গল্পে তনিমা হাজরা 

ভাড়াটে প্রেমিক 

অরেঞ্জ জুসে সিপ করতে করতে সাইটটা সার্চ করছিলেন মিসেস কৃপা আডবানী। উনি এই সাইট থেকেই নিয়মিত প্রেমিক ভাড়া করেন। সাইটটার সন্ধান ওকে প্রথম দিয়েছিল শবনম ফারিয়া একটা কিটিপার্টিতে। একটু costly হলেও এখানে বেশ হ্যান্ডসাম আর ফ্রেশ প্রেমিক ভাড়া পাওয়া যায়। এদের স্বভাবের মধ্যে সেক্স আর ইমোশনের মাত্রাটাও পার্ফেক্ট পাঞ্চ করা।  বেশ শিক্ষিত আর রুচিবোধসম্পন্ন। তাই ইন্ট্যালেকচুয়াল আড্ডাও দিব্যি জমে যায়।।
সাইট থেকে একটি ছেলেকে পছন্দ করে  বুক করে মিট করার অ্যাড্রেস ডিটেইলস দিয়ে এ্যারোমা বাথ নিতে আপার ফ্লোরে গেলেন মিসেস আডবানী। যদিও ছেলেটার বয়েস বেশ কম, কিন্তু কৃপা এখনো দারুণ ইয়াং আর অ্যাট্রাকটিভ। খুব গোপন ইচ্ছে হলেও এটাই সত্যি যে যত মেনোপজের দিকে এগোচ্ছে বয়েস ততই ইয়াং ছেলেগুলোকেই বেশি ভালো লাগছে কৃপার। থার্টির নীচে এজগ্রুপ হলে বেশ costly পড়ে যায়। তা হোক। শুধু রীতেশের Adbani group of cotton Mills ই তো নয়, তার পৈতৃক ব্যবসা K.C.logistics থেকেও কৃপার বেশ ভালো আয়।।  জীবনটা এনজয় না করে সে তো আর টিপিক্যাল মেন্টালিটির মেয়েদের মতো নষ্ট করে দিতে পারে না।।
এই  ছেলেটার সাথে যদি ফিজিক্যাল আর ইমোশনাল ম্যাচিং হয়ে যায় তাহলে মাস ছয়েকের জন্য প্রেমিক হিসেবে রেখে দেবেন তিনি। অনলাইন পেমেন্ট করে দিলেন আপতত দুমাসের।
রীতেশ আডবানী মানে তার হাসবেন্ড এসব ব্যাপারে বেশ লিবারেল।বরং সে বেশ ফ্রেন্ডলি তাকে সাজেষ্ট করে,  হাইকোয়ালিটি কন্ডোম যাতে ইউজ করে ছেলেগুলো সেটা যেন কৃপা ঠিকঠাক এ্যাসিওর করে নেয়। তবে অবশ্য এমনিতেও কৃপা আর রীতেশ এখন প্রায় সাত আট বছর ধরে ভাই-বোনই বলা যায়। বিজনেস আর সোস্যাল এক্টিভিটি সামলে যে যার জগতে ভীষণ ব্যস্ত। তাদের একমাত্র মেয়ে কানাডাতে সেটেল্ড একটি কোরিয়ান ছেলেকে বিয়ে করে। মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ।
সিডিউল অনুযায়ী Venom Cafe তে টেবল নং নাইনে ছেলেটি বসেছিল। দূর থেকে দেখে কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো বুকটা।  ধুর!  তাই আবার হয় নাকি?  তাছাড়া যার সাথে মিল পাচ্ছে সে তো এখন ষাট বছরের বৃদ্ধ। বেঁচে আছে কিনা তাও জানে না কৃপা।  শুনেছিল একটা শরনার্থী ক্যাম্পে পুলিশ এনকাউন্টারে মারা গেছে প্রায় পঁচিশেক বছর আগে।
বেওকুফ ভাবনাটাকে স্মার্টলি মন থেকে তাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করবার জন্য হাত এগিয়ে দিলো সে।
-হাই আই এ্যাম কৃপা।
–আই এ্যাম দিলশান। নাইস টু মিট ইউ।
ভাড়াটে প্রেমিকদের পরিচয় জানতে নেই। তবু দিলশানই শুরু করলো তার আগ বাড়িয়ে তার নিজের জীবনের কথা বলা।
দিলশান বলে চলে, তাকে সাতদিন বয়সের রেখে তার মা চলে গিয়েছিল একজন বিশাল বিজনেস ম্যাগনেটকে বিয়ে করে। তার বাবা একজন ডাক্তার। ছত্তিসগড় এ একটা ট্রাইব্যাল ক্যাম্পে ডাক্তারি করতে গিয়ে মারা গেছেন অনেক দিন আগে।
যেন কেমন একটা রহস্যময় মোহ ছেলেটার মধ্যে। সে যেন এক অদ্ভুত মিল দেখতে শুরু করেছে ছেলেটার আচরণ আর শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মধ্যে, কৃপার কলেজ প্রেমিক এবং ঝোঁকের বশে বিয়ে করে নেওয়া সোহেল রহমানের সাথে।
না,না, তাই আবার হয় নাকি?  এইবয়সের সব হ্যান্ডসাম আর এডুকেটেড ছেলেদের কথা বলার স্টাইল  আর আচরণ একই রকম।
বেশ মাস কয়েকের শারীরিক আর মানসিক সম্পর্ক এখন তাদের। ছেলেটা কৃপাকে অনুরোধ করেছে তাকে যেন সিডিউল টাইমের  মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে আর এক্সটেনশন করতে পারবে না।
আসলে সে যে ম্যানেজমেন্ট কোর্সটা করছে সেটা প্রায় শেষ। এটার করে সে হায়ার এডুকেশনের জন্য বিদেশে অ্যাপ্লাই করেছে ইতিমধ্যেই  আর সেই বিদেশ যাত্রা এবং পড়ার জন্য হিউজ খরচ।
যে খ্রীশ্চিয়ান অরফানেজ থেকে সে মানুষ হয়েছে সেই ট্রাষ্ট এতদিন অব্দি নানা ফান্ড তাকে জোগাড় করে দিয়েছে নিতান্তই সে দারুণ স্টুডেন্ট বলেই।
কিন্তু বিদেশে যাওয়া আর পড়ার জেদ তার অদম্য।  কিছুতেই সে হারবে না।  সে যাবেই। তখন এক বন্ধুর কাছ থেকে এই সাইটটার সন্ধান পেয়ে সে অ্যাপ্লাই করে। বড়লোক প্রায় প্রৌঢ় মহিলাদের শারীরিক আর মানসিক ক্ষিদে মিটিয়ে যদি তার বিদেশ যাত্রার পারানিটা জোগাড় হয়ে যায় তো তাতে তার কোনো  শুচিবায়ুতা নেই।  এমনিতেও সে ওইসব প্রেম ট্রেমে বিশ্বাস করে না।
গল্পটা শুনতে শুনতে গলা প্রায় শুকিয়ে আসে। কৃপা আডবানী জিজ্ঞাসা করে, হোয়াটস ইয়োর ফাদার্স নেম দিলশান?
চকোলেট ফ্লেভার্ড কন্ডোমের র‍্যাপটা  ছাড়াতে ছাড়াতে অন্যমনস্কভাবে দিলশান বলে, সোহেল রহমান। একচুয়ালি হি ইজ মাই রিয়েল গড।
চুক্তির দেড়মাস আগেই তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন কৃপা আডবানী। কারণ পরদিন ভারসোভার বিশাল বাংলোতে কৃপা আডবানীর ডেডবডি পাওয়া যায় অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন করে। আর দিলশানের এ্যাকাউন্টে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ক্রেডিট হয়েছিল K.C. logistics কোম্পানির একাউন্ট থেকে।
দিলশান কিন্তু  সত্যি জানে না তার নিজের বাবার বা মায়ের নাম। সে এটাও জানে না কে বা কারা কেন তাকে একটা ডাষ্টবিনে ফেলে গেছিল আর সেই ডাষ্টবিন থেকে কুড়িয়ে তাকে জমা দেওয়া হয়েছিল  শহরের এমন একটি অনাথ আশ্রমে।।
অরফানেজের ডাক্তারবাবু সোহেল রহমান  আর তাঁর ছেলে কবীর তার খুব কাছের মানুষ। তারা দুজনেই মানুষের সেবাতে কাজ করে চলেছেন আজও।।
বন্ধু কবীরের ডায়েরিতেই পেয়েছিল তার মা কৃপার নাম আর ডিটেইলস।। তারপর থেকে অনেক দিন ধরে সে এই সাইটটায় মহিলাটিকে পোক করে চলেছে।
কবীরকে ভারি অদ্ভুত মনে হয় দিলশানের। কি নির্লিপ্ত, কি মুক্ত। যেন সে এই জগতেই থাকে না অথচ মানুষের সামান্য বেদনা, সামান্য দুঃখ তাকে কি অসম্ভব আবেগ প্রবণ করে তোলে।
কি করে সে মাফ করে দিলো তার মাকে? কবীর  ক্ষমা করলেও দিলশান পারেনি।। নাকি দিলশানের এ এক দুরন্ত আক্রোশজনিত নির্মম প্রতিশোধ তার নাম না জানা, না ছুঁতে পারা, না খুঁজে পাওয়া বাবা আর মায়ের প্রতি, এই অবক্ষয়মন্ডিত সমাজব্যবস্থার প্রতি, এই স্বার্থপর, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভোগবিলাসে ডুবে থাকা প্রজাতির প্রতি????
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।