গল্পকথায় পার্থ রায়
সেদিন শ্রাবণে
“এই বৃষ্টিতে কি না গেলেই নয়? পরশু কলেজে গেলেই তো নিয়ে নিতে পারতিস, রুমি”- সুনেত্রা মেয়ের ঘরে এসে বলল।
চটপট চুলে একটা ক্লিপ লাগিয়ে হর্স টেইল করে নিতে নিতে রুমঝুম বলল, “ নো, মাম্মি, আই মাস্ট গো। ওই নোটসগুলো ভেরি মাচ ইম্পরট্যান্ট টু মি। সেমিস্টার একজামে লাগবে”।
“কী জানি বাপু, আমরা যেন আর পড়াশুনা করিনি। দয়া করে ছাতা আর সেলফোনটা নিতে ভুলবেন না, মহারানী”- গজগজ করতে করতে সুনেত্রা কিচেনে চলে গেল।
সত্যি এই বিচ্ছিরি ওয়েদারে ঝিলমের কাছ থেকে নোটস নিতে যেতে হবে ভাবতেই মুড অফ হয়ে গেল রুমঝুমের। বাবা অফিসে। বাড়ীতে শুধু মা আর রুমঝুম। খালি ঘরে নাইটিটা খুলে ব্রাটা গলাতে গলাতে আয়নার সামনে নিজের নগ্ন রূপ একবার দেখে নিল। সাধারণত এটা ও বাথরুমে করে। নিজের নিখুঁত সৌন্দর্যকে নিসুতো দেখা। কারণ ও খুব ভালো করে জানে ও যথেষ্ট সুন্দরী। ছেলেদের চোখের মুগ্ধ অথবা হ্যাংলা দৃষ্টি, গায়ে পড়ে আলাপ করার আকুলি বিকুলি, ইম্প্রেস করার জন্য হুড়োহুড়ি। এসব তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে রুমঝুম। বাট ঝিলমবাবু, তুমি সেই কোন দুরের জেলা থেকে এসে কোলকাতার স্মার্ট ছেলেদের সাথে কম্পিটিশন করবে? মুখ বেকাল রুমঝুম। নামের বাহার আছে- ঝিলম। জলপাইগুড়ির গাইয়া ভূত, পাট কাঠির মতো চেহারা। একগাল দাঁড়ি নিয়ে কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব। তবে হ্যা একটা জিনিষ ওর ভীষণ সুন্দর। দুটো স্বপ্নালু চোখ। ব্যাপক। যেন মুখে কিছু না বলেও, অনেক কিছু বলে। ক্লাসে মাঝে মাঝেই ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। একটা অস্বস্তি হয় ঠিকই বাট খারাপ লাগে না রুমঝুমের। ছেলেদের মনোযোগ পেতে কোন সুন্দরী মেয়ে না চায়?
একটা কুর্তি গলিয়ে নিয়ে জিন্সটা পরতে যেতেই খেয়াল হল, প্যানটিই পরা হয়নি। যাহ কলা! তাড়াতাড়ি প্যানটি পরে নিল। জিলা স্কুল থেকে স্ট্যান্ড করেছে হায়ার সেকেন্ডারিতে। ফিফথ না সিক্সথ কি একটা জানি। ইতিমধ্যেই স্যারদের সুনজরে। তাই মালটাকে হাতে রাখতে হবে। খেপালে চলবে না। একটু নাহয় তাকালই, তাতে কি আর বুবসের সাইজের হেরফের হয়ে যাবে, না কি বুবস দুটো মাসীমাদের মতো হয়ে যাবে? ভাবনাটা মাথায় আসতেই খালি ঘরে আয়নার সামনে একচোট খুকখুক করে হেসে নিল রুমঝুম।
ফোন করে বলেছিল রুমঝুম হোয়াট্স অ্যাপে সেন্ড করতে কিন্তু নট পসিবল বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিল গাইয়াটা। ঠিক মতো কথাও বলতে শেখেনি মেয়েদের সাথে। রুড! গান্ডু! ম্যানারস জানে না। রাতুল, ইমনদের কোন কিছু বললে পুরো লাইফ ইনভেস্ট করে ফেলে রুমির হুকুম তামিল করার জন্য, আর তুই কে রে এলি তেলি হরিদাস? হোয়াট্স অ্যাপ কি জিনিষ জানে না বোধ হয়, শুধু পড়াশুনাই করেছে। বাধ্য হয়ে রুমঝুম আবার ফোন করে সাউথ সিটি মলের সামনে আসতে বলেছিল।
ভুতটা সাউথ সিটি মল চেনে তো? বৃষ্টিটাও যেন নাছোড়বান্দা হয়ে আছে। ঝরেই চলেছে, ঝরেই চলেছে, থামার কোন লক্ষণই নেই। তার মধ্যে একটু বর্ষা হলেই কোলকাতার রাস্তা ঘাটের যা অবস্থা হয়। কবে যে এই প্ল্যাস্টিক ইউজ বন্ধ হবে? মাঝে মাঝে প্রসাশনের বাই চেগে ওঠে। কদিন একটু হৈচৈ তারপরে আবার যেই কে সেই। কতো প্যারাগ্রাফ, কতো প্রোজেক্ট করেছে রুমঝুমরা এই প্ল্যাস্টিকের খারাপ এফেক্ট নিয়ে। এক একজন বোধ হয় প্ল্যাস্টিক বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে। লাভ কী হল? সেই অশ্ব ডিম্ব প্রসব। আসলে, প্রোডাকশন বন্ধ না হলে কিসসসু হবে না।
ইস! হাঁটুর নীচ থেকে প্যান্টটা পুরো ভিজে গেছে। কুর্তির হাতা দুটোরও একই দশা। ছাতা নামেই। শুধু মাথাটুকু বাঁচে।
যাক, বাবু আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে। তবু ভাল, দেরী করে এলে না গান্ডুটার….. নাহ! সত্যি কলেজে ভর্তি হবার পরে মুখটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।
“এনেছিস নোটসগুলো?
“ইস! তুই একেবারে ভিজে গেছিস রে”
ও বাবা! ভরা বাদলে বাবুর ভদ্রতা বোধ চেগে উঠেছে। গা জ্বালানো কারসি। একটু রুক্ষ ভাবেই বলে, “তোকে তো হোয়াট্স অ্যাপে সেন্ড করতে বলেছিলাম। সেটা পারতিস না?”
“হুম। পারতাম। তাহলে এই রিমঝিম বর্ষায় তোর রিমলেস গ্লাসে আটকে থাকা দুঃসাহসিক ফোঁটাটা দেখতে পেতাম? দেখতে পেতাম তোর হর্স টেইল বেয়ে গড়িয়ে পড়া শ্রাবণের ধারা? দেখতে পেতাম ভেজা কবিতার মতো তোর এই রূপ? তোর শরীর থেকে আসা বৃষ্টির গন্ধটাও যে মিস করতাম রে, বৃষ্টিস্নাতা”। একটা ঘোরের মধ্যে বলে গেল ঝিলম। আর ওর দুটো স্বপ্নালু চোখের সম্মোহনে কাঁচপোকার মতো আটকে যায় রুমঝুম। আশৈশব ইংরেজি স্কুলে পড়া স্মার্ট রুমঝুম। ভেতরে এক তুমুল প্রলয়। বুকের ভেতর যেন একঝাঁক নানা রঙের প্রজাপতি মুক্তির জন্য ছটফট করছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বৃষ্টিস্নাতা? হাউ রোম্যান্টিক! এতো সুন্দর নাম হয়? নাম তো নয়, যেন একটা ভেজা কবিতা। এমন করে রাতুল, ইমন, কৌশিকরা তো কোনদিন বলতে পারেনি। আপ্রাণ চেষ্টা করেও ওর ভাললাগাকে মুখের ওপর বসা থেকে আটকাতে পারছেনা রুমঝুম। ক্রমশ লালাভ হয়ে উঠছে ওর গাল দুটো। ভেতর থেকে আর একটা রুমঝুম বিড়বিড় করে অনবরত বলে চলেছে, “ বৃষ্টিস্নাতা, বৃষ্টিস্নাতা, বৃষ্টিস্নাতা”। অন্তরে, বাইরে ভিজে যাচ্ছে রুমঝুম।