল। এই দলটাতে কেউ তাকে নিতে চায়নি। গান গায় বিনয়। ওর নিজস্ব একটা বাংলা ব্যান্ড আছে। বিনয়ের খুব আশা ছিল এখানে এসে আসলী হাড়িয়া খাবে। তারপর এদের গলায় কিছু খাঁটি আদিবাসী সুরের গান রেকর্ড করে নিয়ে যাবে যা তার ব্যান্ডের কাজে লাগবে। আরও একটা গোপন ইচ্ছা ছিল। বালিগঞ্জ প্লেসের ফ্ল্যাট বাড়িটায় জন্মকর্ম হওয়ার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো আদিবাসী যুবতী রমণীকে সামনাসামনি দেখেনি। সেই আশাটুকু মেটাবে। সিনেমার পর্দাতে দেখা তেলতেলে কালো চেহারার হিলহিলে আদিবাসী মেয়েদের সামনে থেকে দেখার লোভে নবীনের একটা কবিতায় সুর দিয়ে গান বানিয়ে দেবে কথাও দিতে হয়েছে বিনয়কে। নবীনের ঘুড়ির সুতো ধরেই সমীরণদার কাছে পৌঁছোনো। ওমা তা এখানে এসে আদিবাসী যুবতী দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে সব যেন সোমালিয়া থেকে এসেছে। বনলতা অবশ্য বলছিল – এরা সব জিরো ফিগার। ইস্‌ আমাদের কি প্রচন্ড ডায়েট কনশাস থাকতে হয়।
যুধিষ্ঠির হামাগুড়ি দিয়ে সমীরণের কাছে চলে আসে। ফিসফিস করে বলে – বাবু কেন্দুর বিটিটো বনপার্টির লোক বটে। হামার মনে লয় কেন্দু ওর বিটিটোকে আশপাশে কুথাও দেখেন্‌ছে। তাই ভেগে গেল বটে।
চমকে ওঠে সমীরণ – সেকি তোমরা জানো?
– না বাবু তবে হামার মনে সন্দেহ হয়। উটির চালচলন কেমন বটে। কাউকে ডরায় না। মান্‌ঝে মান্‌ঝে রাঁচিতে কাজে যান্‌ছে বলে উধাও হয়ে যায়।
সমীরণ চোখ-কান সজাগ করে চারপাশ তাকায়। তারপর কোনরকমে বলে – পুলিশকে জানাও না কেন?
যুধিষ্টিরের ছুঁচালো মুখটা ভয়ে তিরতির করে কেঁপে ওঠে – ওরা এমনিই হামাকে পুলিশের চর ভাবেক গো। তারপর সত্যি বলতে গেলে ধড়ে আর মুন্ডু থাকবে নাকো।
রিমকির ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বনলতার পাশে নবীন কি যেন গুজগুজ করছিল। এসব কথা কিছু শুনতে পায়নি। আর বিনয় শেষে হতাশ হয়ে সিগারেটের ভিতর গাজার পুর দিয়ে যে কটা এনেছিল তার দ্বিতীয়টায় টান দিয়ে চারদিকে রঙিন ফানুস দেখছে।
সমীরণ গলা খ্যাকারি দিয়ে বলে – শুনুন এখন তো অনেক বেলা হয়ে গেছে। তাই আলোচনা আর করা গেল না। রাতে তো আমরা বিডিও সাহেবের কোয়ার্টারে থাকবো। এখান থেকে মোটে পাঁচ কিলোমিটার। ওখানেই সভাটা শেষ করা যাবে।
সভার লোকগুলো এবার নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কি যেন কিচিরমিচির করা শুরু করে।
সমীরণ উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করে – এই এরা কি বলছে গো?
যুধিষ্ঠির হেসে বলে – বাবু উরা ভাবছে তুরা ওদের ভাত মান্‌সো খাওয়াবি।
সমীরণের প্রায় মুখে এসে গিয়েছিল – মগের মুলুক আর কি। কিন্তু মুখে বলে – কিন্তু যুধিষ্ঠির আমরা তো এতগুলো লোককে খাওয়ানোর মত চাল আনি নি। তাছাড়া তোমাদের কয়েকজনকে তো খাওয়াতেই হবে। তাই আমাদের কাছে যে বিস্কুট চকলেটগুলো আছে ওদের মধ্যে ভাগ করে দাও।
খুশিতে নুয়ে পড়ে যুধিষ্ঠির – বাবু হামি ঘর থিকা নুনুগুলাকে লিয়া আসবোক?
সমীরণ ঠিক বুঝতে পারে না কি বলছে লোকটা।
যুধিষ্ঠিরই বুঝিয়ে দেয় – বেটা বিটি গুলান।
রিমকি বলে – ঠিক আছে। এনোখন। এখন এই বিস্কুট লজেন্সগুলো দিয়ে দাও।
মানুষগুলো প্রথমে হুড়োহুড়ি শুরু করেছিল। কিন্তু যুধিষ্ঠির দক্ষতার সঙ্গে সবাইকে দাঁড় করিয়ে হাতে বিস্কুট লজেন্স দিয়ে নিজেদের ভাষায় কি যেন বলে। লোকগুলো খুশি মনে চলে যায়।
বিনয়ের বেশ নেশা হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে গেয়ে ওঠে – জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্য বিধাতা………। সমীরণদা প্লীজ একটু বলবেন, আজ ছাব্বিশে জানুয়ারী না তেইশে জানুয়ারী। ডেটটা ঠিক খেয়াল পড়ছে না। ওরা বিস্কুট লজেন্স খাচ্ছে তাই মনে পড়ে গেল, কিন্তু………………।
সমীরণ বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে ওঠে – এই নবীন তখন থেকে কি গুজগুজ ফুসফুস করছিস, এটাকে নিয়ে যা এখান থেকে।
সমীরণের ধমকে যুধিষ্ঠিরের প্রায় কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা।
শরীরটা খুব অবসন্ন লাগে সমীরণের। হাই তুলে বলে – এই যুধিষ্ঠির একটা ছাওয়া জায়গায় উনুন খুঁড়ে কাঠকুটো এনে দাও। আমরাই রান্না করে নেব। আর শোনো ঐ কেন্দু লোকটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে যেভাবে হোক নিয়ে আসবে একবার। এরজন্য তুমি একশো টাকা পাবে।
যুধিষ্ঠির থমকে দাঁড়িয়ে যায়।
– টাকা লিবে সে, সেকি তাহলে সত্যি চর বটে!
কেন্দু এখন সুবোধ বালক। ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ছোট্ট মাটির ঘর লাগোয়া উঠোনে তেঁতুল গাছের গুঁড়িতে ‘দ’ হয়ে বসে আছে। উলটো দিকে উঠোনে বানানো মাটির উনুনটার মুখে কাঠ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে জবা। উনুনের উপর মাটির হাঁড়িতে মোটা লাল চালের সঙ্গে টুকরো করে দেওয়া মেটে আলুর খন্ডগুলো টগবগিয়ে ফুটছে। ভাত হলেই জবা তাকে নুন, তেলের ছিঁটে আর ঝাল দিয়ে ফেন ফেন গরম ভাত খেতে দেবে। কাঠের আগুনে ফুঁ দিতে গিয়েই হোক আর যে কারণেই হোক জবার চোখ-মুখ, মাথার চুল পর্যন্ত সব তেঁতে আগুন। কাঠের ছাই বাতাসে উড়িয়ে জবার সর্ব অঙ্গে পাউডার মাখিয়ে দিচ্ছে। চোখের মণিতে আগুনের ফিনকি। মেয়েটার এমন থমথমে চেহারায় ভয় পেয়ে কেন্দু যেন আরও শান্ত হয়ে বসে আছে। ভাতের হাঁড়ির ভিতর ফ্যানটা আরও ঘন হয়ে আসলে জবা হাঁড়িটা নামিয়ে রাখে। কেন্দু একটু উসখুস করে উঠলে জবা গম্ভীর গলায় বলে – বাপু তুকে খেতে দিই?
সহাস্যে ঘাড় নাড়ে কেন্দু – হ হ। সকাল থিক্কা কুছু খাই লাই।
অ্যালুমিনিয়ামের থালায় অর্ধেকটার বেশী ভাত ঢেলে দেয় জবা। নুন, তেল, লঙ্কাও দেয়। কেন্দু হুমড়ি খেয়ে থালার উপর পড়ে হাঁৎ হাঁৎ করে ধোঁয়া ওঠা ভাতগুলো খেতে শুরু করে। জবা স্থির চোখে তাকায় বাপের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে – ঐ লোকগুলান সব কলকেতা থিকা আসিছে?
কেন্দু বিষম খেয়ে নাকমুখ দিয়ে ভাত ছিটোতে শুরু করে। জবা ঘর থেকে ছুট্টে গিয়ে ঘটিতে করে জল নিয়ে আসে। ছোটো ছেলে বিষম খেলে মা যেমন সন্তানের পিঠ থাবড়ে দেয় জবাও তেমনি কেন্দুর পিঠে থাবড় দেয়। মুখে ঘটিতে করে জল দেয়। কেন্দু হাসিমুখে তাকায় জবার দিকে। হাসে।
– তু আর জন্মে হামার মা ছিলিরা জবা। এ জন্মে বিটিটো হইছিস বটে।
জবা নরুণচেরা চোখদুটোয় বাপের দিকে ভালো করে তাকায়।
– ঐ লোকগুলান শহরে ফিরবেক কখন?
– ফিরবেক লাই তো, শুনুছি আজ রেতে উঁয়ারা বিডিও কোয়ার্টারে থাকবেক বটে।
এইবার যে কথাটা শোনবার ভয়ে কেন্দু এতক্ষণ সিঁটিয়ে ছিল, সেটাই বলে জবা – তুকে যে এত করে বারণ করলাম ঐ সভায় যাবিক লাই, তু গেলি কেনে?
এঁটো হাতেই কেন্দু দু’কান খামচে ধরে – কেরা মাঈয়ের দিব্যি আর যাবোক লাই।
এমন আত্মপক্ষ সমর্থনের পর জবারও আর কিছু বলার থাকে না। সে শুধু বলে – তু ঘরে গিয়া ঘুমা। হামার কাম আছে। যেতে লাগবেক।
কেন্দু বাধ্য ছাত্রের মত মাথা হেলায়। তারপর উঠোনে মাটির হাঁড়িতে রাখা সামান্য জলে মুখ ধুয়ে নেয়। এসব জায়গায় জলের অপর নাম জীবন। ইচ্ছামত জল খরচ কেউ করবার কথা ভাবতেও পারে না। অনেক দিন আগে কেন্দু যখন মাটি কাটার কাজ করতো তখন একটা সাইকেল অনেক কষ্ট করে কিনেছিল। এখন তার অবস্থা ভেঙেচুরে একাকার। জবা ঐ লজ্‌ঝড়ে সাইকেলটা নিয়ে দুটো মাড়ভাত খেয়ে বেড়িয়ে যায়। কেন্দু ছোপ ছোপ অন্ধকার ঘরের ভিতর চৌকিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। আর তখনই পেটের ভিতরের ভুটভুটি আবার মুচড়ে ওঠে। কেন্দু মাঠে যাওয়ার তাড়ায় ছুটে বেরিয়ে যায়।
খোলসা হয়ে কেন্দু ঘর যাবে বলেই আসছিল, মাঝপথে বোঙাবুরুর থানটার পূর্ব দিকে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা। বেটা পাঁচটা ছেলেমেয়ে ঘাড়ে বসিয়ে, পিঠে ঝুলিয়ে, কোলে নিয়ে, আর দুটো নিজেরাই বাপের দু’হাত ধরে এমনভাবে আসছে যেন যুধিষ্ঠির একটা মূর্তিমান বটবৃক্ষ আর সব ছা’গুলো বটের ঝুড়ি হয়ে যুধিষ্ঠিরের শরীর বেয়ে নেমে এসেছে। কেন্দু যুধিষ্ঠিরকে দেখে থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। যুধিষ্ঠিরও ভাবতে পারেনি বোঙাবুরু নিজে থেকে এমন সুযোগ ঘটিয়ে দেবে। কেন্দু আর কৌতূহল চাপতে পারে না। শুধোয় – কুথায় যাচ্ছিস বটে?
যুধিষ্ঠির মিটমিট করে হাসে – তু বল।
কাউকেই কিছু বলতে হয় না। যুধিষ্ঠিরের ঘাড়ে বসে থাকা ছানাটা বলে – ভাত খাইতে। খুকরির মান্‌সো দিয়া। তেল মসশার চুবুচুবু ঝোল।
কেন্দুর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। ভোজবাজির মতো একটু আগে জবার কাছে তিনবার কিরা খেয়ে বলা শপথটা বেমালুম ভুলে যায়।
যুধিষ্ঠির বলে – তু হামাদের সঙ্গে চলনা কেনে, বাবুটো তুকে যেতে বলেছে।
কেন্দুকে আর পায় কে। কেন্দু যুধিষ্ঠিরের কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে টেনে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা শুরু করে।
সমীরণদের খাওয়া হয়ে গেছে। মহুয়া গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে রিমকি বসে ছিল। সমীরণ পাশে বসে সিগারেট ধরায়। রিমকি বলে – বুঝলে এখানে দেরী করা আর ঠিক হবে না। বিডিও অফিসে চলো। ওখানেই মিটিং টিটিং যা করবার করো।
সমীরণ আফসোস করে – মিটিনটাই এখনও করা গেল না। আবার কলকাতা গিয়ে ফীডব্যাক না দিলে এনজিও-র জন্য কাজ পাবো? তারপর এরা যে কখন এসে খাবে?
নবীন আর বনলতা এসে বলে – সমীরণদা এখানে খাওয়াতে বসলে তোমাকেই লোকে ছিঁড়ে খাবে, যা যা আছে সব নিয়ে বিডিও অফিসে চলো। তাছাড়া বিডিও অফিসে আমাদের রাতে কি জুটবে কে জানে। কিছুতো রাখতে হবে।
রিমকি উঠে দাঁড়ায়। বিনয় গাড়ির ভিতর ঘুমাচ্ছিল। রিমকি যুধিষ্ঠির আর কেন্দুকে দেখে লাফিয়ে ওঠে – ঐ যে তোমার কেন্দু আর যুধিষ্ঠির চলে এসেছে।
যে দুজন আদিবাসী ছেলে এতক্ষণ জান লড়িয়ে খেটে যাচ্ছিল তারা এসে বলে – বাবুরা হামাদের শালপাতায় দিয়ে দে না, ঘরকে লিয়ে যাব।
বনলতা আর রিমকি তাই দিয়ে দেয়। যুধিষ্ঠির দাঁত বার করে দাঁড়ায়।
সমীরণ বলে – চলো আমরা বিডিও অফিসে আগে যাই। তারপর তুমি, কেন্দু, বাচ্চাগুলো খেয়ে দেয়ে নিয়ে মিটিঙে বসা যাবে।
রিমকি বলে – হ্যাঁ, ততক্ষণে লোকজনও সব এসে যাবে।
যুধিষ্ঠিরের বাচ্চাগুলো, কেন্দু লোলুপ চোখে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
বনলতা বায়না ধরে – সমীরণদা আর এখানে কোনোদিন আসা হবে কিনা জানি না। তুমি ওদের আগে পাঠিয়ে দাও। আমরা পরের ট্রিপে যাব।
ব্যাপারটা সবাই মেনে নেয়। কেন্দু যুধিষ্ঠিরের ছোটো বাচ্চাটাকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসে। যুধিষ্ঠির বাকিগুলোকে নিয়ে পিছনের সিটে। মাংসের ডেচকিটা কেন্দুর পায়ের কাছে। ভাতের হাড়ি পিছনে।
গাড়িটা দু’কিলোমিটার পর্যন্ত আসবার পরই বিস্ফোরণটা ঘটে। মাইন বিস্ফোরণ। যুধিষ্ঠির প্রাণে বেঁচে গেছে। পেছনের চারটে বাচ্চার মধ্যে কোন দুটোর যেন হাত-পা উড়ে গেছে। ড্রাইভার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। যুধিষ্ঠিরের ছোটো বাচ্চাটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে। আর কেন্দু? কেন্দুও মরে গেছে। মাথাটা ধড়ের থেকে আলাদা হয়ে ছিটকে পড়েছে। খবরের কাগজের চিত্রশিল্পীরা অবাক হয়ে গেছে ছবি তোলবার সময় – কেন্দুর মুন্ডুটার হা মুখটায় একটা মাংসের টুকরো এবং এই বিস্ফোরণের পর জবা পুরোপুরি নিখোঁজ।
পুনশ্চ – টিভির চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে দু’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রথম বিষয়, কেন্দুর মেয়ে জবা সোরেন এই ঘটনার পরে পলাতক। তাহলে সেই কি ঘটিয়েছে এই বিস্ফোরণ? দ্বিতীয় বিষয়, কেন্দুর হা মুখে যে মাংসের টুকরো পাওয়া গেছে সেটা কি কেন্দু চুরি করে খাচ্ছিল? নাকি বিস্ফোরণে মাংসের পাত্র থেকে একটা টুকরো তার হা মুখে ঢুকে গেছে ——- !
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।