জন্ম ১৯৭৫। অধ্যাপক। শ্রীরামপুর কলেজ। গল্পকার, ঔপন্যাসি। প্রাবন্ধিক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ -- রূপমঞ্জরীর ডায়েরি, ( উপন্যাস) , সরীসৃপের সঙ্গে ( গল্প সংংকলন), প্রমীলা পুরাণ ( সম্পাদিত গ্রন্থ) ।
বিষন্ন ছাদ
স্বপ্নটা ঘুরে ঘুরে দেখি। প্রায় দুপুরে, কোনো কোনো সময় ভোর রাতেও। আমাদের ছোটবেলার বাড়ির সেই ছাদ। স্বপ্নটা থমকে থাকে ওই ছাদেই। ছাদ থেকে দেখতে পাওয়া যেত যতটা, সেটাও।
তবে কি আমি সত্যিই মারা যাচ্ছি ? শুনেছি মারা যাবার সময় মানুষ নিজের অতীতে ফিরে যায় ? আমার সামনে শুধু এসে যায় সেই ছাদ , ছাদে হেঁটে বেড়াচ্ছি আমি আর আমার সোনাদিদি —- সেই ছাদে আমরা দুপুর কাটাচ্ছি, কখনো বিকেল গড়িয়ে সন্ধেও। আমাদের ছাদ বেয়ে চলে যাওয়া যেত যে আরেকটা ছাদে , যেখানে আড্ডা দিত সুকুমারদারা, শান্তনুদারা, সেখানে উঁকি দিত সোনাদি – লুকিয়ে –ওদের মাঝে মাঝে দিয়ে আসত তেঁতুলের আচার , ওরা দিত কিনে আনা আলুর চপ। তখন দুর্লভ মনে হত এইটুকু মেলামেশা।
—– আমাকে একবার ছাদে নিয়ে যাবি ?— নাতনিকে ডেকে বলি।
আমার মেয়ে শুনে আসে। অবাক হয়ে তাকায়। —পারবে যেতে ? তাহলে এখনই চল। বিকেল আছে।
আমি ধীরে ধীরে উঠি। মেয়ে আজকাল আমাকে নাইটি পরিয়ে রাখে। আমার চুল কেটে দিয়েছে। নিজকে দেখলে অচেনা লাগে, আয়নায় দেখলে খুব ধাক্কা খাই। মনে হয়, মরে গিয়েছে যশোমতী।
ছাদে এসে মনটা ভরে যায়। আমি একাই হাঁটি। ভুলেই যাই আমার সঙ্গে আমার মেয়ে, নাতনিও এসেছে ছাদে। বাঙ্গালোরের আবাসনের এই বিরাট ছাদটা তখন আমাদের বরানগর বাড়ির ছাদ, যে ছাদের পাশ দিয়ে অল্প লাফ দিলেই সুকুমারদাদের বাড়ির ছাদে যাওয়া যেত। আমার মনে হচ্ছিল অল্প ঝুঁকলেই আমি পৌঁছে যাব সেই ছাদে আর গিয়ে দেখব সুকুমারদারা তাস খেলছে লুকিয়ে। সোনাদি একদিন ফিসফিস করে আমাকে বলেছিল— তোর কাউকে পছন্দ হয় ওদের মধ্যে ? আমি মুখ ভেঙিয়ে বলেছিলাম—ধুর, নাহ। সোনাদি আমাকে জড়িয়ে অকারণেই হাসতে হাসতে বলেছিল—সুকুমারদাকে আমার খুব ভাল্লাগে। জানিনা কেন উত্তরটা শুনে রাগে আমার গা জ্বলে গেছিল। আমি চুপ করে সরে গেছিলাম সোনাদির হাতের নাগাল থেকে।
—- মা, অত ঝুঁকছ কেন ? মাথা ঘুরে যাবে।
—- পড়বো তো না। — আমি ফোকলা দাঁতে হাসি।
— পড়বেনা। কিন্তু অত ঝু*কোনা। তুমি আজকাল যে কী ভাবো একা, কখন থেকে ডাকছি।
— ও, ওই সোনাদির কথা মনে পড়ে খুব।
—- সোনামাসি তো মারা গেছে আজ কুড়ি বছর হল।
—- আজকাল ঘুমোলেই সোনাদির অভিমানী মুখটা ভাসছে। আমার সঙ্গে কথা বলেনি বিয়ের দিন।
—- তোমার ওপর রাগ করেছিল কেন ?
আমি চুপ করে থাকি।
—- চল মা, নীচে চল। সন্ধে হয়ে আসছে।
ঘরে ফিরেও ছাদটা যায়না মন থেকে। সোনাদির সঙ্গে কথা বলি শুধু। মনে মনে। ওর বিয়ের এক হপ্তা আগে আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিল সুকুমারদাকে দিয়ে আসার জন্য। বিয়ের আগের দিন কেঁদে বলেছিল, — সুকুমারদা চিঠি পেয়েও কিচ্ছু বলল না ? আমি মাথা নেড়েছিলাম। মুখ শুকনো করে দুঃখের অভিনয় করেছিলাম।
আসলে চিঠিটা আমি দিইনি যে।
—- কী বিড়বিড় করছ মা ?
—- সোনাদি বিশ্বাস করতে পারেনি সুকুমারদা তার চিঠি পেয়েও চুপ করে থাকবে।
—- কে সুকুমারদা ? তুমি বাবার নাম নিচ্ছ যে ? বাবা তো সোনামাসিরও বন্ধু ছিল, না ?
—- ছিল তো। বুঝতে পারিনি আগে কতটা বন্ধু ছিল রে। সোনাদি আমাদের বিয়েতেও আসেনি। তারপর তো মারাই গেল ।
আর বিড়বিড় করিনা । চুপ করে ভাবি। সোনাদির সেই না দেওয়া চিঠিটা ছাদময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ থেকে নয়। বহুদিন। সোনাদির চলে যাওয়ার খবর পেয়ে যেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে টের পেয়েছিলাম পাশের লোকটা কাঁদছে। সোনাদির সুকুমারদা। আমার মেয়ের বাবা। সেদিন থেকে একটা বিষন্ন ছাদ আমাকে ডেকে চলেছে। একটা ভুল সংশোধনের জন্য।