• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় মৌমিতা চক্রবর্তী

বিষন্ন বিকেল


একটা বিষন্নতা মোহরকে ছুঁয়ে থাকে সর্বক্ষণ। যেন শেষ বিকেলের অস্তমিত আগুনরঙা সূর্যটা। আগুন আছে অথচ তেজহীন, ম্রিয়মান। ওই সময়ের মন কেমন করাটা যেন মোহরের চারদিকে একটা গন্ডী টেনে রেখেছে। ওদিকে শ্রীপর্ণা খুব জোরে তাড়া দিচ্ছে গাড়ীতে ওঠার জন্য, ওদের একটা দল আছে। মেয়েদের দল। সবাই একসঙ্গে বেড়াতে যায়। পিকনিক করে। হঠাৎ হঠাৎ ছুটি পেলে প্ল্যান করে। কখনও কখনও পরিবার সঙ্গে যায়। আবার কারও হয়তো পরিবার বলতে তেমন কিছু নেই। বিবাহ-বিচ্ছিন্ন। কারুর ছেলেমেয়ে বাইরে পড়তে চলে গেছে। এই যেমন অর্ক। অর্ক মুম্বই আই. আই. টি. তে চান্স পেয়েছে বছর খানেক হলো। অর্ক মোহরের ছেলে। ওর বেড়ে ওঠার সময়টা মোহর ভালো করে অনুভবই করতে পারলো না। বড্ড তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল অর্ক। অবশ্য কাকেই বা পেল মোহর? শুভর সঙ্গেও তো জীবনটা সেইভাবে কাটানো হল না। গাড়ীটা হঠাৎ ব্রেক কষ্‌লো। একটা ঝাঁকুনি, মোহরের বুকের ভেতর কষ্টটা আবার দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে কোটরে ঢুকে গেল।
কী এত ভাবো বলো তো মোহরদি? ছেলের কথা? — ঐশিকা বলল। চারপাশের প্রকৃতিটা দেখছো? বর্তমানে বাঁচো মোহরদি। যেটুকু পাবে জীবন থেকে শুষে নাও।
ঐশিকার কথায় হাসল মোহর। একদিন সেও তাই ভাবত। বাইরে তাকিয়ে দেখল ছুটি নেওয়া দিনের মনখারাপ করা আলো। সত্যি ইচ্ছে গাঁও যাবার রাস্তাটা এত সুন্দর। আর একটু পরে পাহাড়ে সন্ধ্যা নামবে। বনজ অন্ধকার আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে পৃথিবীকে। মোহর ডুব দেয় অতীতে। অনেক বছর আগে চৈত্র শেষের এক সন্ধ্যা। মোহর আর অফিসের বন্ধুরা মিলে সিনেমায় গেছে। কলকাতা থেকে ফোনে শুভ যেন একটু ধাক্কা খেল — সিনেমা দেখেই বা্ড়ি ফিরবে তো? বুঝতে পারেনি মোহর। — কেন? কী হল?
—- না …মানে… তোমার বাবার সুগারটা হঠাৎ হঠাৎ ফল্ করে যাচ্ছে আর তুমি এখন… … শুভর গলার এই বিরক্তিটা যেন মোহরকে সু্যোগ করে দিল।
—– এখান থেকে বেরিয়ে কোথাও খেতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। পৃথিবীতে সবাই নিজের মত করে বাঁচতে পারে শুভ, মা’কে ছেড়ে সন্তান থাকতে পারে, স্ত্রীকে ছেড়ে স্বামী… … তুমি জানো না? খোঁচাটা দিয়ে নিজেকে স্মার্ট মনে হয়েছিল মোহরের। মনে হয়েছিল জিতে গেল সে। এখন এটাকে ছেলেমানুষি মনে হয়।
“আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না…” ঐশিকার গানে সম্বিৎ ফিরল মোহরের। আর বেশি দেরি নেই ইচ্ছে গাঁও পৌঁছোতে। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে মীরাদি বলল, শেষ যেবার গ্যাংটক এসেছিলাম…সালটা বোধহয় ২০১৩। এত ভিড়। কাটাও যাওয়াটা পুরোপুরি ভেস্তে গেল খারাপ আবহাওয়ার জন্য। তারপর থেকেই ভেবেছি আর ওই চেনারুট নয়। অচেনা গ্রামগুলোকেই খুঁজব। শ্রীপর্ণা ফুট কাটল, ইচ্ছে গাঁও কিন্তু আর অচেনা জায়গা নয়, মীরাদি। তোমার ভালো লাগেনি অন্য কারণে। শ্রীপর্ণার ঠোঁটে আলগা দুষ্টু হাসি। মীরাদি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল, বোঝা গেল পরিবেশটা একটু ভারী।
হোমষ্টের বারন্দায় বসে আছে মোহর। মিঠে রোদ ওর এলোচুলে খেলা করেছে সারা দুপুর। ওর চারপাশে আসা যাওয়া করছে দুরন্ত হিমেল হাওয়া। রঙিন ফুলে ভরে আছে পাথুরে বারান্দা। আকাশের অসহ্য নীল, জঙ্গলের ঘন সবুজ, দিগন্ত বিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা, দৃষ্টিকে মুগ্ধতা দেওয়ার, মনকে আরাম দেওয়ার সব উপকরণই এখানে মজুত। একটু দূরে শ্রীপর্ণা, ঐশিকা আর মীরাদি আড্ডা দিচ্ছে। ওদের আলোচনা ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ে ভায়া জি.এস.টি, নোটবন্দী থেকে বিরাট-অনুষ্কার সম্পর্কের দিকে যাচ্ছে। শ্রীপর্ণার মেয়ে অনুত্তমাও ওদের সঙ্গে এসেছে। অনুত্তমা মিডিয়া সায়েন্স নিয়ে পড়ে। ওদের মা-মেয়ের বন্ধুত্ব দেখলে মোহরের হিংসে হয় আজকাল। শ্রীপর্ণা আর মোহর ছেলেবেলা থেকে একই স্কুলে পড়েছে। কলেজও একই সঙ্গে, তবে শ্রীপর্ণা ইতিহাসের ছাত্রী আর মোহর পদার্থবিদ্যায় স্নাতক। কলেজের বন্ধু সৌগতকে বিয়ে করে শ্রীপর্ণা। ওরা স্বামী-স্ত্রী একই স্কুলে শিক্ষকতা করতো। অনুকে বড় করতে দুই পরিবারের সাহায্য পেয়েছে শ্রীপর্ণা। সঙ্গে সৌগতর সাহচর্য। বেড়াতে আসার আগে খানিকটা মোহরকে শুনিয়েই শ্রীপর্ণা বলেছিল, মীরাদি এত জোর করল যে না বলতে পারলাম না। নাহলে এই বুড়ো বয়সে সৌগতকে ছেড়ে কোথাও যেতে ভাল লাগে না। অর্ক এমনিতে মায়ের ব্যাপারে খুব কেয়ারিং। রোজ দুবার করে ফোন করে। সেই দশ বছর বয়স থেকে মোহরকে ছেড়ে বাবার কাছে থাকে। মোহর তখন আসানসোলে। কলকাতায় ট্রান্সফারের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। একদিকে চাকরি, অন্যদিকে মোহরের অসুস্থ বাবা-মা আর ছোট্ট অর্ক। শুভ চাকুরিসূত্রে কলকাতায় থাকে নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে। স্কুল থেকে দাদুর সঙ্গে ফিরছিল অর্ক, হঠাৎ দাদুর হাত ছেড়ে কুকুরের বাচ্চার পেছনে ছুটতে শুরু করে। সাইকেলের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে মাথা ফেটে যায় অর্কর। তারপর কয়েকদিন হাসপাতাল, ডাক্তার। মোহর দিশেহারা। দিনকয়েক চাপানউতোর। মোহরের শ্বশুর, শাশুড়ি যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন এই ঘটনায়। মনে পড়ে শাশুড়িমা বলেছিলেন, সবাইতো আর সংসার করার জন্য জন্মায় না মোহর। তুমি বরং মন দিয়ে চাকরিটা কর। অর্ক আমাদের কাছেই থাকুক। অসহায় হয়ে অপরাধবোথে কুঁকড়ে গিয়েছিল মোহর। শুধু শুভর কাছে একবার জানতে চেয়েছিল, সে কী চায়? শুভ মোহরকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেনি, শুধু চেয়ে নিয়েছিলো অর্ককে। মোহর প্রতি সপ্তাহে অর্কর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করত। আরো অনেক কিছু চেষ্টা করেছে মোহর। চেষ্টা করেছে ভালো মা হতে, ভালো স্ত্রী, ভালো পুত্রবধূ, ভালো সন্তান, ভালো কর্মী… … অনেককিছু। মোহর আজ ও খুঁজে পায় না ওর অবহেলাটা ঠিক কোথায়?
২৫ শে মে, ২০১৭। সারারাত বৃষ্টির পর একটা ঝলমলে রোদমাখা সকাল এল। আজকে মোহরদের দল সিলারিগাঁও যাবে। দলের সবাই প্রস্তুত হয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করছে। শুধু শ্রীপর্ণাদের ঘরের দরজা বন্ধ। মীরাদি ব্যস্ত হয়ে ওদের কটেজের দিকে গেল। দরজায় টোকা দিতেই অনুত্তমা দরজা খুলে দিল। মীরাদি অবাক হয়ে বলল, একী! তোরা এখনও তৈরী হস্‌নি? যাবি না? মীরাদি রেগে গিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, শ্রীপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। শ্রীপর্ণার চোখে-মুখে ভয় আর রাত জাগার ক্লান্তি।
—কি হয়েছে? মীরাদির চোখে প্রশ্ন। অনুত্তমার কাছে সমস্ত ঘটনাটা শুনে মীরাদি স্তম্ভিত হয়ে গেল। কাল রাতে খাওয়া শেষ হওয়ার পর ওরা যখন ওদের কটেজের দিকে যাচ্ছিল, কে যেন শ্রীপর্ণার গলায় দড়ির মতো একটা কিছু পেঁচিয়ে পেছন থেকে টেনে ধরে। শ্রীপর্ণার গলায় ফাঁস এত জোড়ে আটকে গিয়েছিল যে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না। পাহাড়ি গ্রামগুলোতে প্রায়ই লোডশেডিং হয়। তখন চারদিক ছিল ঘন অন্ধকার। অনুত্তমা বেশ কিছুট দূরে হাঁটছিল। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে জোরে মা বলে ডাকতেই কেউ যেন ছুটে পালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই ওরা হতভম্ব হয়ে যায় যে কাউকে ডাকার সাহস পায় নি। মোবাইলেও অনেক চেষ্টা করেও নেটওয়ার্ক পায় নি। কোনোরকমে কটেজে ফিরে ওরা সকাল হওয়ার অপেক্ষা করছিল। শ্রীপর্ণা আর অনুত্তমা এক্ষুনি কলকাতা ফিরে যেতে চায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুজবে, কানাকানিতে সুইসাইড, অশরীরি আত্মা ইত্যাদির গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বেলা যত বাড়তে লাগল সকলের মনে অজানা ভয় দানা বাঁধতে থাকে। ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করতে ঐশিকা আর মীরাদির দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। হঠাৎ অনুত্তমা বলল মোহর মাসিকে তো দেখতে পাচ্ছি না। ঐশিকা বাইরে বেড়িয়ে দেখতে যাবে…মীরাদি বাধা দিল। বলল, ঐশি তুই বরং ড্রাইভারকে একটা ফোন কর, মোহরকে আমি দেখছি।
হিমশীতল দমকা হাওয়ায় যেন আদিমতা মেশানো গন্ধ। পশ্চিম আকাশের রক্তিম ছটা দূরে যে পাথরটাতে আঁকিবুকি কাটছে মোহর সেখানে একটু ঝুকে দাঁড়িয়ে ছিল। মীরাদি এগিয়ে গিয়ে দেখল সামনেই বিপজ্জনক খাদ।
—তোর কী হল রে মোহর? মীরাদি পেছন থেকে ওর পিঠে হাত রাখলো।
—মাথাটা খুব ধরেছে মীরাদি। তাই আর তোমাদের আড্ডায় গেলাম না। শুকনো গলায় বলল মোহর।
—রিটায়ার করার পর থেকে তুই যেন কেমন হয়ে গেছিস মোহর। অথচ আমাদের টিমে তুই-ই সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছিলিস। তোর মনে আছে মোহর, আমাদের রাজস্থান ট্যুরটার কথা। মাত্র কয়েকদিনের প্ল্যান, তুই একাই সবকিছু অ্যারেঞ্জ করেছিলিস, কোনোদিন তো তোকে এমন নিভে যেতে দেখিনি। এতদিন পরে তুই আর শুভ একসঙ্গে থাকছিস। অর্কও তো ভালো আছে। একটা গোল্ডেন চান্স পেয়েছে। ওর সামনে একটা উজ্জ্বল কেরিয়ার গড়ার হাতছানি। এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে গেল মীরাদি।
বিষন্নভাবে হাসল মোহর— এতদিন না পাওয়াগুলোকে কপটভাবে লুকিয়ে রাখতে শিখেছিলাম, সকলের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় করে দেখাতে চাইতাম আমি একাই ভালো আছি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইতাম আমাকে কী তোমাদের প্রয়োজন নেই..ই..ই..ই…??, আমিও কারো পরোয়া করি না…। ডুকরে ওঠে মোহর। উত্তেজনার দমকে শরীরটা বারবার নড়ে ওঠে। মীরাদি স্তম্ভিত। এত অভিমান মোহরের!
—সবাই কি সবকিছু পায়? তুই তো তবু লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ-এও বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিস। আর আমি… মীরাদির গলা ভারী হয়ে এলো।
— সেই টিকিয়ে রাখাটা যে কত মিথ্যে ছিল মীরাদি, আজ একসঙ্গে থাকতে গিয়ে বুঝতে পারছি। শুভর রোজকার অভ্যেসগুলোর সঙ্গে আমি কতটা পরিচিত বল? এই না জানাটাও আমাকে… আমাকে… চুপ করে গেল মোহর। মুহুর্তে মনে হল ও কি চেয়েছিল শুভ ওকে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলুক? মনের কোনো কোণে এমন একটা ভালোবাসার দাবী, অধিকার কি চেয়েছিল মোহর? জানে না। এখন যেন সব কেমন ওলটপালট হয়ে যায়। সম্পর্কহীনতার ভার, এই শূন্যতা যেন ক্লান্ত করে দেয় ওর স্নায়ুগুলোকে। একা, নি:শ্চুপ বসে থাকে মোহর। আলো চলে যায়, অন্ধকার আসে। সময় তার পা ফেলে এগিয়ে যায়।
২৮শে মে, ২০১৭। আজ সকালে মীরাদির কাছ থেকে জরুরি ফোন পেয়ে শুভ তার বাড়িতে এসেছে। শুভকে চা দিয়ে মীরাদি বলল, তোমার হাতে সময় আছে তো?
—হ্যাঁ, আমি তো এখন কর্মহীন, হাতে প্রচুর সময়। কেন বলুন তো? শুভ কৌতূহলি হয়ে ওঠে। মোহরের মধ্যে কিচু অস্বাভাবাবিকতা লক্ষ্য করেছ? শুভর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল মীরাদি। মাথা নেড়ে শুভ বলল, ইদানিং ও বড় বেশি চুপচাপ থাকে। আসলে আমরা তো বরাবরই আলাদা থেকেছি। পুরোনো জায়গাটা ছেড়ে এসে ওর বোধহয় একটু ডিপ্রেস্‌ড লাগছে। মাস খানেক আগে একদিন বলল… তোমার অফিস যাওয়ার সময় হল, টিফিন গুছিয়ে দিয়েছি। আবার আজ সকালে উঠে হঠাৎ বলল, আজ তো অর্কর স্কুল আছে, ওকে রেডি করতে হবে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মোহর তুমি এসব কী বলছ? তখনই কেমন একটা শান্ত আর বিষন্ন হয়ে গেল। মীরাদি চশমাটা টেবিলের উপর রেখে কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল। তারপর হতাশ গলায় বলল একজন মনস্তত্ত্বের অধ্যাপিকা হয়ে বলছি শুভ, মোহর কঠিন মানসিক রোগে আক্রান্ত। ওর ভাল চিকিৎসার প্রয়োজন। তুমি জানো, যে জন্য আমাদের ফিরে আসা… ওই শ্রীপর্ণাদের ঘটনাটা… ওটা মোহরেরই কীর্তি। চমকে উঠল শুভ। মীরাদি না থেমেই বলতে লাগল, আমি আর মোহর একই কটেজে ছিলাম। রাতে চট করে আমার ঘুম আসে না। সেদিন আমি খেতেও যাই নি। শরীর ভাল ছিল না। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে মোহর ঘরে ঢোকে। কী যেন বিড়বিড় করে বলতে থাকে। আমি চোখ মেলতেই কিছু লুকোবার চেষ্টা করছিল। প্রশ্ন করতে কোন উত্তর দিল না। পরের দিন ওর ব্যাগে একটা ওড়না দেখতে পাই, অদ্ভুতভাবে সরু করে পেঁচানো। বুঝতে পারলাম যে আগের রাতের কান্ডটা ওই ঘটিয়েছে। গোটা রাস্তা আমি ওকে আগলে নিয়ে এসেছি। এই ধরনের রুগিরা মাঝেমধ্যেই হিংস্র হয়ে ওঠে। তুমি ওকে বাঁচাও শুভ। আর হ্যাঁ, ও পুরোনো জীবন ফিরে পেতে চাইছে। ও যখন অতীতে ফিরে যাবে…হয়তো ছোট্ট অর্ককে দেখতে পাবে, ওকে বাধা দিয়ো না। ওষুধের পাশাপাশি তোমাকে এই অভিনয়টুকু চালিয়ে যেতে হবে। শুভকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মীরাদি বলল, আমি তোমার পাশে আছি।
১৫ই জুন, ২০১৭। মোহরের দিন চলতে থাকে স্মৃতি ও বিস্মৃতিকে ঘিরে। অতীত, বর্তমান মিলেমিশে যেন এক রঙ। মোহর এখন কলকাতার নামী মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীন। ওষুধ চলছে। কিছুদিনের মধ্যে কাউন্সেলিং শুরু হবে। অর্ক এসেছে। কিন্তু মোহর অর্ককে চিনতে পারে না। তার অবসাদের অপরাহ্নগুলোতে আকাশ চুঁইয়ে পড়া মায়াবী আলোয় শুধুই অতীত। ছোট্ট অর্ক, পিঠে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা অফিস যাওয়ার সময় শুভ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। আর মোহরকে বলছে, তুমি রেডি হলে, মোহর? তোমাকে অফিসে পৌঁছে দিতে হবে তো? একটা সুখী পরিবার। কোথাও কোনো দূরত্বের কাঁটা নেই, নেই বিচ্ছেদ। সবকিছু পরিপাটি। সুখ, দু:খ, রাগ-অভিমান-নৈকট্য সব সাজানো। বছর ছত্রিশের পূর্ণ যুবক শুভ। সুঠাম, দায়িত্ববান এক পুরুষ। মোহরও ঘরে-বাইরে দুদিক সামলে সুগৃহিনী, সদাসতর্ক স্নেহময়ী মা। ফেলে আসা জীবনের সমস্ত বাধা-বিরোধ, অভাব, অভিযোগ, দ্বন্দ্ব ইরেজারে ঘষে ঘষে মুছে দিয়েছে মোহরের অবচেতন মন। কারেকশন পেন দিয়ে ভুল কালো অক্ষরগুলোকে সাদা করে দিচ্ছে মোহর। আঁকছে নতুন ছবি। মোহরের চারপাশে কুড়ি বছর আগের এই চরিত্ররা ঘোরে, ফেরে। শোবার ঘরে বিছানায় শুয়ে দুষ্টু অর্ক, ওকে ঘিরে মোহর আর শুভ।একষট্টি বছরের মোহর আর শুনতে পায়না অ্যালার্মের শব্দ। আর কেউ বলে না, ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। চুলে পাক ধরা, একটু স্থুল চেহারার অন্য এক শুভ তাকে ওষুধ খাওয়ায়, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দেয়। ভাত বেড়ে দেয়। চুল বেঁধে দেয়। স্নানের কথা মনে করিয়ে দেয়। ডাক্তার বলে এ এক অসুখ, গভীর অসুখ। ইলিউশন, হ্যালুসিনেশন, সাইকোসিস শব্দগুলোয় প্রেসক্রিপশন ভারী হয়ে ওঠে।
২রা ফেব্রুয়ারী, ২০১৮। কাল বিকেলে মোহর ওদের বাড়ির উঠোনে দুটো রঙ্গন চারা লাগিয়েছে। নীচের তলার ঘরগুলো সারাইয়ের কাজ চলছে। এখানেই ওরা অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম শুরু করতে চলেছে। ওষুধ, কাউন্সেলিং সবকিছুকে ছাপিয়ে ফুলের মত শিশুদের সান্নিধ্য ওকে জীবনের মূলস্রোতে একটু একটু করে ফিরিয়ে আনছে। মোহরের এই নতুন সুখী পৃথিবীতে এ এক ভালোবাসার সকাল। অপরাজিতা ফুলের মত নীল আকাশের ক্যানভাস। বারান্দায় অপার্থিব আলো, বসে আছে মোহর। হালকা শীতে দুকাপ চা নিয়ে এসে পাশের চেয়ারটাতে বসে শুভ। সকালের এফ.এম. এ অনেকদিন পর অনুপম রায়ের ওই গানটা বাজছে—
তোমার চোখ মেঘলা হোক/ তোমার কথাই বলছে মন/ আঙুল ছোঁয়া মুদ্রাদোষ/ তোমার কথার খুব ওজন/ হাজার করতালি, তোমায় বলে খালি/ তোমায় নিয়েই গল্প হোক… …
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।