রুমি আর সুমনের প্রেমটা বহুদিনের । পাশাপাশি বাড়ি ওদের । জানলা আর ছাদ ওদের দুটি চোখ ও দুটি মনকে কবে যেন মিলিয়ে দিয়েছিলো, তার হিসেব ওরা রাখে নি । তারপর পাড়ার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দুর্গা পুজো, কালী পুজো, সরস্বতী পুজোকে উপলক্ষ্য করে আরো কাছাকাছি এসেছে ওরা ।
ওদের সম্পর্ক প্রথম ধরা পড়ে সুমনের বৌদি সুজাতার চোখে । সুজাতা ওকে নিজের ভাই এর মতোই ভালোবাসে । আর মিষ্টি স্বভাবের রুমিকেও সুজাতা নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে । ওরাও বৌদির কাছে অকপটে স্বীকার করেছে নিজেদের মনের কথা ।
কিন্তু সমস্যা হলো সুমনের মা রমলা দেবীকে নিয়ে । রমলা দেবীর অনেক দিনের ইচ্ছে , ছোটো ছেলের জন্য ডানা কাটা পরীর মতো সুন্দরী বৌমা চাই তাঁর । বড় বৌমা ডানা কাটা পরী না হলেও খুবই সুন্দরী । তিনি ঘটক মশাইকে অনেক ঘুরিয়ে তবে এই বৌ ঘরে আনেন । ছোটো ছেলের বেলায় আর ঘটকের ওপর ভরসা না করে নিজেই বৌমা খুঁজে রেখেছেন । নিজের ছোটো বেলার বান্ধবী সমতা দেবীর একমাত্র মেয়ে সীমানাকে উনি ছোটো বৌ নির্বাচন করে রেখেছেন অনেক আগে থেকেই । সীমানা M.B.A. করছে, অসাধারণ সুন্দরী, খুব স্মার্ট, নাচেও পারদর্শী । নিজের ইঞ্জিনীয়ার ছেলের জন্য এরকম মেয়েই রাজযোটক বলে ওনার বিশ্বাস।
পাশের বাড়ির রুমিকে রমলা দেবী নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন তবে ওর মধ্যে উনি কোনোদিনই ছোটো বৌমার প্রতিচ্ছবি দ্যাখেন নি ।
রুমি খুব মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে,ওর গানের গলাটিও চমৎকার ; তথাকথিত সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, ও কিন্তু তা নয় । তবে ওর মধ্যে একটা আলগা শ্রী আছে । আর ওর চোখ দুটো খুব সুন্দর, বড্ড মায়াবী ; সুমন মাঝেমাঝেই ওর চোখের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যায় পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে ।
সুমন যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং করে ওখানের ক্যাম্পাসিং এই চাকরি পেয়ে গেছে ,তাও প্রায় দেড় বছর হলো । আর রুমিও যাদবপুর থেকেই ইতিহাস নিয়ে M.A. পাস করে এখন একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি করছে । এবার দুজনের মনেই বিয়ের স্বপ্ন দানা বাঁধছে ।
সুমন বৌদিকে ধরলো বাড়িতে ওদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য । ওর বৌদিও ওর দাদা সুজয়কে ধরলো মা-বাবাকে এ ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য । কিন্তু ব্যাপারটা যে মোটেই সহজ নয় , সুজয় জানে সে কথা । পাশের বাড়ির মেয়েকে ঘরের বৌ করে আনার মতো যে উদার নন তার মা-বাবা, তা ওর অজানা নয় ।
তবুও সেদিন রাতে খাবার টেবিলে কথাটা পাড়লো সুজয়, সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে যেন বাজ পড়লো । এরপর কথা কাটাকাটি, তর্ক-বিতর্কের পর্ব মিটতে মিটতে প্রায় মাঝ রাত হয়ে গেলো । ওদের বাবা সুকুমার বাবু আর রমলা দেবী, দুই ছেলে আর সুজাতাকে যা নয়, তাই বললেন ; আরো বললেন যে এরকম উদ্ভট খেয়াল ওদের মাথায় এলো কী করে!
রমলা দেবী তো ঘোষণাই করে দিলেন যে, এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসবে একমাত্র সীমানাই, আর কাউকেই উনি ছোটো বৌ হিসেবে স্বীকার করবেন না ।
সীমানা ওদের বাড়িতে উৎসব-অনুষ্ঠানে মাঝেমাঝে আসে । কিন্তু এরা তিন জন ওকে মোটেই পছন্দ করে না,বড্ড অহংকারী,কারোর সাথে তেমন কথাই বলে না । মায়ের সাথে আসে,প্রয়োজন মিটে গেলে চলে যায় । ব্যাস্ ঐটুকুই । কেউ যেচে কথা বললে উত্তর দ্যায়, না হলে চুপচাপ বসে থাকে । রুমির একদম বিপরীত স্বভাবের ।
যাই হোক, সে রাতের মতো যে যার ঘরে চলে গেলো । সুমন তো বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভেবেই নিলো কারণ ও কোনোমতেই রুমিকে ছাড়া আর কারোর কথা ভাবতে পারে না । এরপর কয়েক দিন বাড়িতে চললো অদ্ভুত নিস্তব্ধতার পরিবেশ । যে যার মতো নিজের কাজ করে চলেছে চুপচাপ । প্রয়োজন না হলে কেউ কারোর সাথে কথাও বলছে না তেমন ।
কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না জীবন । সুজয় আর সুজাতার মধ্যে বিস্তর আলোচনা চললো । রমলা দেবী আর সুকুমার বাবুর মধ্যেও আলোচনা চললো । সুমন এখন খুব দেরি করে বাড়ি ফেরে । ও রুমির সাথেও কথা বলেছে এ ব্যাপারে । কিন্তু সমাধান সূত্র এখনো বেরোলো না কিছু ।
এদিকে রুমির বাড়িতেও ওদের ব্যাপারটা জানে সবাই । পাশাপাশি বাড়িতে এরকম সম্পর্ক তাঁরাও মানতে পারেন নি মন থেকে । প্রথমে ওর মা রীতা দেবী অনেক বুঝিয়েছেন মেয়েকে কিন্তু সফল হন নি । ওর বাবা পবন বাবুও মেয়েকে না বোঝাতে পেরে হার মেনেছেন । একমাত্র মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে অগত্যা ওনারা এই সম্পর্কটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন ; তবে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চিত হয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তাঁরাও ।