প্রবন্ধে অনুভা নাথ

টার্গেটে যখন মহিলা
গ্রীক মহাকাব্যিক কবি হোমারের রচিত জগৎবিখ্যাত মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসির ঘটনা পরম্পরা আবর্তিত হয় তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেনকে কেন্দ্র করে । হেলেন ছিলেন স্পার্টার রাজা মেনিলাউসের স্ত্রী। অসামান্যা রূপবতী হেলেনকে ‘টার্গেট’ করেছিলেন গ্রীসের সমৃদ্ধশালী নগরী ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস। হেলেনও অচিরেই প্যারিসের প্রেমে পড়েন,পরবর্তী সময়ে প্যারিস তার টার্গেট তথা প্রেমিকা হেলেনকে ট্রয় নগরীতে নিয়ে পালিয়ে যান,স্পার্টার রাজা ও হেলেনের স্বামী মেনিলাউস প্যারিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দশবছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ট্রয় নগরী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সমস্ত ঘটনার সূত্রপাত যাকে কেন্দ্র করে সেই ‘টার্গেট’ হেলেন কিংবদন্তী হয়ে ইতিহাসের পাতায় চির অমরত্বের মর্যাদা লাভ করে।
মহিলা টার্গেট হওয়ার ঘটনা বর্তমান সমাজেও অবিরত ধারায় ঘটে চলেছে । সমাজের বিভিন্ন স্তরে মহিলারা ঘরে,বাইরে,কর্মক্ষেত্রে টার্গেট হন,টার্গেটের স্থান,কাল,পাত্র অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয় ।
প্রথমে মহিলাদের নিজের বাড়ির সদস্যদের হাতে টার্গেট বা নিগৃহীত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা করবো। আইনের ভাষায় একে বলে Domestic violence ।নিজের বাড়ি,শ্বশুরবাড়িতে মহিলারা টার্গেট হন মূলত দুটি কারণে,যৌনতা ও পণ।
২৯শে নভেম্বর ২০১৭ সালে প্রকাশিত WHO (World Health Organisation) এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমস্ত পৃথিবীব্যাপী প্রত্যেক তিনজনের মধ্যে একজন মহিলা (৩৫%) তাদের
‘ Intimate Partner’ এর দ্বারা যৌন সম্বন্ধীয় বা শারীরিক দিক থেকে টার্গেট বা হেনস্তার শিকার হয়েছেন।ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী Domestic Violence এর শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।(৪ই আগষ্ট, ২০১৭ এইসময়)। ২৬শে অক্টোবর ২০১৬ সালে ভারত সরকার Protection of Woman from Domestic Violence Act 2005 আইন বলবৎ করে।এই আইনের অন্তর্গত কোনও মহিলাকে তার রক্তসম্পর্কের বা নিকট আত্মীয় শারীরিক, মানসিক, মৌখিক বা অর্থনৈতিকভাবে নিগ্রহ করলে তা Domestic Violence বলে গণ্য করা হবে। Domestic Violence এর অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তের সর্বাধিক একবছর পর্যন্ত জেল বা কুড়ি হাজার টাকা জরিমানা বা দুটোই হতে পারে।
ভারতীয় দন্ডবিধি ৫০৯ নং ধারা অনুযায়ী কোনও মহিলার অমর্যাদা করা,কোনও অশালীন কথা বলা,অঙ্গভঙ্গী করা,আপত্তিজনক কিছু দেখানো বা তার একান্ততাকে অতিক্রম করা অপরাধ বলে গণ্য হবে।অভিযুক্তের একবছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা আর্থিক জরিমানা বা দুটোই হতে পারে।
এবার দেখে নেওয়া যাক কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের টার্গেট হওয়ার বাস্তব চিত্র। কর্মক্ষেত্রে মহিলারা বরাবরই পুরুষ সহকর্মীদের “সফট্ টার্গেট” হয়ে এসেছেন।নারীনিগ্রহের বীজ অন্তর্নিহিত থাকে পুরুষশাসিত সমাজের গভীরে।কর্মক্ষেত্রে মহিলা কর্মীকে ‘টার্গেট’ করার বিষয়ে বহুল-চর্চিত ও উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো বিল ক্লিন্টন ও মনিকা লিউনস্কির যৌন কেলেঙ্কারি।১৯৯০ এর দশকে ৪৯ বছর বয়সী তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ও ২২ বছরের হোয়াইটহাউসের আইন শিক্ষণবীশ মনিকা লিউনস্কির যৌন সম্পর্কের ঘটনা সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার পদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে মনিকাকে যৌন সম্পর্কে প্ররোচিত করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।সেই সময় প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করেছিলেন সরকারি কর্মকর্তা পলা জোন্স।ঘটনার পরম্পরায় ক্লিন্টন ২৬শে জানুয়ারী ১৯৯৮ সালে হোয়াইটহাউসে প্রেস কন্ফারেন্সে ফার্স্ট লেডি হিলারিকে পাশে নিয়ে জোর গলায় ঘোষণা করেন “I did not have sexual relations with that woman,Miss Lewinsky”।পরবর্তীতে ওনার এই বিবৃতি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিলো,লিউনস্কি ওনার একটি নীল স্কার্ট প্রসিকিউটরকে হস্তান্তরিত করেন,সেটিতে ক্লিন্টনের শুক্ররস থেকে ডিএনএ পাওয়া যায়।এরপর, একরকম বাধ্য হয়েই ক্লিন্টন লিউনস্কির সাথে তাঁর সম্পর্ককে ” Improper Relationship” বলে মেনে নেন।শাস্তিস্বরূপ প্রেসিডেন্টের নব্বই হাজার ডলার জরিমানা হয় ও পাঁচ বছরের জন্য তাঁর কোর্ট প্রাকটিস নিষিদ্ধ করা হয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে মহিলা টার্গেটের ঘটনার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যায় এই ‘হাই প্রোফাইল’যৌন কেলেঙ্কারি।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরতা মহিলার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান ।মহিলা কর্মী টার্গেট হওয়ার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য প্রমাণ বলে গণ্য করা হয় ।বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে Human Resource (HR) ডিপার্টমেন্টে বা তৎসংশ্লিষ্ট বিভাগে যৌন হয়রানি বা নিগ্রহে ঘটনায় প্রাথমিকভাবে Internal Committee থাকে যারা কর্মক্ষেত্রে Official Code of Conduct অনুযায়ী ঘটনার পর্যবেক্ষণ করেন।অনেক ক্ষেত্র বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের স্বার্থে যৌন হয়রানির ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ার চেষ্টা করে,সেইসব ক্ষেত্রে Third Party External NGO থাকে, যারা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রানির ঘটনাকে জনসমক্ষে এনে নির্যাতিতার উপযুক্ত সুবিচারের ব্যবস্থা করেন।