ছোটো শহর থেকে বই বের করা এমনিতেই কঠিন, তার ওপরে যদি কবিতার বই হয়। প্রলয় হালদার যখন বছর দশেক আগে সেই কাজে হাত দিলো, তখন সে সময়কার প্রেমিকা প্রিয়াংকা মুখ ভেটকে বলেছিলো, ‘ গরীবের ঘোড়ারোগ!’ । সম্পর্কটা টেঁকেনি, কিন্তু ইতিহাসের মাস্টারের অসুখটা থেকে গেছে। এই বার দশ বছরে পড়বে তার বের করা বাৎসরিক কবিতা সংকলন, ‘ কথার বসতি’। নামী দামী কবিরাও এই বইটাতে কবিতা রাখতে পারলে গর্ববোধ করেন এখন।
তবে যাত্রাটা সহজ ছিলো না। তার এক নম্বর কারণ, প্রলয় কবিতা লিখতে পারেনা। কাগজ কলমে বহু ঘষেও একটি গ্রহণযোগ্য কবিতা বেরোয় নি মগজ থেকে। অথচ, ওর মতো বিদগ্ধ পাঠক বাংলা ভাষায় কজন আছে, হাতে গুণে বলা যাবে। ছন্দের জ্ঞান , বিমূর্ত ভাব পড়ার ক্ষমতা আর অনন্ত পড়ার খিদে ওকে এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাবোদ্ধাদের একজন করে দিয়েছে। এক নজর বুলিয়েই সে বলে দিতে পারে কবিতা কতখানি উতরেছে। কবি মহলে এই ব্যাপারে তার যথেষ্ট খ্যাতি।
দুই নম্বর এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ, অর্থাভাব। মাস্টারের চাকরিতে সংসার চালিয়ে বই কেনা যায়, বই ছাপানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই ওর পরম সৌভাগ্যে, ওর আলাপ হয়েছিলো বোধিসত্ত্ব মজুমদারের সঙ্গে। বোধিসত্ত্ব প্রবন্ধকার ও সমালোচক হিসেবে বহুকালই খ্যাত। তবে কবিতা ব্যাপারটিতে তার কোনো আগ্রহ দেখেনি সাহিত্যমহল। বোধিসত্ত্বের আরেকটি পরিচয়, যেটা বহুলোকেরই জানা নেই , তিনি মজুমদার গ্রুপ অফ টেক্সটাইলসের কর্ণধার, এবং দুঁদে ব্যবসায়ী। লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর দুই দেবীর কৃপাধন্য এমন মানুষ বিরল। সেই বোধিসত্ত্ববাবু প্রলয়ের পাগলামি দেখে খানিকটা প্রশ্রয়ের ছলেই পঁচিশ হাজার টাকা ডোনেশন দিয়েছিলেন প্রথম বইটার জন্য।
নবীন কবিদের অনন্য লেখনি সমৃদ্ধ বই ‘ কথার বসতি ১’ রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলো সেবছর বইমেলায়। প্রতিটি কবিতা প্রলয় হাতে বাছাই করেছিলো। বলা বাহুল্য কবিদের সাম্মানিক দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না, আর সেটা উঠতি কবিদের প্রত্যাশাও ছিলো না। কিন্তু প্রচ্ছদ , ছাপা ও বিষয়ে অনিন্দ্য বইটির পাঠক পেতে সমস্যা হয়নি।
সেই শুরু, তারপর থেকে প্রতি বইমেলায় ‘কথার বসতি’ ভালো কবিতা দেওয়ার কথা রেখেছে। কবিতার বইয়ে লাভ বিশেষ হয়না, সুতরাং খ্যাতির সাথে প্রলয়ের ঘরে বাড়তি অর্থ তেমন জোটেনি। প্রতি বছর বোধিসত্ত্ববাবু বিনা বাক্যব্যয়ে পঁচিশ হাজারের চেক পাঠিয়ে দেন। মূলত সেটার ভরসাতেই প্রলয় বিস্তর প্রলোভন কাটিয়ে বেনোজল না ঢুকিয়ে বইটা বের করে চলেছে। প্রথমবারের পর তার আর কোনো কবির কাছে কবিতার আর্জি জানাতে হয়নি। বরং কবিরা মুখিয়ে থাকেন তাকে কবিতা পাঠাতে, ‘ কথার বসতি’তে ছাপা হওয়া মানে মুকুটে একটা ঝকঝকে পালক যোগ হওয়া ।
মজার ব্যাপার, বোধিসত্ত্ববাবু কিন্তু ভুল করেও বইটা পড়েও দেখেন না। সৌজন্যসংখ্যা দিতে গেলে ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রলয়কে তিনি সরাসরি বলেই দিয়েছেন ‘ তোমার কবি না হয়ে কবিতাখ্যাপামিটা আমায় মুগ্ধ করে। তাই দিই। তবে দয়া করে আমায় কবিতা পড়তে বোলো না।’
শুধু একজন কবি কখনো তাঁর কবিতা পাঠাননি ‘কথার বসতি’তে । কঞ্চুকী। নাম শুনলেই বাংলার পাঠকমহল নড়েচড়ে বসে। বর্তমান কবিতাতে ছন্দ ভাব বিষয়বৈচিত্র্য আর কথার কারুকাজে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। অথচ নামের আড়ালের মানুষটি ততোধিক ঝাপসা।কোনো অনুষ্ঠানে আসেননা, ফেসবুকে পাঠকের মুগ্ধ মন্তব্যে উত্তর দেননা, বইয়ের প্রকাশে আসেননা। আড়াল থেকে তাঁর কথার জাদু আচ্ছন্ন করে রাখে অগণিত পাঠককুলকে। এই বিজ্ঞাপনসর্বস্ব সোস্যাল মিডিয়া যুগে কঞ্চুকী এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম।
প্রলয় এতটাই অন্ধ ফ্যান কঞ্চুকীর, যে প্রপেলার বললে ভালো হয়। সব কবিতা প্রায় ঠোঁটস্থ। ন’বছর সে অপেক্ষা করেছে প্রিয় কবির লেখার। এইবারে মরিয়া হয়ে নিয়ম ভেঙে মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়েছে কবিতা চেয়ে। উত্তর আসেনি। সবাই জানে, কঞ্চুকীর উত্তর আসেনা।
এই মনখারাপের মধ্যে আবার বিনামেঘে বজ্রপাত হয়েছে আজ। বোধিসত্ত্ববাবু একটা খাম পাঠিয়েছেন। সেটাতে বরাবরের মতো চেক নেই, আছে একটা .. কবিতা! বোধিসত্ত্ব মজুমদারের প্রথম প্রচেষ্টা বোধহয়। যেটা পড়ে অবধি মাথা ভোঁভোঁ করছে প্রলয়ের। ছন্নছাড়া ভাব, অপরিচ্ছন্ন গঠন, উদ্ভট কথা। এটা পাড়ার শারদ ম্যাগাজিনে ছাপাবারও যোগ্য নয়, ‘কথার বসতি’তে তো প্রশ্নই নেই। অথচ না ছাপালে বইটাই হয়তো ছাপা হবেনা। প্রাইভেট স্কুলের মাইনে এত নয় যে বইয়ের পয়সা এত চট করে জোগাড় করতে পারবে প্রলয়।
ধার নিতে হবে, কিন্তু সেটা পেতেও তো সময় লাগবে! ছাপাতে পাঠাতে হবে শিগগিরই। সংকলন প্রায় শেষ, শুধু আশায় আশায় কঞ্চুকীর জন্য একটা জায়গা রেখেছে সে। ওখানেই কি তবে বোধিসত্ত্বের কবিতা? একটু ঘাড় নুইলে ক্ষতি কি? এই দশবছরে তো তিনি আর কিচ্ছুটি চাননি। ধরতে গেলে বইটার মালিক তো বোধিসত্ত্ববাবুই।