মানুষ বারংবার অনাচারী হয়েছে ৷ সুখের খোঁজে দুঁখের নজরানাকে গ্রহন করেছে অজান্তে ৷ আধুনিকতার মাদুলি বেঁধে উন্নয়নে নেমছে ৷ হাতে আগুন চোখে বেলোয়ারি সভ্যতার কাজল মেখে, নয়ছয় করেছে প্রকৃতির অন্দরমহল ৷ যথেচ্ছ উন্মাদনায় শেকর থেকে উপরে ফেলেছে অরণ্যের গর্ভগৃহ ৷ নির্মম ভাবে অরণ্যের পর অরণ্য ভস্মে পরিণত করেছে তার বেহিসাবী চালে ৷ কখনও চাষের জমি, কখনও বসতি নির্মাণ, কখনও আবার কলকারখানা প্রযুক্তির স্বার্থে বনকে ধ্বংস করেছে নির্বিচারে ৷ কত বন্য প্রাণী, হরেক জাতির পাখি আশ্রয় হারিয়ে দিশেহারা, উদবাস্তুর মত অনিশ্চিত জীবনের প্রহর গোনে বারবার ৷ যে মানুষ অবিবেচকের মত পাহাড়ের ধাপ কাটে বসতি গড়তে কিংবা কৃষিকাজের নিমিত্তে, সেই মানুষকেই কিন্তু এই স্বৈরাচারীতার সুদ শুধতে হয় যখন ধস নামে পাহাড়ী প্রান্তের গ্রামণী বা শহুরে জনপদে ৷ কখনও ধসের কারণে স্তব্ধ জীবন আবার কখনও জনপদ ৷
সভ্যতার নামাবলি গায়ে মানুষ নিঃসংকোচে বারবার প্রকৃতিকে রিক্ত কেরছে, লোপাট করেছে সম্পদ ৷ ঝুলি ভরেছে, শহর সাজিয়েছে ৷ প্রযুক্তি, শিক্ষা, কারখানা, অফিস, স্কইস্ক্রেপার আরও কত রূপসজ্জা ! বাইরের রূপ যত বেড়েছে অন্তরের আলো তত কমেছে ৷ যে বৃক্ষ বৃষ্টিকে মেদিনীতে আহ্বান করে, যাদের থেকে অক্সিজেন ধার করে আমাদের হৃদযন্ত্র সর্বদা কথা বলছে তাকে বিলুপ্ত করলে জাতির যে সমূহ বিনাশ অনিবার্য এই বোধদয় আর কবে হবে শ্রেষ্ঠ প্রাণীকূল মনুষ্য জাতির ? এরই নাম কি আলোয় ফেরা ? এরই নাম বুঝি বিকাশ, আধুনিতা, উন্নয়ন ? জীবনের রসদ কেড়ে নিয়ে, জীবন সাজানো য়ায় ? যে প্রাণীকূলকে আমরা নিরাশ্রয় করেছি, যে পাখিদের বাসা আমরা পুড়িয়েছি, নষ্ট করেছি, ঠেলে দিয়েছি অনিশ্চিত জীবনের দিকে, প্রকারান্তরে মৃত্যুর দিকে, অবলীলায় ভুলেই গেছি সেই পশু বা পাখিরা শুধুই প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে না, ভারসাম্যও বজায় রাখে পরিবেশের ৷ মনে হয় না ? মনে হয় না কখনও এই বর্বরতার দায়ভার আমাদেরকেই বহন করতে হবে ৷
ভুলে গেলে চলবে না আমাজনের অরণ্য কীভাবে ছারখার হল মাত্র কয়েকদিন আগে ৷ গবেষকরা বারবার বলেছেন এই দাবানল স্বাভাবিক নয় ৷ মানুষ সৃষ্ট ৷ প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারো ক্ষমতায় আসার পরেই আন্তর্জাতিক হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না-করেই আমাজন অঞ্চলকে চাষ ও খনিজ উত্তোলনের কাজে ব্যবহারের কথা বলেছিলেন তিনি। গরীব কৃষক শুধু জানে চাষের জমি প্রয়োজন, তারা জানে না অরণ্য আমাদের জীবনের রক্ষক ৷ দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদের পাশে প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে সুবিশাল রেইন ফরেস্ট। জানা-অজানা নানা আদিবাসী গোষ্ঠীর বাসস্থান ৷ এই আমাজন জঙ্গলে রয়েছে ১৬ হাজার প্রজাতির গাছগাছালি। খনিজ পদার্থ, কৃষিজমির স্বার্থে অনবরত নির্মম ভাবে বনরাজি ধ্বংস করা হচ্ছে ৷ তিন সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ দাবানলে পুড়েছে পৃথিবীর বৃহৎ রেইন ফরেস্ট আমাজন। ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ ৷ আমাজন জঙ্গল বিনাশের সাথে সাথে বিশ্বের উষ্ণতা চিরতরে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে পরিমাণ অক্সিজেন এই অরণ্য পৃথিবীকে সরবরাহ করে তারজন্য আমরা কৃতজ্ঞ ৷ কৃতজ্ঞতা পরিণত হয়েছে স্বার্থমগ্নতায় ৷ ফলত পাপ, পৃথিবীর প্রতিবাদ ৷ আজ এই সময় পরিবেশ অসম প্রতিযোগিতা ছুঁড়ে দিয়েছে মানবকূলের দিকে ৷ প্রকৃতিকে নিঃস্ব করার ফল ভোগ করার সময় উপস্হিত ৷
প্রকৃতির দাঁত নখ হৃৎপিন্ড উপড়ে দিয়ে একদিন আমরা তাকে বিকলাঙ্গ করেছি ৷ আজ তার নিঃশ্বাসে বিষ, আর সেই বিষের ছোবলে ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে পাল্লা ভারি হচ্ছে ৷ যখন আশীর্বাদ অভিশাপের রূপ ন্যায় তখন বোধহয় তা এমন করেই অতিমারীর আকার ধারণ করে ৷ কত বন্য প্রাণী পুড়ে মরল, কত পাখির হাহাকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছিল তখন ৷ আমরা তখন কেউ বাতানুকূল ঘরে আরামের ঘুমে, কিংবা দামী রেস্তরাঁয় অথবা মনের মানুষের সাথে প্রণয় পানে নিমগ্ন ৷ প্রতিদিন হাজার হাজার গাছ আমরা উপড়ে ফেলি, আগুন লাগাই, কটা গাছ লাগাই ? বন্য প্রাণী শিকার করে ঘর সাজাই, ব্যাবসার প্রয়োজনে নির্মম ভাবে অরণ্যের অঙ্গ উপাঙ্গ বেঁচে দিই কালো বাজারে কিংবা পশুদের দাঁত চর্ম আরও কত কী ! আমাদের অজ্ঞতায় প্রকৃতি তার নির্মল রূপকে প্রায় বিস্তৃত হতে চলেছে ৷ কোথায় সেই দোয়েল কোয়েল ফিঙে ! স্বচ্ছ কাঁচের মত নদী, নীলাভ আকাশ ! ধবল গাই, কাঠবেরালী ! , প্রতিদিন পৃথিবী নিরাভরণ হচ্ছে ৷ একে একে কত প্রাণী, কত পাখি বিলুপ্ত প্রায় ৷
আর আজ সেই দিন সমাগত যখন সব অবিচারের ফলাফল হাতে হাতে বিলোচ্ছে পৃথিবী ৷ এখনও মানুষ যদি সংযত না হয়, যদি প্রকৃতিকে আগলে রাখতে না শেখে অথবা নির্বিচারে ধ্বংস হত্যালীলা বন্ধ না করে, তবে আসন্ন সময়ের খাতে বরাদ্দ হবে শূণ্য ৷ মানব প্রজাতি হয়ত বা ডায়নোসোরের মত একদা বিলুপ্তির পথে হাঁটবে ৷