• Uncategorized
  • 0

গল্পবাজে কুনাল গোস্বামী 

বাসস্ট্যান্ড…

মাসের শেষ তারিখে কাজটা একটু বেশিই ছিল,তাই অনিকেতের বেরোতে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। বাড়িতে মা চিন্তা করছেন,সচরাচর এত দেরি করেনা অনিকেত।মাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল আজ দেরি হবে বাড়ি ফিরতে,তাও মায়ের চিন্তা তো হয়ই।
শীতটা সবেমাত্র ব্যস্ত শহরটাকে ঘুমের চাদরে ঢেকে ফেলতে শুরু করেছে,রাস্তার ধারে কুকুর গুলো গুটিয়ে শুয়ে পড়েছে। নির্জন পথে অনিকেত একাই জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। ঘড়িতে তখন ১১.৩০টা
শেষ বাসটাও চলে গেছে। বাসস্ট্যান্ডে একা দাঁড়িয়ে আছে অনিকেত।ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে সারাদিনের ক্লান্তিকর পরিশ্রমের কথা ভাবছিল আপন মনে।
বাসস্ট্যান্ডের পাশেই ফুটপাতে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো একটা পরিবার, এদেরকে প্রায়ই লক্ষ্য করেছে অনিকেত অফিস যাওয়ার পথে দিনের আলোয়। পরিবার বলতে একটা মাতাল গোছের লোক,একটা জীর্ণ শীর্ণ মহিলা ও দুটি ফুটফুটে মেয়ে। মেয়ে দুটোর বয়স কত হবে এই ধরুন ১৩ কি ১৪।গায়ের রঙ একটু চাপা, এদের পরনে সেই একই ময়লা লাল রঙের সালোয়ার কামিজ দেখেছে অনিকেত।
একটা ট্যাক্সিও পাওয়া যাচ্ছে না,অনিকেতের চিন্তা হচ্ছে। মা বারেবারে ফোন করছেন। অনিকেতের মায়ের শরীরটাও ঠিক নেই ইদানীং, বয়সের ভারে বিভিন্ন রোগ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অনিকেতের বাবা মারা যাবার পর থেকে বাড়িতে অনিকেত ওর মায়ের সাথেই থাকে।তার  কোনো ভাই বা বোন নেই এবং সে এখন বিয়েও করেনি।
ঘড়িতে তখন ১২.১৫,হ্যাঁ সময়টা এখনও মনে আছে অনিকেতের। দু’দুটো সিগারেট ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তাও এখনও পর্যন্ত একটাও ট্যাক্সি পায়নি।
হঠাৎই এমন সময় একটা কালো গাড়ি এসে দাঁড়ালো। তিনটে ছেলে (দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তারা প্রত্যেকেই নেশায় চুর হয়েছিল) গাড়ি থেকে নেমে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে দিতে ফুটপাতে শুয়ে থাকা ঐ হতদরিদ্র পরিবারের সেই ফুটফুটে মেয়েদের মধ্যে একটিকে জোর করে গাড়িতে তুলে দ্রুত গতিতে চলে গেল।
মুহুর্তেই ঘটে গেল সবটা,অনিকেত হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে দেখলো সবটা।তখনও যেন সবটা তার কাল্পনা মনে হচ্ছিল। তার ধ্যানটা ভাঙলো সেই জীর্ণ শীর্ণ মহিলার কান্নার শব্দে। সে চকিতে একবার চেয়ে দেখলো সেই নির্জন পথে। কিন্তু কোথায় কী,গাড়িটার চিহ্ন মাত্রও আর সেখানে নেই।
সে কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না,আসে পাশে তেমন কেউ নেই যে সাহায্যটুকু চাইতে পারে। ফুটপাতের সেই অন্ধকারে মুহুর্তেই ঘটে গেল যে আকস্মিক ঘটনা তা কেউ জানতেও পারলো না।সেই পরিবারের একটি মেয়ে(সম্ভবত তুলে নিয়ে যাওয়া মেয়েটির বোন) অনিকেতের কাছে এসে আকুতি মিনতি করতে লাগে।
“দাদা আমার দিদিকে খুঁজে দাওনা,
ও দাদা,দাদা গো (হাউমাউ করে কাঁদছে তখন সে)
ওদিকে তখন হন্নে হয়ে দিশেহারার মতো দৌড়চ্ছে সেই মহিলা,তার পরনের ময়লা – ছেঁড়া শাড়িটি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে।তবুও যেন কোনো হুঁশ নেই তার।আর সেই মাতাল গোছোর লোকটা ফুটপাতেই শুয়ে আছে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়।
অনিকেতের ফোনটা পকেটে বেজেই চলেছে,এরই মধ্যে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়ে ছিল বাসস্ট্যান্ডে কিন্তু অনিকেত যেতে পারেনি।কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি তার পায়ে লোহার শেকল পড়িয়ে বেঁধে রেখেছে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন বাসস্ট্যান্ডে।
অনিকেতও দৌড়চ্ছে রাস্তায়, কাউকে যেন আপ্রাণ খোঁজার চেষ্টা করছে একটু সাহায্যের জন্য।সেই শীতের রাতে নির্জন রাস্তায় নিশাচরের মতো নিশব্দে ছুটে চলা গাড়িগুলোকে উদভ্রান্তের মতো দাঁড় করানোর মরিয়া চেষ্টা করছে অনিকেত। কিন্তু না,না সেই রাতে সে কাউকেই পেলনা যে তার সাহায্য করতে পারে এমন একটা ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়।
বাসস্ট্যান্ডের একটু দূরে রাস্তার ধারে নিরুপায় হয়ে বসে পড়েছে অনিকেত।সেই জীর্ণ শীর্ণ মহিলাটিও কান্নায় ভেঙে পড়েছে তার কোলের মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। এইভাবেই কেটে গেছে প্রায় একঘন্টা। হঠাৎই সেই কালো গাড়িটা দ্রুত গতিতে এসে ঠিক বাসস্ট্যান্ডের সামনে সেই মেয়েটির রক্তাক্ত দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার তেমনই দ্রুত গতিতে চলে গেল। অনিকেত ছুটে গেল গাড়িটির পিছনে।কিন্তু পারলো না ধরতে। দৌড়তে দৌড়তে হাঁফিয়ে সে পিছনে ঘুরে তাকালো। সেই দৃশ্য সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না,সেই মেয়েটির রক্তাক্ত দেহটা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে তার পরিবার।অনিকেত ছুটে এল তখনও দেহে প্রাণ আছে মেয়েটির।
মানুষ কতটা নৃশংস হতে পারে তা সেদিন অনিকেত নিজের চোখে দেখেছিল। অনেক কষ্টে একটা গাড়িকে থামিয়ে অনিকেত সেই মেয়েটিকে একটা হাসপাতালে নিয়ে গেল।
ধর্ষনের চিহ্ন সারা শরীরে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অনিকেত নিজের অজান্তেই পকেট থেকে ফোনটা বার করলো,দ্যাখে মায়ের ২০টা মিশকল।ফোন করলো বাড়িতে। তার মা ততক্ষণে দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছেন।কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন- “অনি তুই কোথায়?এখনও বাড়ি ফিরিসনি কেন?তোর এই বুড়ি মা’টার জন্য বুঝি একটুও চিন্তা হয়না? অনিকেত কথা বলতে পারলে না।শুধু বলল- গাড়ি পেলাম সবেমাত্র, চিন্তা করোনা, আমি এখনই আসছি।
সে’রাতে চোরের মতো লুকিয়ে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে এসেছিল অনিকেত। তারপর একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে বাড়ি ফিরে এসেছিল।তার সারা শরীরে তখনও সেই মর্মান্তিক ঘটনার চিহ্ন স্পষ্ট। চুল উসকোখুসকো, চোখেমুখে ভয়ার্ত অন্ধকার। সে’রাতে অনিকেত ঘুমোতে পারেনি।সারারাতটা যেন একটা বিভীষিকার মতো কেটেছিল ওর।মানুষের নৃশংসতার সেই বিবরণ সে আর কাউকে বলতে পারেনি।
আগামী তিন দিন সে অফিসে যেতে পারেনি।সারাক্ষণই ঘরে চুপচাপ বসে থাকতো।মাকেও কিচ্ছু বলেনি। তিনদিন পর যখন আবার সেই রাস্তা দিয়ে অফিস যাচ্ছিল অনিকেত তখন সেই চেনাপরিচিত বাসস্ট্যান্ডে একবার চেয়ে দেখেছিল।আর সেই হতদরিদ্র পরিবারটি আর সেখানে নেই।আর এই ব্যস্ত শহরের বুকে ঘটে যাওয়া সেই রাতের একটা দুঃস্বপ্নের মতো মর্মান্তিক ঘটনার কোনো চিহ্নই সেখানে নেই।
হয়তো যেন সবটাই অনিকেতের কল্পনা, কিংবা এমন অনেক কাল্পনিক তবুও অতি বাস্তবিক ঘটনা রোজই আমাদের চোখের আড়ালে ঘটে যায় যা আমাদের আজও অজানা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।