• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় ছবি ধর

অভাবের আগুন

প্রতিদিনের মতো আজকেও স্বামী সন্তানকে ঘুম থেকে ডাকতে এসে দেখে বাবাকে দুপাশ থেকে দুজন জাপ্টে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে l
দয়া অনেক সকাল সকাল উঠে সংসারের কাজ করে l উঠোনে ঝাড়ু দিয়ে, ঘর দোর ঝাড়াপোছা করে বাসন মাজে তার পর স্নান সেরে, জল তুলে ,তুলসীতলায় ফুল জল দিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে তবে সুশীল আর টুপুর কে ডেকে , দিপুকে কোলে নিয়ে মুখ ধুইয়ে বাটিতে একটু দুধ মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসিয়ে দেয় l নিজেই চামচ দিয়ে খেতে থাকে ছোট্ট দিপু l
সে ঘরের চালে নিজের হাতে লাগানো গাছের নাগালে পাওয়া পুইশাকের কয়েকটা ডগা আর একটা ছোট চালকুমড়ো তুলে এনে সবজির ঝুড়িতে রাখে l চালকুমড়োগুলো বেশ বড়ো হলে বাজারে বিক্রি করতো গেলোবছরের মতো কিন্তু এবছর লকডাউনের জন্য নিজেরাই রান্না করে খাচ্ছে এই দুঃসময়ে l
দয়া বারান্দায় বসে চিরুনিটা দিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে আর ভাবে কিভাবে চলবে আগামী দিনগুলো l এই একমাস তো রেশনের চাল ডাল আটা আর জমানো ওই হাজার খানেক টাকায় কোনোমতে তেল মসলা সবজি, দিপুর দুধ কিনে মাত্র এক দুদিন ডিমের ঝোল খেয়েছে l কিন্তু লকডাউন যদি আরও বাড়ে তাহলে কিভাবে খরচের টাকা আসবে ? আর হাতের টাকাও শেষ হওয়ার পথে l
চিন্তায় মন টা ভারী হয়ে আসে দয়ার l
টুপুর উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বায়না করে —–মা মা কতদিন ভালো কিছু খাইনি ,আজ বাবাকে বলোনা মাংস আনতে ; শাক আর কুমড়ো খেতে ভাল লাগেনা রোজ রোজ l মেয়েকে কাছে টেনে দয়া হাতের চিরুনিটা দিয়ে টুপুরের চুলের জট ছাড়িয়ে বিনুনি করে দেয় l টুপুর এবছর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে পাশের সরকারি স্কুলে l দিপু আর টুপুর দুবছরের ছোটবড়ো l
দয়া দাও দেখি চা খেয়ে যাই আজতো দোকান খোলার নির্দেশ এসেছে l
দয়া চা আর এক বাটি মুড়ি বাতাসা এনে সুশীলকে দিয়ে বলে — ও তাই বুঝি ? একটা আশার আলো ঝিলিক মারে দয়ার চোখেও l
দয়া অনুনয় করে বলে ‘শোনোনা আজকে একটু মানে মেয়েটা বলছিলো ওর মাংস খেতে ইচ্ছে হয়েছে যদি পারো আনতে l ‘
সুশীল মুড়ি খেতে খেতে হাসে আর মনে মনে ভাবে আজকে আনবেই মাংস ; ওর নিজেরও খেতে ইচ্ছে করছে খুব কতদিন খায়নি l
তুমি মাংসের জন্য পেঁয়াজ লঙ্কা আদা রসুন বেঁটে রেখো l বাচ্চাদের দেখে রেখো আসি আমি l দেরী না করে সুশীল বেরিয়ে পড়ে সাইকেল নিয়ে lপ্রায় ছয় কিলোমিটার প্যাডেল মেরে পৌঁছতে হবে দোকানে l
বেলা বারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট একজনও খদ্দের এলোনা আজ l সেই কোন সকালে দোকান খুলে ধোয়া মোছা করে ধুপ জ্বালিয়ে বসে আছে l কি করবে ভাবতে ভাবতে ওর কান্নায় গলার কাছটা যেনো কেমন করে উঠলো, মেয়েটার করুণ মুখটা ভাসছে l জীর্ণ ছোট্ট একচালা দোকান কিন্তু চলতো মোটামুটি লোকজন আসতো সুশীলের কাজের সুনামও ছিল এই করোনা আসতেই সব কেমন পাল্টে গেলো !
কে আসবে ওর দোকানে ! ছোঁয়া বাঁচিয়ে জিনিস কেনা যায় কিন্তু —
বাইরে লকডাউন আর ঘরে অভাবের আগুন l
কার কাছেই বা ধার চাইবে ! না না সে ভাবতে পারে না আর l
দোকানে টাঙানো ভগবানের ছবিটা মুছতে গিয়ে সুশীলের মনে হলো ঈশ্বরের যেনো চোখ দুটো ভেজা ভেজা তবে কি ঈশ্বর ও কাঁদেন ?
ভাই দোকান বন্ধ করিসনি বেশ নে নে কাট তো চুলগুলো কত বড়ো হয়েছে দেখেছিস ? পেছন থেকে ডাকটা শুনে সুশীল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সাবিরভাইকে l এই শহরেরই একজন সমাজকর্মী খুবই ভালোমানুষ l
বরাবর ওর সেলুনেই চুল দাঁড়ি কাটান l বসুন দাদা বলেই সুশীল তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে মাস্ক টা পড়ে ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম করে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানায় ঈশ্বরকে l
কাল থেকে রমজান মাস বুঝলি তাই চুল কাটতে এলাম তোর দোকান খোলা দেখেই l কাল থেকে রোজা শুরু হবে আমাদের l
সুশীল নিজের কাজ করে যত্নের সাথে l
আজকে দাড়ি কেটে একটু মেসাজ করবি তো ভালোকরে কতদিন বন্ধ ছিল l
সুশীলের চোখের জল সাবির ভাইয়ের ঘাড়ের ওপর পরে সে তাড়াতাড়ি মুছে দেয় বুঝতেও পারবেনা সাবির ভাই ,ভাববে চুলকাটার আগে দেওয়া জল l
কিন্তু সামনের আয়নাটা গোপন কান্না দেখে ফেলে l

সাবির দুশো টাকার দুটো নোট দিলে সে বলে দাদা এখন তো 50 টাকা খুচরো নেই আপনি খুচরো দিন ,আজকে কেউ আসেনি সকাল থেকে l
রেখে দে তোর কাছে ওটা আর শোন বাচ্চাদের জন্য একটু ভালোমন্দ কিনে নিয়ে বাড়ী যা অনেক বেলা হলো, আমিও স্নান করি বাড়ী গিয়ে l

সুশীল জোরে জোরে প্যাডেল মেরে বাতাসের আগে বাড়ীর দিকে ছুটছে l সাবির তখনো
দাঁড়িয়ে – ঝাপসা ভেজা চোখে দেখে আর বলে আলহামদুলিলাহ l

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।