কুন্তী আর দ্রৌপদীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব আত্মগোপন কালে ঘুরছে ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তরে। এমনি একদিন শিলাবতী নদীর পাড়ে যুধিষ্ঠিরের সাথে দেখা হল এক ক্রন্দনরত বৃদ্ধের। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল নদীর অপর পাড়ের জঙ্গলে এক রাক্ষসের বাস। এই গ্রাম থেকে প্রতিদিন একজন মানুষকে তার খাদ্য হতে হয়। আগামীকাল ওই বৃদ্ধের সন্তানের পালা। যুধিষ্ঠির তাকে আশ্বস্ত করল এই বলে যে তাদের পাঁচ ভাইদের একজন পরেরদিন বকরাক্ষস এর কাছে যাবে। হাসি ফুটল বৃদ্ধের মুখে।
রাত কাটল। বেশ হৃষ্টপুষ্ট একজন মানুষকে আসতে দেখে বকরাক্ষস ভারি খুশি। কিন্তু অচিরেই আনন্দ পরিণত হলো আশঙ্কায়। শিলাবতীর পাড়ে বকরাক্ষস আর ভীমসেনের মধ্যে প্রবল যুদ্ধে রাক্ষস বিনাশ হল। কিন্তু নদীর পাড়ে বিস্তীর্ণ ভূভাগ ক্ষতবিক্ষত হয়ে রয়ে গেল যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন রূপে। আর এভাবেই জন্ম নিল ‘বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ নামে পরিচিত ‘গনগনির ডাঙ্গা’।
অতি গভীর ‘I’ আকৃতির নদীখাতকে ক্যানিয়ন বলে। শুষ্ক জলবায়ুতে নদী পার্শ্বক্ষয় কম করে। মূলত: নিম্ন ক্ষয় করায় নদী ক্রমশ গভীর খাত বা ক্যানিয়ন গঠন করতে পারে। এইরূপ ক্যানিয়নের সর্বাধিক পরিচিত উদাহরণ হল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা প্রদেশের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। সেখানে কলোরাডো নদী তার গতিপথে প্রায় ৪৪৬ কিমি দীর্ঘ, ৬.৪ থেকে ২৯ কিমি প্রশস্ত এবং ১.৮ কিমি গভীর যে নদীখাত গড়ে তুলেছে তাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নামে পরিচিত।
অপরদিকে আমাদের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় গড়বেতা স্টেশন থেকে কয়েক কিমি দূরে শিলাবতী নদীর দক্ষিণ তীরে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে জলধারা, বাতাস প্রভৃতির দ্বারা ক্রমাগত ক্ষয়ে অদ্ভুতদর্শন বন্ধুর ভূপ্রকৃতি গড়ে উঠেছে। এই প্রকার ভূমিরূপ ভূগোলের ভাষায় ‘Badland’ বা খোয়াই নামে পরিচিত। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে লিলিপুটে পরিণত করলে যেরূপ পরিবর্তন ঘটে, তেমনি অতি বন্ধুর উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলকে মনে মনে মিনিয়েচার রূপ দিলে এই ব্যাডল্যান্ডের চেহারা খানিকটা মালুম হয়। শান্তিনিকেতনে সোনাঝুরির জলধারার পথ ধরে হাঁটার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝে গেছেন।
আসলে শিলাবতীর তীরবর্তী এই এলাকায় ভূমিভাগের উপরে রয়েছে কঠিন রক্তাভ ল্যাটেরাইটের স্তর। পৃথিবীর ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলসমূহ, যেখানে আর্দ্র ও শুষ্ক ঋতু পর্যায়ক্রমে আসা-যাওয়া করে, সেখানে মাটির উপরের স্তর থেকে সিলিকা ও ক্ষারক জলের সাথে গভীরে অপসারিত হয়। ফলে উপরাংশে লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড ক্রমাগত সঞ্চিত হয়ে ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথর গঠন করে। এর উপর থেকে বনভূমির আচ্ছাদন সরে গেলে ল্যাটেরাইট অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে, যাকে ‘Duricrust’ বলা হয়। এর ভিতরে থাকে ছোট ছোট দানা বা ‘Pisolith’।
গনগনি অঞ্চলে উপরে ১থেকে ১.৫ মিটার গভীর কঠিন ল্যাটেরাইটের স্তর রয়েছে। এর নিচে আছে প্রধানত অপেক্ষাকৃত নরম কাদা ও বালি জাতীয় পদার্থের স্তর। বর্ষাকালে জলধারা নদীর দুপাশ দিয়ে নেমে আসে। ল্যাটেরাইট কঠিন হলেও এতে অনেক ফাটল থাকে। জলধারা ফাটলের মাধ্যমে নিচের তুলনায় নরম স্তরকে দ্রুত ক্ষয় করে। ফলে ‘cap’ জাতীয় টুপির মতো ল্যাটেরাইটের স্তর উপরে ঝুলতে থাকে। নরম স্তরে সরু, মোটা, গভীর প্রভৃতি বিভিন্ন মাপের নালা পথ তৈরি হয়। এদের আকৃতি অনুযায়ী রিল, গালি, র্যাভিন প্রভৃতি বিভিন্ন নামে ভূগোলশাস্ত্রে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বর্ষা ছাড়া অন্যান্য সময়ে এগুলি শুষ্ক, গভীর, সংকীর্ণ গোলকধাঁধার মতো জটিল পথবিন্যাস রচনা করে। এরা এক-দুই মিটার থেকে ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত গভীর হয়। কিছুটা এই প্রকারের ভূমিরূপ চম্বল অঞ্চলে আরো গভীর ও আরো ব্যাপকভাবে দেখা যায় যা ‘বেহড়’ নামে পরিচিত এবং একসময় কুখ্যাত ডাকাতদের মুক্তাঞ্চল রূপে খ্যাত। যাইহোক এই ভুলভুলাইয়ায় প্রকৃতির খেয়াল খুশির ক্ষয়কাজে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে নিলে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় ছোট ছোট গুহা, শিবের জটা, ডাইনোসর বা বুনো মোষের চেহারা ইত্যাদি।
চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক অচল সিংহ একসময় ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে ছিল এই গনগনির চোরাপথে। স্থানীয় রাজা ছত্র সিংহ তাকে ধরিয়ে দেয়। গনগনির মাঠেই অচল সিংহ ও তার সঙ্গী সাথীদের ফাঁসিতে চড়ানো হয়।
গল্পকথা, ইতিহাস এসব বাদ দিলেও গনগনির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিছু কম নয়। নীল আকাশের নিচে টকটকে লাল ল্যাটেরাইট, তার নিচে সাদাটে মাটি, শিলাবতী নদীর বুকে হলুদ বালুচর, আয়নার মতো জলধারা, চারপাশে সবুজ ঘাস, কাজু আর শাল-পলাশের বন এবং সর্বোপরি লুকোচুরির গোলকধাঁধা মন কেড়ে নেয় সহজে। আর বেলাশেষে গনগনির ডাঙায় উঁচু পাড়ে বসে সিঁদুর মাখা সূর্যটার খুনখারাপি রঙের খেলা দেখতে দেখতে একে “বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন” ভেবে নেওয়ার কাজটা বড় সাবলীল ও অনায়াস হয়ে যায়।