• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজ পাভেল ঘোষ

“ভটাম’দা” 😊

নির্জন চৈত্রের দুপুর।গাছ,পাখি সবাই যেন গুম মেরে আছে।ঘুম জড়ানো চোখে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি,চারটে বাজতে দশ।বিকেল হতে ঢের দেরী।পাশ ফিরে পাশ বালিশটার উপর পা তুলেছি…ব্যাস..!
মুঠোফোনের রিং টোনটা আমার কাছে আর্তনাদের মতো ঠেকলো।
এই সময়..!আবার কে জ্বালাচ্ছে?
স্ক্রিনে দেখি, ‘ভটাম দা’..!
ঘুমের শাসনে এখন ল্যাদ খাচ্ছি বলে..! দিলাম ফোনটা কেটে।
দুই পাতা সবে এক হয়েছে..আবার যাকে তাই..!
হাই তুলে বিরক্তিভরা কণ্ঠে ‘হ্যালো’ বলতেই…
“ভটাম’দা বলছি।একবার ছাদে এসো।কথা আছে..”
“এখন ঘুমাচ্ছি দাদা..পরে..”
“পরে নয়,জরুরী কথা।না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না..”
“যাচ্ছি…” ফোনটা কেটে দিলাম।
এই ভটাম’দা সারাজীবন কথার ফাঁকে ‘ভটাম ভটাম’ আওয়াজ করে নিজের নামটাই ‘ভটাম’ দিয়ে ফেললেন।
কখনো শুনি পাড়ার কোনো বাচ্ছা কে বলছেন,’ভটাম করে কোথায় বেরিয়ে পড়লি রে হারামজাদা?’
আবার কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, ‘দাদা, চললে কোথায়?’ ওনার সপাট ড্রাইভ,’বাজার যাচ্ছি ভাই,ভটাম করে যাবো,আর আসবো..।’
মানে ওনার সবেতেই ওই… ! ‘ভটাম’..!
সবচেয়ে হাইট ঘটনা বুঝলেন, যেদিন ভটামদা বাবা হলেন..! সেলুনে দাড়ি কাটছিলেন ল্যাটা’দা।
“কি ভাই, কোথায় যাচ্ছো হন্তদন্ত হয়ে?”
“আর বলবেন না ল্যাটাদা..ভালো খবর..!ভটাম করে পুত্র সন্তান।এখন নার্সিং হোম।”
আর একটা ছোট্ট বিষয় বলে শেষ করবো।ছাদে অনেকক্ষন উনি দাঁড়িয়ে আছেন যে..!
ভটাম’দার শশুর মশাই মারা গেছেন হটাৎ।খবর পেয়েই বৌদিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই সামনে আবার সেই ল্যাটা’দা।
“সাতসকালে কোথায় গো?”
“আর বলবেন না শশুরমশাই ভটাম করে কাল রাতে পটল তুললেন..! তাই ..”
এই হলো ভটাম’দা।’জন্মালেও ভটাম, আবার মরলেও সেই ভটাম’।স্টেশনমাস্টার থেকে রিকশাওয়ালা সবাই ওই নামেই ওনাকে চেনে…’ভটাম’।
“কি হলো ভটাম’দা?তো হঠাৎ কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে জরুরী তলব?ব্যাপার কি?”
ভটাম’দা আমার পাশের বাড়ি।এখন প্রায় দুসপ্তাহ টানা লক ডাউন চলছে ভারত জুড়ে..! করোনা অহংকারী রবিবারের দম্ভ একদম ঘুচিয়ে দিয়েছে।এখন তো গোটা বিশ্ব জুড়ে রবিবার চলছে। বিকেল হলেই ভটামদার সাথে চুটিয়ে আড্ডা। ছাদে দাঁড়িয়ে দূরত্বটাও মেনটেন হয়, আবার ঘড়ির কাঁটার বিরক্তিকর টিকটিক শব্দও কানে বাজে না।
একদম লাগোয়া ছাদ।হনুমান কখনো আসলে একলাফে দুই বাড়ির ছাদেই নিমেষে আসা যাওয়া করে..।
“শোনো, কাল থেকে গায়ে হাতে খুব ব্যাথা ভাই..।”
“কেন?আরামে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে আঘাত লেগেছে নাকি?” টিপ্পনি কাটলাম।
“না রে ভাই.. কাল বাজারে..”
“বাজারে..? কেউ ধাক্কা দিয়েছে?”
“তোমার পুলিশবৌদি কেলিয়েছে..!এবার বুঝেছো!”
“কি যাতা বলছেন?বৌদি আপনাকে..”
“হ্যাঁ.. তোমাদের আদরের পুলিশবৌদি..”
কথাটা বিশ্বাস হলো না।পুলিশে কাজ করলে কি হবে,এমন ভদ্র,লাজুক মহিলা খুব কম দেখেছি।এক বুক গঙ্গাজলে নেমেও যদি ভটাম’দা বলে, বউ ওনাকে মেরেছে, তাহলে আমি কেন,পাড়ার কেউ বিশ্বাস করবে না।ভটাম’দা নির্ঘাত নেশা করেছে।
“কি গো ভাই, বিশ্বাস হচ্ছে না?” ভটাম দার কথায় আমার নীরবতা ভাঙে।
“না দাদা, আসলে..”
“বুঝেছি, তাহলে পিঠের এই দাগগুলো আমি নিজেই নিজেকে মেরে..” ভটাম দা জামা খুলে পিছন ঘুরতেই আমি শিউরে উঠলাম।
আরেব্বাস..!এত দেখছি, মেরে একেবারে কালশিটে ফেলে দিয়েছে..!
এবার একটু মায়া হলো।
“কিন্তু কেন? আমি বৌদিকে বলছি।”
“না, না, ভাই.. তোমার পায়ে পড়ি.. ও আসলে জানে না আমায় ও মেরেছে.।”
“কি ভুলভাল বকছেন?বৌদি জানে না?এটা আমায় বিশ্বাস করতে হবে ভটাম দা?”
“আরে সেকথা বলতেই তো তোমায় সাত তাড়াতাড়ি ডাকা..”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই ভটামদা শুরু করে দিলেন..
“আরে করোনা তো সব খেয়েছে ভাই..!একটু মদ খাই, তাও শালা কেড়ে নিল! জানো, প্রায় দিন পাঁচেক মদ ছুঁই নি।সব স্টক শেষ..!কিন্তু ব্লাড চাইছে.. কি করবো..! কাল চুপি চুপি বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম বাজারে।তোমার বৌদি আগের দিন রাতে তো হাতে পায়ে ধরে বললো, এখন যেও না, পুলিশ অকারণে বাইরে বেরোলেই মারছে।উপর মহলের কড়া নির্দেশ..।”
“কিন্তু বৌদি…”
“শোনো না ভাই, ভটাম করে মাঝখানে নাক গলাও কেন?”
আবার ‘ভটাম’..!আমি খুব কষ্টে হাসি চাপলাম।
“আরে কাল বিকেলে তোমার বৌদি ডিউটিতে বেরিয়ে যেতেই আলমারি থেকে পুরোনো একটা জামা প্যান্ট বের করে পরে বেরিয়ে পড়লুম। চোখ বাদ দিয়ে মুখটা কালো কাপড় দিয়ে এমন বাঁধলুম,যেন কেউ আমায় চিনতেই না পারে।বিশ্বাস করো,আয়নার সামনে আমি নিজেকে সত্যি চিনতে পারছিলাম না।”
“তারপর..?” উত্তেজনায় আমার চোখের পাতা পড়ছে না।
“তাও আবছা আলোয় বেড়িয়েছি ভাই.. জানি, কোনো কারণে তোমার বৌদির সামনে পড়ে গেলেও ও যেন আমায় চিনতে না পারে। কিন্তু কি বলবো ভাই, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয়।মদটাও কিনে ফেলেছিলাম বুঝলে..”
“তাই..?”
“হ্যাঁ গো ভাই…বোতলটা প্যান্টের কোমরে আটকে মা কালীকে ডাকতে ডাকতে ফিরছি.. সামনে দেখি ,সাক্ষাৎ কালী.. তবে বাড়ির..! সে কি বলবো ভাই, দুটো খিস্তি দিয়ে আমাকে গুছিয়ে যা ক্যালালো..কি বলবো..?”
“বৌদি আপনাকে খিস্তি দিলো?”
“সেইতো.!অমন লাজুক বউ আমার!তার মুখে কিনা অমন আকথা-কুকথা।তবে আমার একটাই সান্তনা ও আমায় চিনতে পারে নি..।”
“কি করে বুঝলেন?”
“রাতে খেয়ে দেয়ে বিছানায় ভটাম করে গড়াতে যাবো.. ককিয়ে উঠলাম যন্ত্রনায়..। গিন্নি ডিউটি থেকে ফিরে আমার করুন অবস্থা দেখে সে কি ‘কান্না’..! বুঝলে?”
“তাতেই বুঝে গেলেন, বৌদি আপনাকে চিনতে পারে নি..!”
“আরে ভাই,বাইশ বছর ঘর করছি, এটুকু বুঝতে পারবো না?”
“কিন্তু আপনি মার খেয়ে বেমালুম চেপে গেলেন কেন ভটাম’দা?”
“সত্যিটা জানলে সারাটা জীবন গিন্নির মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না ভাই।পৌরুষত্বে আঘাত লাগতো যে বড্ড..।”
মনে মনে খুশিই হলাম।সারাটা জীবন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে যেভাবে বৌদিকে মারধোর করেন ভটামদা…!বৌদি অজান্তে পিটিয়েছে.. ভালোই করেছে।
দিন দুয়েক পর….
বাজারে কটা ওষুধ আনতে গেছি। মোড়ে পুলিশ বৌদির সঙ্গে দেখা হতেই দাঁড়িয়ে গেলাম।
“ভটাম’দা তো শুনলাম…”
বৌদি আমার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন,”কুড়ি,একুশ বছর ধরে অনেক মার খেয়েছি ভাই,কাল সুযোগটা পেয়েই গেলাম.. স্যাকরার ঠুকঠাক কামারের এক ঘা…কি বলো?”
কানে বাজতে লাগলো ভটামদার কথাটা,”বাইশ বছর ঘর করছি…”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।