ক্ষিদে

বিরাট বড় শপিংমল,ঝাঁ চকচকে,আলোয় আলোময়।কত লোক কত বিচিত্র পোশাকের রঙ্গিন মানুষেরা আসছে,যাচ্ছে,চলমান স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে যাচ্ছে নামছে।মলের নামটা বেশ যুতসই রেখেছে মালিক ‘ স্বর্গ’।
তা সেই স্বর্গে প্রবেশের আগে দ্বাররক্ষক সবাইকে মেপে নিচ্ছে, কেউ কিছু অবৈধ মালপত্র নিয়ে ঢুকছে কি না। অবৈধ মন ছাড়া তার তীক্ষ্ণ নজর আর হাতে ধরা মেশিনে বাকি সবই ধরা পড়ে যায়।অবৈধ মন অধরাই থেকে যায়।মাঝে মাঝে মনে হয় এটা শপিংমল না বিমান বন্দর? জানি ওদেরও কিছু করার নেই,চারিদিকের যা আবহাওয়া, কখন কোথায় গোলমাল শুরু হয় তার ঠিক নেই।
আমরাও ঢুকি,দ্বাররক্ষকের ছাড়পত্র পেয়ে।কিছুটা কেনাকাটা করার জন্য,কিছুটা সময় কাটানোর জন্য। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে সময় কাটানো একটা বিরাট সমস্যা।যে সময় আগে ঘোড়ার পিঠে বসতো এখন সে বাহন পাল্টে শামুককে বেছে নিয়েছে।তাই ইদানীং শপিংমলে যাওয়া অভ্যেস করেছি এই দু তিন মাস হল।আমরা মানে আমি আর আমার স্ত্রী। আগে আগে একটাই ছুটির দিন ছিল,রবিবার।সে দিনটাতে আর কোথাও যেতে ভালো লাগতো না একান্ত বাধ্য না হলে,আর এখন আমার প্রত্যেকটা দিনই রবিবার।কাজেই এখন যে কোনো দিনই” কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা”…
তা সেদিন কি হল ছেলে,বৌমা,নাতি,নাতনি গেছে মান্দারমনি বেড়াতে চারদিনের জন্য।
সেদিন বিকেলে গেছিলাম মলে।কখনও ফুডকোর্টে উঠিনি চারতলায়।ভাবলাম নাতি নাতনিরা তো খুব পিজ্জা পিজ্জা করে,আমাদের জন্য নিয়েও আসে।তা বাড়িতে বসে খেয়েওছি,আজ দেখি এখানে বসে খেয়ে কেমন লাগে।কাজের মেয়ে মালতী আসবে সন্ধ্যাবেলায় তার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ,সোজা চলে গেলাম চারতলায় ফুডকোর্টে।মুখোমুখি বসে এই বয়সে সত্যিসত্যিই একটু লজ্জা লাগছিল,আবার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল।তবে আশেপাশে আমাদের মত বয়স্ক কিছু দম্পতিকে দেখে লজ্জা কাটতে সময় লাগল না বেশি ক্ষন।
খাওয়াদাওয়া শেষে অঞ্জনা বলল ‘ মালতীর জন্য একটা নিয়ে যাবো?’
অঞ্জনার আবার দয়ার শরীর তবু বলি ‘ দেখো ওরা এসব খায়নি,খেয়ে শরীর খারাপ হলে আমাদেরই দায়ী করবে,আর তাছাড়া কালবা কদিন না এলে তোমারই তো বেশী অসুবিধা। ‘
আমার প্রতিবাদ এক কথায় নস্যাৎ করে অঞ্জনা বলে’ মালতী সে রকম মেয়েই নয়।’
‘ তবে আর কি নিয়ে চলো’।
বাড়ি ফেরার একটু পরেই মালতী রান্না
করতে এলো।কাজ শেষ এর পর অঞ্জনা পিজ্জার প্যাকেটাট ওর হাতে তুলে দিয়ে বলে ‘ মালতী এটা খাস,ছেলমেয়েদের নিয়ে।’
‘ কি গো এটা মাসীমা?’
‘ একে বলে পিজ্জা,খেয়েছিস কখনও?’
‘না গো, কোথা থেকে আনলে গো?’
‘ ঐ যে একটা মল করেছে না বাইপাসের ধারে স্বর্গ বলে’।
বুকভরা নিঃশ্বাস টেনে মালতী বলে’ কি সুন্দর বাস গো মাসীমা।অনেক দাম তাই না?’
‘ কি হবে তোর দাম নিয়ে?’
‘ না,তা নয়।মাসীমা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’.
‘কর’
‘ মাসীমা,ঐ যে ছগ্গমল না কি বললে,ওখানে পান্তাভাত পাওয়া যায়?এ রকম বাস ছড়ায় পান্তা থেকে? বাড়ির পান্তা খেয়ে খেয়ে মুখ পচে গেল মাসীমা।’
অঞ্জনা হতবাক হয়ে মালতীর দিকে তাকিয়ে থাকে।বলে ‘ দুর বোকা অত উঁচুতে খাবার দোকান,প্রায় মাঝ আকাশে।ওখানে তো শুধু স্বর্গীয় খাবারই মেলে,দামও আকাশছোঁয়া।
ভাত তো মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষদের জন্য।আমরা একদিন শখ করে…..’ মাঝপথে কথা থেমে যায় অঞ্জনার।
আমি জানালা দিয়ে আকাশ  দেখি,দেখি পরপর সাজানো ইট বালি সিমেন্টের ইমারত ক্রমশঃ পিজ্জা তো দুরের কথা, গোটা আকাশটাকেই গিলে খেতে যাচ্ছে।কিছু মানুষের ক্ষিদে ক্রমশঃ দিন দিন বেড়েই চলছে।।