গল্পে উজ্জ্বল কুমার মল্লিক

হাঁড়ি-ভাঙ্গা
রমেনবাবু এ বিয়েতে মত দিতে গররাজী,কিছুতেই না; তাঁকে নিজের মেয়ের বিয়েতে অনেক গহনা, নগদ-টাকা দিতে হয়েছে।সে সবের জন্য ঋণ শোধ করতে তাঁর কত বছর লেগেছে, কেউ খোঁজ নিয়েছে? না,বলে তিনি দোতলায় উঠে গেলেন।
“বাবা, তুমি তো জানো,এখন দেশের আইনে যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া আইনতঃ দণ্ডনীয়” বলে সকাল থেকে রঞ্জন তার বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে।
রঞ্জনের মা,মালতী দেবী,ছেলের মাথায় ও গালে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,”বাবা, উনি যে কথাটা বলেছেন একটু চিন্তা কর, কতটাকা খরচ হয়েছে তোমার দিদির বিয়েতে, তোমার পড়ার খরচ মেটাতে লোকটা কোন সখ-আহ্লাদ মেটাতে পারেনি:যদি সে টাকার কিছুটা তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে দাবী করে থাকে তো আমি কোন অন্যায় দেখি না। আইন তো তোমার দিদির বিয়ের সময় ও ছিল ।কীভাবে ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে সব আদায় করেছে, তুমি তো সঙ্গে থেকে বাজার করেছ,সব জানো।যাক্ ,তোমার বাবা যা বলেছে, তোমার ভাবী শ্বশুরকে তাই বোলো,এটা এমন কিছু নয়; এটা না-হলে আমাদের মান-সম্মান থাকবে না আত্মীয়-স্বজনের কাছে, তারা বলবে,ভট্টাচার্য-মশাই কোন হা-ঘর থেকে ছেলের বৌ এনেছে!
রঞ্জন আর সীমার ভালো বাসা সেই কোন যুগ থেকে। রঞ্জন ছাত্র হিসেবে খুবই ভালো ছিল। তাই সীমার বাবা, ধনঞ্জয় চক্রবর্তী তাঁর মেয়ে,সীমাকে একটু-আধটু অঙ্ক ও ইংরেজি দেখিয়ে দেবার অনুরোধ ক’রলে সে না ব’লতে পারেনি, সীমা তখন ক্লাস নাইনে র ছাত্রী,আর রঞ্জন কলেজের পথম-বর্ষের ছাত্র।সীমারা একই পাড়ায় বাসিন্দা হলে ও তাদের সঙ্গে এর আগে ভট্টাচার্য-পরিবারের কোন ঘনিষ্টতা ঘটার সুযোগ হয়নি।কলেজ থেকে ফিরে বিকালে সীমাকে পড়াতে গিয়ে জলযোগটা ওখানেই সেরেছে সে বহুদিন।তারপর কলেজের পাঠ চুকিয়ে ইন্জিনিয়ারিং পড়তে সে বোম্বাই আই-আই টিতে ভর্তি হয়েছে। ওদিকে সীমাও স্কুলের গণ্ডী টপকিয়ে কলেজের পড়া শেষ করেছে।যোগযোগটা বিভিন্ন ভাবে
থেকে গেছে; ছুটিতে বাড়ি এলে সীমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকতোই।কিছুদিন অদেখার জন্যই হয়তো তাদের সম্পর্ক টা আরও গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে।
দেনা-পাওনার ফর্দটা শুনে ধনঞ্জয়বাবু একটু আশাহত হ’লেও ইন্জিনিয়ার সু-পাত্র হাত ছাড়া করতে চাননি বা মেয়েকে সুখী দেখার উদগ্র বাসনায় দাবী ও যথাসাধ্য পূরণ করেছেন,কিন্তু ভট্টাচার্য্য’র বিরাট “হাঁ”বন্ধ করা তাঁর সাধ্যাতীত ছিল।
ক্ষুন্ন হ’লেও পুত্রের পীড়াপীড়িতে দুই পরিবারের মধ্যে অখুশি-জনিত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।সীমা যথাসাধ্য শাশুড়ি ও ননদের মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভট্টাচার্যদের মনের জোগান পূরণ সীমার অসাধ্য থেকেছে। ফল-স্বরূপ জুটেছে হা-ঘরের মেয়ের অপবাদ, কথায়,কথায় বাক্য জ্বালা। অসহ্য হ’লেও সীমা, অসীম শক্তিতে রঞ্জনের মুখ চেয়ে তা সহ্য করে এসেছে।পুত্র,ভালোবেসে বিয়ে করেছে, এটা আর কিছু নয়,চক্রবর্তী রা ফাঁদ পেতে তাদের ভোলে-ভোলা ছেলেকে ফাঁদে ফেলেছে ইত্যাদি,ইত্যাদি,যতরকম বাক্য-বাণে জর্জরিত করা যায় আর কী!
রঞ্জন, একমাত্র পুত্র-সন্তান, না পারছে বাবা-মাকে বোঝাতে, না পারছে সীমার মানসিক যন্ত্রণার জ্বালা প্রসমিত করতে, তার অবস্থা বেকারির গামলায় ময়দার তালের
মত,যে পারছে একবার ক’রে দলে দিচ্ছে। অবসর সময়টুকুর বেশিরভাগই রঞ্জন বন্ধু-বান্ধবদের সংগে কাটায়।সংসারের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।সময় তড়তড়িয়ে এগিয়ে চলেছে।
সীমা এখন পুত্র সন্তানের জননী।নতুন প্রজন্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে দাবার ঘুঁটি ও উল্টাতে শুরু করেছে।দাদু-ঠাম্মাই শিশুর পরিচর্যা করে ,নাতি ব’লতে অজ্ঞান।।এদিকে সীমার মানসিক ভারসাম্যের গণ্ডগোল টা সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে। কখন যে ঐ অবস্থার সৃষ্টি হবে তা বোঝা দায়। এই দেখা গেল বাচ্ছা কে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে, হয়তো তারপরেই
ঘরের জিনিষপত্র ভাঙ্গছে, কখনও কখনও কাটারি নিয়ে শ্বশুর শাশুড়ি র দিকে এগিয়ে আসছে।সীমাকে একমাত্র রঞ্জন ই যা সামলাতে পারে, কিন্তু তারও তো অফিস আছে; কতদিনই বা ছুটি নেওয়া যায় অফিসে এই ক’দিন আগে একটা ভালো প্রমোশন পেয়েছে, দায়িত্ব ও বেড়েছে।কোথায় একটু সবাই মিলে আনন্দ করবে,না ভারসাম্যহীন স্ত্রী কে নিয়ে জেরবার। শহরের প্রায় সব ডাক্তার- ই একরকম দেখা নো হয়েছে, না,কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অফিসের সহকর্মীরা তাকে প্রায় রোজই জিজ্ঞাসা করে”কী কিছু উন্নতি লক্ষ্য করছো”।আচ্ছা, অমুক ডাক্তারের কাছে একবার নিয়ে যাও,যেচে তারা ফোন নং দেয়। রঞ্জন একরকম বিধ্বস্ত, কোন কিছুই সে বাকী রাখে নি।এখন ভ্যায়োলেন্টের সময় সীমাকে সামলানো দায় হ’য়ে উঠেছে।বাবা-মা,নাতির পরিচর্যায় থাকে,তাদের মনেও আনন্দ বা সুখ অস্তমিত।দিদি আর এ বাড়ি মুখো হয় না।
কোলকাতার মোটামুটি সব মনোবিদ,নার্ভের ডাক্তার দেখানো হয়েছে,অবস্থা পূর্ববৎ।শুধু ছেলেকে খাওয়বার সময়টুকু তাকে স্বভাবিক দেখায়,সে তো কয়েক ঘণ্টার জন্য, আবার যে কে সেই।বাবা-মা’র মুখখানা দেখলে রঞ্জনের দুঃখ হয়,একমাত্র ছেলের বৌ”পাগল”বা উন্মাদ। লোকে নানান কথা বলে।আত্মীয়-স্বজনেরা মুখ টিপে হাসে,হিংসায় তারা অপবাদ দিতে ছাড়ে না। তাঁদের অবস্থা রঞ্জনের চেয়ে করুণ। একদিকে উন্মাদ বৌমা অপরদিকে শিশু-নাতির পরিচর্যায় তারা নাজেহাল।
একদিন পাড়ার ই এক শ্রদ্ধেয় প্রবীন বিপদভঞ্জন রায় মহাশয়,রঞ্জন কে ডেকে বললেন “বাপু হে,তোমার অবস্থা আমি শুনেছি।তবু বলছি,আমার এক বন্ধু ডাক্তার আছে,দিনে দশটা রুগী এখনও দেখে,নার্ভের ডাক্তার, মনোবিদও বটে, তুমি একবার তার কাছে যাও,আমি বলে রাখবো।বেড়াতে যাবার নাম ক’রে বৌমাকে নিয়ে যাবে।অনেক তো ক’রলে,একবার শেষ চেষ্টা না হয় ,কর”।রঞ্জন তাঁকে শ্রদ্ধা করে,বললো,”বেশ,আপনি একটু ব’লে রাখবেন।”
দিন দেখে রঞ্জন ও সীমা, ডাক্তার শঙ্কর ব্যানার্জির চেম্বারে গেল,আগেই বিপদভঞ্জন বাবু ব্রিফ করে রেখেছেন।যাওয়ামাত্রই চেম্বারে ডেকে ডাঃ ব্যানার্জি ওদের কাছ থেকে সব শুনলেন,সীমাকে পরীক্ষা করে আগের প্রেসক্রিপশন গুলো খুঁটিয়ে দেখে রঞ্জন কে বললেন”তুমি একটু বাহিরে যাও,আমি সীমা র সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই”।রন্ঞ্জন বাহিরে গেলে ডাঃ ব্যানার্জি বললেন”দেখ,তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ,ঐ অষুধগুলো যে তুমি খাওনি ,আমি নিশ্চিত, খেলে তোমার স্থান হ’ত পাগলা গারদে, অষুধগুলো কী করেছ?”সীমা, মুচকি হেসে বললো”ওগুলো আমি কমোডে ফ্লাশ ক’রে দিতাম”।ডাঃ ব্যানার্জি বললেন ,”বুদ্ধি মতী,তা এদের তো নাস্তানাবুদ করে দিয়েছ,এবার একটু ক্ষান্ত হও”।সীমা রেগে বললো”এরা আমাকে কম জ্বালিয়ে ছে,আমি সুদ-সমেত এখন তুলছি”।ডাঃ ব্যানার্জি বললেন”তোমার স্বামী তো তোমাকে ভালোবাসেন,তবে একে কষ্ট দিচ্ছ কেন,মা?”
“বেশ,তবে আলাদা হোক”,উত্তরে বললো সীমা।
ডাঃ ব্যানার্জি বেল টিপে রঞ্জন কে ডেকে বললেন,”তুমি একটু বাহিরে অপেক্ষা কর,মা।আমি তোমার স্বামী র সংগে একটু কথা বলতে চাই”।সীমা বাহিরে গেলে ডাঃ ব্যানার্জি বললেন,”দেখ রঞ্জন, তোমার স্ত্রী ভালো হয়ে যাবে, অসুখ সে রকম কিছু নয়,আমি যেমন লিখে দিলাম, এই রকম করবে, ভালো হয়ে যাবে।মনে হয় না আর আসতে হবে, বলে প্রেসক্রিপশন টা এগিয়ে দিলেন।
রঞ্জন সেটা নিয়ে দেখে কতকগুলো অদ্ভুত সাংকেতিক বর্ণ লেখা,Sp,He,St ।ডাঃব্যানার্জি, মুচকি,মুচকি হাসলেন।”বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে বলে, বললেন Sp_separation,He_hearth andSe_stoneঅর্থাৎ বাংলায় এক কথায় হাঁড়ি-ভাঙ্গা। বাড়ি গিয়ে রান্নঘর আলাদা করার ব্যবস্থা কর।অসুখ একদম সেড়ে যাবে।আমার প্রেসক্রিপশন, রোগ একেবারে গায়েব হয়ে যাবে”।