গদ্য বোলো না -তে রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

দুপুরের গর্ভে কবিতারা
নির্জন দুপুরের একটা নিজস্ব ভাষা আছে ৷ নিস্তব্ধতার ভাষা ৷ সে ভাষায় মিশে যায় হিজল গাছে বসে থাকা তিতিরের ডাক ,হাঁড়িচাঁচার বিরামহীন কণ্ঠ ,অলস ডাহুকীর ভেজা ডানার শ্লথ ওঠা নামার শব্দ ,দেয়াল ঘড়িটার টিকটিক কিংবা হেঁকে যাওয়া ফেরিওয়ালার বাহারিয়া সুর ৷ মন কখনও হয়ে যায় ডাকহরকরার অমল ,ঐ বুঝি দইওয়ালা এল সামনের পথ ধরে ,আবার কখনও বা নষ্টনীড়ের চারুলতা -অপরাহ্নের তরুতলে ,রহস্যময় ছায়াপাতে অমল ঠাকুরপোর সাথে সাহিত্যের মাদকরস পান ,আর মন্দাকে ঠকাতে ছকে ফেলা পরিকল্পনা, “অমল ,গোটা কতক আমরা পেড়ে নিয়ে যেতে হবে ,নইলে মন্দাকে কি হিসেব দেব ? “৷ নির্জন দুপুরের বুকের ভিতরে চলে বাতাসের কানাকানি ৷ ডালপালা কিংবা পাতার মৃদু কম্পন সবকিছু শব্দের রূপ পায় , একাকী দুপুরের আঙিনাতে ৷ দূর দূরান্তে গাছের ছায়ায় রাখাল ছেলের মোহন বাঁশী ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের গোপন ঘর ৷ কখনও ঝরে পরা শিউলির গন্ধ, কখনও বেল ,জুঁই ,বকুল ,কখনও আবার হাসনোহানার সুবাসে নেশা জাগে ,অনুভূতিগুলো অবশ হয়ে আসে ৷ বৌ কথা কও পাখি ,কেবলই ডেকে যায় -“বৌ কথা কও -বউ কথা কও “,লজ্জায় রাঙা হয় অনূঢ়ার কপোল |অপরাহ্নের সূর্য সোনা ঝরায় নদীর বুকে , সেই সোনালী জলে মাঝি দাঁড় বেয়ে যায় ছলাত্ ছলাত্ শব্দে ,গেয়ে চলে ভাটিয়ালী , নির্জন দুপুর হয়ে ওঠে আরও রহস্যময় ৷ বসন্তের কোকিল ডেকে চলে অবিরাম ,তার স্ত্রী সঙ্গীনির সাথে সঙ্গমের অভিপ্রায়ে ৷ শ্যামলী গাইটা সবুজ কচি ঘাস চিবোতে চিবোতে , ডেকে ওঠে পরিতৃপ্তির ডাক ৷ আপরাহ্নের আমবাগানে ডানপিটেদের ফিসফিস ,আম গাছে চরে আম চুরি, দুষ্টুমি, সব মিলে মিশে একাকার নির্জন দুপুরের নিস্তব্ধ ভাষায় ৷ নদীর জলে ঘোমটার বউটি ডুব দেয় টুপটুপ , দুরন্ত দামালরা ঝপাং ঝপাং শব্দে ঝাঁপিয়ে ,এক সাঁতারে পারাপার করে নদী ৷ নৈশব্দের বুক ছুঁয়ে আলোরন তোলে এইসব শব্দেরা ৷ প্রশস্ত সীমাণায় বসুমতীর বুকে কৃষকের হাল চালানোর ছন্দে ,চাষীর মুখ থেকে নির্গত সেই অতি চেনা গরু তাড়ানোর শব্দে , একটু একটু করে মোহময়ী হয়ে ওঠে নির্জন দুপুরের কলেবর ৷ মেঠো পথ ধরে একতারায় সুর বেঁধে গেয়ে যায় উদাস বাউল তার প্রাণের গান ৷ কখন যেন বোষ্টমী এসে কথা দিয়ে যায় -আমি বড় হলে আমাকে সে তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে সে ,যেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর একসাথে খেলা করে – সেদিনটাও তো ছিল এমনই এক দুপুর -নির্জন, নিস্তব্ধ ৷ দুপুরের ভাঁড়ারে শব্দেরা বর্ণ আর বর্ণরা কখন ইন্দ্রজালে কবিতা হয়ে ওঠে ৷
নির্জনতার বুকে এই রকমারি শব্দেরা দ্বিপ্রহরের আচল জুড়ে রহস্যের জাল বোনে ৷ আর নিস্তব্ধ দুপুর হয়ে ওঠে অনন্য সুন্দর ৷ দুপুরের নিস্তব্ধতায় রহস্যময় শব্দের মায়াজালে বন্দী হয় কত অনুভূতি ,ভালো লাগা ,খারাপ লাগার গল্প ৷ অপরাহ্ন্যের জমিতে এইসব শব্দেরা যেন হয়ে ওঠে শব্দকল্পদ্রুম ৷ নির্জনতার বুকে তারা ভেসে বেড়ায় ,একে অপরকে আলিঙ্গন করে ৷ রচনা করে এক পৃথিবী কাব্য ৷ নির্জনতার আকর খনন করে ,চয়ন করে নিই এক একটা মোতি ,যা শব্দের রূপ পায় কল্পনার আলতো স্পর্শে ৷ শব্দই ব্রহ্ম ৷ আর সেই ব্রহ্মের লীলা খেলা চলে হৃদয়ের অন্তর মহলে ৷ ভাঙা-গড়ার নিরন্তর প্রবাহ ৷ সেই প্রবাহে অবগাহন করে শব্দ নিয়ে করি জলকেলি ৷ দুপুরের নিঝুম মায়াচ্ছন্ন আবেশে জড়ানো মুহূর্তগুলো একে একে জুড়ে যায় পরস্পরের সঙ্গে ৷ আর সেই জুড়ে জুড়ে যাওয়া মুহূর্তগুলোর সাক্ষ্য দেয় শব্দেরা ৷ হৃদয় নিঙড়ানো আবেগ আর অনুভূতিরা জুড়ে যায় সেইসব শব্দের গায়ে ,আর শব্দেরা হয়ে ওঠে রঙীন ,ভাষাময় ৷ সেই ভাষা দিয়ে চলে স্বপ্ন বোনা ৷ নির্জনতার বুকে শব্দের মিছিল আপরাহ্ন্যের শূণ্যতাকে ভরিয়ে তোলে কানায় কানায় ৷ |সেই শব্দেরা ক্রমে হয়ে ওঠে শব্দমালা ,শব্দমালারা,শব্দমালারাই প্রতিভাত হয় অনুভূতি ,আবেগ ,ভালোবাসা ,দুঃখ ,সন্দেহ রূপে ৷ অবকাশে কখন যেন দুপুরের নিরালা জঠরে লালিত হয় কবিতার ভ্রূণ |পরিচর্যা ,প্রতিপালন ,যত্নের স্পর্শে অবশেষে জন্ম নেয় হৃদয়ের তরঙ্গ জুড়ে এক মানস সরোবর | সেই মানস সরোবরে তরঙ্গায়িত শব্দেরা ,অনুভূতি আর কল্পনার আলিঙ্গনে প্রস্ফুটিত হয় সতেজ নিষ্কলঙ্কিত পঙ্কজ রূপে ,যার ফুলরেণুগুলো কবিতা হয়ে ঝরে পরে নিস্তব্ধ অপরাহ্ণ্যের বুকে ,আর আমি সেইসব কবিতাকে যত্নে লালন করি মনের মনিকোঠায় ,হৃদয়ের আদুল ঘরে , চেতনার জ্ঞান-মন্দিরে ,স্বপ্নের শয়নকক্ষে ৷ নিস্তব্ধ দুপুরের শব্দরা এইভাবে জেগে থাকে আমার চেতনার ,অবচেতনার ,অর্ধ্বচেতনার মানসচক্ষে ,আর কবিতারা জন্ম নেয় হৃদয় জুড়ে ,অনাবীল আনন্দে, আবার কখনও বা নিদারুণ কষ্টে ৷ দুপুরের নির্জনতায় এমনই এক ইন্দ্রজাল আছে ,যা ভাব পাগল মানুষদের অনুভূতিকে উস্কে দেয় আর আমরা কবিতায় কাল যাপন করি ৷ কবিতা আঁকি ,কবিতা লিখি ,কবিতা চাখি ,কবিতা মাখি ৷
বিমূর্ত স্তব্ধতায় নিঃশব্দ দুপুর আর কবিতারা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কখন , টেরই পাইনা |
নিস্তব্ধ দুপুর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে কবিত-সম্ভবা ৷