গল্পকথায় সোনালি

সাত মহলা

“কে না জানে মেয়ে মানুষকে পুঁথিপত্র নিয়ে টানাটানি করতে নেই । আর কক্ষনও আঁক কাটতে নেই । ওতে বেধবা হতে হয়।
আর বেধবা হলে তো , বাপরে!”
শিউরে ওঠে সাতমহলা চাটুজ্যে বাড়ির ছোট তরফের পাঁচ নম্বর মেয়ে শিউলিবালা।
বিরাট বাড়ি চাটুজ্যেদের। কত যে ঘর বারান্দা সারি সারি খিড়খিড়ি দেওয়া জানালা।কে কোথায় থাকে সবাই ঠাওর করতেও পারবে না চট করে। আধখানা চাঁদের মত খিলেন দেওয়া ঘরে ঘরে, জানলা দরজার উপর গুলোতে । দেওয়ালে কুলুঙ্গি । রাতের আলো রাখতে। হাতপাখা ,জল । আবার অনেক ঘরে কুলুঙ্গির পাশে মেয়ে বউয়েরা বিলিতি কাঁচের আয়না টাঙ্গায় ।পাশের খোপে চিরুনি, ফিতে, সখের সোনা রূপোর কাজললতা, খোঁপায় দেবার ফুল, কাঁটা ,সুগন্ধি তেল, সিঁদুরকৌটো।
মেয়েদের কি আর সখের অন্ত আছে।
শিউলিবালা এখনও নেহাৎ ছেলেমানুষ। সাত পেরোবে শীগগির । তাও এটুকু জ্ঞান ওর হয়েছে যে দাদারা গুরুমশাইয়ের কাছে পুঁথি নিয়ে যখন পড়তে যায় ; তার ধারে কাছে ওর থাকা চলে না।
মায়ের চেয়েও আগে দিদিরা ছোট পিসিরা সব সাবধান করে রেখেছে । কত রকম ভয়ে যে কাঁটা হয়ে থাকে অন্দরমহল। তবে , ওই , সব চাইতে বেশি ভয়খানিই হল বেধবা হবার।
বুকের মধ্যে কেমন করে শিউলিবালার।
উফ। সে যে কি কষ্ট ! সেজতরফের জ্যাঠা মশাইয়ের মেয়ে বুনিদিদি আছে তো, বেধবা। বাবা, কি কষ্ট ওর । অল্পই বড় শিউলির থেকে । নিজের মা হয় জেঠিমা তাও মারতে মারতে ছোট ঠাকুরঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে ছেকল আটকে দেয় মাঝে মাঝে।
আজব কিন্তু বাপু ।ওকে মেরে পিটে বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। আবার নিজে এসে ভেতর মহলের বারান্দায় বসে হাউমাউ করে কাঁদে ।
কি , নাকি একাদশী ।বুনি কেবলই জল খেতে চায় । খিদেয় কাঁদে ।তাই মারে। বাবা ,এত গরমে সারা দিনে এট্টু জল ও খেতে দেবেনা মেয়েটাকে ?
ওই তো ; বেধবা হবার ফল। বড় দিদি ওকে বলেছে সে দিন। এ জন্যেই ত মেয়ে মানুষকে সামলে চলতে হয়। কখন কি পাপ দিয়ে দেবে ঠাকুর ।
এদিকে জেঠিমাকে নাকি এদিন মাছভাত খেতেই হবে। নাকি নইলে জ্যাঠাবাবুর অমঙ্গল হয় । বোঝো । কি জ্বালা গো ।
কত চেঁচায় জেঠিমা । বলে ,“ আমি মরি না কেন? ছেড়ে দাও তোমরা আমায়। আমার গলা দিয়ে নামছে না এ মাছ ভাত ।”
কত কিছু হাবিজাবি বলে । চোখ দিয়ে জল পড়ে ভাতের থালায়। এঁটো ভাত ছেটাতে থাকে চেঁচাতে চেঁচাতে ।
সব চেঁচামেচি চুপ হয়ে যায় বড় তরফের জেঠিমা এলে। সোনা জেঠী এ বংশের বড় বউ। অন্দরের সবাই ভয় পায় তাকে।
মাথা নিচু করে ভাতের থালার সামনে তখন বসে থাকে বুনির মা । বড় জা এসে দাঁড়ালে আর মাথা তোলে না।
পাঁচ বছরের বুনি প্রথম একাদশীর দিন তেষ্টায় অস্থির হয়ে কাঁদছিল যখন সেদিনও সোনাজেঠী এসে দাঁড়িয়েছিল । চোখের জলে ভেসে মেয়ের মা যখন বলছে, “দিদি এত দুধের শিশু ,একটু জল খেতে চাইছে। ও স্বামী স্ত্রী কি বোঝে বল ?”
অন্দর মহলের রানী অপলক চোখে চেয়ে বলেছিলেন, “তবে কি স্বামীর চিতায় তুলে সতী করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত বলছ ? যদি সামলাতে না পার বল। বৃন্দাবন কাশী সবখানেই ব্যবস্থা আছে। কর্তাদের বলে পাঠিয়ে দেব। বাড়ির মধ্যে অনাচার চলবে না। তবে এখেনে ঘরের মধ্যে তবু বাড়ির মেয়ে বলে মঙ্গলের ভাত খাচ্ছে অন্য দিন। সেখেনে কড়ে রাঁড়ি , ক ভাতারে ওর শরীরটা কি ভাবে শেয়াল কুকুরের মত ছিঁড়ে খাবে তা কিন্তু তুমি এখেনে বসে জানতেও পারবে না। তীর্থ ধম্মের জায়গা ত; সব উপরওয়ালার নামে বলিদান হয়ে যাবে । তোমার সুবিধে হবে অবশ্য । কানে আর শুনতে পাবে না মেয়ের কান্না। খুব অসুবিধে হলে বোলো। কত্তাদের বলে ব্যবস্থা করে দেবো ।”
সেই থেকে বড় গিন্নি এসে দাঁড়ালেই নিঃশব্দ হয়ে যায় বুনির মা । ভাত নাড়ে চাড়ে মাথা নিচু করে, তিনি যতক্ষন না নিজের মহলের দিকে ফিরে যাচ্ছেন। মাথার রুক্ষ চুলের বোঝার ওপর টানা ঘোমটা নিচু হয়ে নামে থালার ওপর ।দু চোখ ছাপানো নোনতা জল মিশে যায় ভাতের গরাসের সঙ্গে ।
ভুলে তাই পুঁথিপত্রের দিকে হাত বাড়ায় না শিউলিবালা।
যত যত তারাব্রত সাবিত্রীব্রত করায় মা ,সব করে নেয়। ভোরে উঠতে চোখ কচ কচ করে । ইচ্ছে করে না। তবুও ওঠে ।নইলে যদি বেধবা হতে হয় !
না বাবা। সব ঠাকুরের পায়ে মনে মনে পেন্নাম ঠোকে শিউলিবালা। আর যাই কর ঠাকুর , ওর’ম কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না ,রক্ষে কর।

চাটুজ্যেদের এ প্রজন্মের সবচে তুখোড় ছেলে অলঙ্কার ।ঝকঝকে চেহারা। চোখে মুখে কথার ফোয়ারা । দুবছর পর মানহাট্টান থেকে দেশে ফিরছে। নতুন চাকরি পেয়ে বিদেশে যাবার তোড়জোড় ঠিক হতেই বাবা মা বিয়ে দিয়েছিলেন। অল্প বয়েস। বিদেশের কত গল্পগাছা শোনা যায় । একটু রাশ না টেনে এত দূরে পাঠাতে চাননি বড়রা । তাই নতুন বউ নিয়ে বিয়ের পরের সপ্তাহেই আমেরিকা চলে গিয়েছিল অলঙ্কার।
চাটুজ্যে বাড়িতে আজ বিরাট গেট টুগেদার । অলঙ্কারের বাবা মা কেটারার বলেছেন। নয় নয় করে এখনও তো এ বাড়ির শরিক কম নয়। আর যেহেতু দোল দুর্গোৎসব ইদানিং আবার বেশ জম্পেশ করে রিভাইভড হয়েছে , সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ থাকে। ফেসবুকে, ইন্সটাগ্রামে এখন পরিবারগুলো আবার রিকানেকটেড ।
জেটল্যাগের ক্লান্তি কাটাতে একটু নিজের বেডরুমে জানলা দরজা বন্ধ করে এসি চালিয়ে গড়িয়ে নিচ্ছিল সুলোচনা। ছোট ননদ ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে খাটে এসে বসল।
একটা চোখ ফাঁক করে নতুন বউ ।
“ কি রে ?”
কলেজে একই সংগে পড়ত এই দুই আধুনিকা। কাছাকাছি পাড়ার মেয়ে। পালটি ঘর। সেইখান থেকেই সম্বন্ধ কাম প্রেমের বিয়ে।
অবন্তিকা বলে ওঠে , “ অমন চুলগুলো কেটে ফেললি ? একটু মায়া হল না? নইলে বুঝি মেম হওয়া যাচ্ছিল না ?”
সোজা হয়ে উঠে বসে সুলোচনা ।
“নাহ, তোর দাদার নইলে আনস্মার্ট মনে হচ্ছিল । নর্থ ক্যালকাটার সেকেলে গলির মেয়ে ট্যাঁকে গুঁজে কোনো স্মার্ট ইয়াং এগজিকিউটিভ মানহাট্টানে ঘোরে না। সঙ্গে মেম সাহেব লাগে।
শুধু চুলের কাট দেখছিস ? এখনও তো জানিসই না কত পেগ লিকার হোল্ড করতে পারি, কেমন তুখোড় ককটেল বানাতে জানি, পার্টীতে বিকিনি পরে পার্টনার এক্সচেঞ্জের খেলায় কতোটা স্বচ্ছ্ন্দ ।
আমার বর এইসব খুব পছন্দ করে । সে ব্লন্ড মেয়ে প্রেফার করে। কত বড় ফ্রেন্ড সার্কল ওর । আমি সেই ব্লন্ডদের পার্টনারদের সঙ্গে রাত কাটিয়ে দিই উইকেন্ডে । কত রকম নতুন নতুন লোকের সঙ্গে আলাপ হল এ দু বছরে। বিছানায়। ঘরের বাইরে। কত দেশের মানুষ যে দেখা যায় আমেরিকায় ।
দেশ থেকে কত্ত দূর জানিস ? আমি বুঝে গেছিলাম, হেরে না গিয়ে, হীরের টুকরো বরের বউ হবার স্ট্যাটাসটা মেইনটেইন করতে গেলে এসব অভ্যেস করে ফেলতে হবে ।
আমার স্মার্ট বর এইসবই খুব পছন্দ করে, অবন । তার সঙ্গে থাকতে গেলে আমায় এভাবেই থাকতে হবে। বাবা মায়ের মুখে চুনকালি মাখিয়ে বোকার মত একা ফিরে তো আসতে পারি না , বল ?”
স্তম্ভিত অবন্তিকার ফ্যাকাশে হতভম্ব হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে হিস্টেরিকালি হাসতে থাকে সুলোচনা ।
“ ওর’ম ভ্যাবলা হয়ে গেলি কেন রে ? আমি পারি । সব পারি । আফটার অল আমি এ যুগের অন্যতম সফল এক কসমোপোলিটান তরুনের বেটার হাফ।
এখন আর কাজল পড়ি না । এলো খোঁপার স্বপ্ন দেখিনা । কক্ষনও কক্ষনও আর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইব না।
ইটস অল সো মিডলক্লাস ইউ নো ।
মধ্যবিত্ত শব্দটা আসলে যে একটা গালাগালি, আমি বিয়ের পরে পরেই বুঝে গেছি।”

সুলোচনার উপর দিকে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ তীব্র হাসির আওয়াজের সঙ্গেই মিশে গেল একটা নরম ফোঁপানো । দু হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল অবন্তিকা। তাকে দেখে সাজানো মুক্তোর মত দাঁতে হীরের ঝিলিক দেওয়া নতুন বউয়ের ছুরির মত ধারালো শ্লেষের হাসিটাও ঝরঝর করে ভেঙ্গে পড়ল কান্না হয়ে।
দুচোখ ছাপানো অজস্র জলের ধারায় মিশে ভেসে যাচ্ছিল দুই সুন্দরী উচ্চশিক্ষিতা তরুণীর একসাথে রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সাল , নতুন টাঙ্গাইল শাড়ির আঁচল ওড়ানোর আনন্দ , লিটল ম্যাগাজিন মেলা , দুর্গা পুজোর অঞ্জলি দেওয়া পবিত্র ভোর । একসাথে বেড়ে জীবনের সমস্ত মূল্যবোধ, দর্শন, ভাল লাগা, রুচি, আত্মসম্মান; সব, সব বুঝি ভেসে যাচ্ছিল এই দুই তরুণীর বুকভাঙ্গা কান্নায়। যে কান্নার দাগ মুছে ফেলে ওদের এক্ষুনি সেজে গুজে গেট টুগেদার পার্টিতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে চকচকে হাসি মুখে ।
এ ঘরের চাপা কান্নার আওয়াজ সাতমহলা বাড়ির দেওয়ালদের মনে করিয়ে দিল , তারা কত দিন ধরে কত কত মেয়েমানুষের এমন অর্থহীন কান্নার শব্দ শুনে আসছে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।