শেষরাতে এসেছিল ফোনটা। “আমি আসছি, আর একটু সবুর করো খোকার মা! রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছিলে হাতের যেইখানটায় আমি খুব আদর করে দেব খন। নিরুদের দোকানে মলম পাওয়া যায় কাউকে দিয়ে যদি একটু আনিয়ে নিতে! আচ্ছা, আমিই এনে দেব। আর একটু খোকার মা আমি আসছি।” আমি কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, “পাশের গ্রামের স্কুলে চোদ্দ দিন থাকতে হবে গো তোমায়!” সে একটু মনমরা থেকে তারপর বলেছিল, “গেরামের জমিতে ফসল লাগাবো এরপর, পুকুরে মাছ দেব। আর ভিন রাজ্যে আসবো না কোনোদিন। ওই কটা দিন পরে আমরা আর কখনো আলাদা হবো না। দেখো।”
আমার ভাসুর জাকে মারতো খুব। শাশুড়ি বলতো, ” মরদ তো এই! আর ওই আমার ছোট ছেলেকে দেখো বউয়ের ভেড়া একেবারে। সবসময় কী দরদ!” আমি লজ্জায় দুঃখে লাল হয়ে যেতাম। আমার স্বামী বুক চাপড়ে বলতো, “হ্যাঁ মা, আমি বউয়ের ভেড়া, তো! আমি দাদার মতন ওকে মেরে তোমাদের
মরদ হবো না কোনোদিন। দাদা কাপুরুষ, তাই বউ ঠেঙ্গায়।”
শাশুড়ি আর ভাসুর মিলে আমার স্বামীকে আর আমাকে বের করে দিল ঘর থেকে। ওর বন্ধু হারু বললে, “বাইরে যাবি এক বছর কামাবি, ফিরে এসে এক বছর বসে খাবি। তারপর বউ ছেলে নিয়ে যাবি তুই এত কাজ জানিস! চল চল আমার সঙ্গে।”
ফিরছিল অনেক কষ্টে, যন্ত্রণায় খিদেয় কুঁকড়ে ফিরছিল সে। ফোন করছিল দুবেলা, “খোকার মা আমি আসছি।”‘ দুদিন আগে হঠাৎ অনেক খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো, “খোকার মা, আর হাঁটতে হবে না। একটা গাড়ি পেয়েছি। বলেছে আমার গেরামে পৌঁছে দেবে! আমি এখন বসেছি খোকার মা! খুব আরামে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছি। তোমার কাছে ফিরে আসছি আমি। খোকাকে বোলো, ওর জন্য আগেই কিনে রাখা জামা আমার সঙ্গেই আছে। আর তোমার লাল টুকটুকে শাড়ি। বেশ মানাবে কিন্তু তোমায়।”
শেষরাতে ফোনটা আসার পর খোকার গায়ে হাত তুলে শুয়ে কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছি খুশিতে। ভাসুরের চিৎকার শাশুড়ির কান্না এসবে ঘুমটা ভাঙলো হঠাৎ। আমার স্বামীকে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে আসা ট্রাক একসিডেন্ট করেছে অন্য আর এক ট্রাকের সঙ্গে। কোনোক্রমে বেঁচে গেছে হারু। খবরটা সেই দিয়েছে ভাসুরের ফোনে।
আমার হাতে পুড়ে যাওয়া জ্বালাটা ক্রমশ আমার সারা শরীর গ্রাস করে নিচ্ছে। খোকা কোনো কিছু না বুঝে পাড়ার বন্ধুদের বলছে, “জানিস আমার বাবা আমার জন্য নতুন জামা আনছে!” শাশুড়ি জা ভাসুর আমাকেই গালমন্দ করে যাচ্ছে। আমার অপয়ের কারণেই নাকি এই দুর্ঘটনা। আমি ডুবে যাচ্ছি ভীষণ গভীরে, একেবারে তলানিতে।
এরপর কেটে যাবে সময়। ইতিহাস হবে অসুখ। সারাদেশ জানবে… পরিযায়ী পাখি নয়, মানুষও হয়। আমার এক নতুন পরিচয় রচিত হয়ে থাকবে সমাজে…”ওই দেখো, মৃত পরিযায়ীর স্ত্রী।”