ও’পারের বন্ধুবান্ধব যাঁরা আছেন তাঁদেরকে বিন্দুমাত্র দুঃখ না দিয়ে আপনাদের সকলকে ব’লি, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবি কোনোভাবে দেখেছেন কখনও? সুপারস্টার(!) শাকিব খানের অভিনয় দেখেছেন? আন্তর্জাতিক স্তরে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের ‘দেশীয়করণ’ পৃথিবীর কোনো দেশেই নতুন নয়, কিন্তু কখনও ভেবেছেন, ‘ছেলে’ গামোরাকে ‘বিষপ্রয়োগে খুন করা হ’য়েছে জেনে’ থ্যানস হুঙ্কার ছাড়ছে, “আমার বাপধনরে মারলি, তরে অ্যাইবার কাইট্যা ফালামু”? উপরন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসেও হলদেটে পর্দায় অস্পষ্ট সংলাপে ‘এক মন এক প্রাণ’ (থ্রি ইডিয়টসের ও’দিশি অনুকরণ)… দেখেছেন এসব? আরোওই যেটি আশ্চর্যের বিষয় তা হ’চ্ছে, বাংলা অবিভক্ত থাকাকালীন নির্বাক-সবাক চলচ্চিত্র থেকে শুরু ক’রে মঞ্চাভিনয়-শ্রুতিনাটকই হোক বা বিভক্ত বাংলার ‘বাঙাল’ অভিনেতারা… তাঁদেরও বেড়ে ওঠা কিন্তু উপরোক্ত ছবিগুলির জন্মস্থান থেকেই।
এবারে একটু নিজেদের দিকে তাকানো যাক। এ’পারে বাংলা চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘর টালিগঞ্জ পাড়া চিরকালই ‘শিল্পকেই’ প্রাধান্য দিয়ে আসায় ছবি বাণিজ্যিক হ’লেও মূল কাহিনীতে বাস্তবিক প্রেক্ষিত রাখবার চেষ্টাই করা হ’তো এবং ছবির আগাগোড়া তৈরী করা হ’তো মূলতঃ ভদ্র ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষজনের কথা মাথায় রেখে। চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষের মূল উদ্দেশ্য থাকতো শৈল্পিকভাবে কোনো একটি বার্তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা। ঘরে ঘরে ছোটো পর্দারও এতো বাড়বাড়ন্ত ছিলোনা তখন। পয়সা খরচ ক’রে নেহাত অল্পসংখ্যক লোকই বাংলা ছবি দেখতে আসতো। সংখ্যাবশতঃ মানের সঙ্গে আপোষ করার কোনো প্রশ্ন আদৌ ছিলোনা। সেক্ষেত্রে ‘অভিনয়’ প্রাধান্য পেতো ‘অভিনেতা’ নন, ‘দর্শক’ প্রাধান্য পেতো ‘ভক্ত’ না।
আটের দশকের মাঝামাঝি কিন্তু ভারতীয় বাংলা ছবিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ক’রে দেওয়া হয়। উন্মুক্ত ক’রে দেওয়া ব’লতে এতোদিন বিত্তবান ব্যতীত অপর শ্রেণীর ছবি দেখা যে নিষিদ্ধ ছিলো তেমনটি ঠিক নয়, ব’লতে চাইছি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গভীরতা কম ক’রে কেবল চলচ্চিত্র-বোদ্ধা ছাড়া ‘আপাত-নির্বোধ’ মানুষের জন্যেও ‘ছিনিমা’ বানানো হ’তে থাকে। পর্দায় নায়িকার মুখ আসতেই সর্বসমক্ষে শিস দেওয়া ‘ভক্ত’ সংখ্যায় ক্রমশঃ বাড়তে থাকে এবং বিপুলতর চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামতে থাকে ছবির মান। পুতুলের হাতবদলে নায়ক-নায়িকার দূরে ব’সে গল্প করা থেকে শুরু ক’রে কোনোরকম পর্যবেক্ষণ ব্যতীত অযৌক্তিক দৃশ্যের আনাগোনা বেড়েই চলে… সত্যি ব’লতে কী গ্রামগঞ্জের জনপ্রিয় যাত্রাপালার মতো স্থূল ও অসাংস্কৃতিক বিষয় সরাসরি বড়ো পর্দায় দেখানোর অলিখিত এক রীতিই চালু হ’য়ে যায়। ঘুরেফিরে সেই প্রেমে অর্থনৈতিক বৈষম্যজনিত বাধা আর পারিবারিক অশান্তির অবাস্তবিক রকমফের ব্যতীত গল্প লেখার বৈচিত্র্যে ভাটা প’ড়তে থাকে। আদর্শ উচ্চমানের দর্শকেরা ঘৃণায় অন্যান্য ভাষার ছবিতে মুখ ফেরান।
ঠিক এই সময়ে যাঁরা অভিনয়ের জগতে এসেছিলেন তাঁদের অনেকে যেমন বুদ্ধিমত্তা এবং সাবলীল অভিনয়ের দ্বারাই সমকালীন ও তৎপরবর্তী মনষ্কতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকতে পেরেছিলেন, অনেকেই কিন্তু পারেনওনি তেমন। সেই সময় বহির্জগতের সাথে পরিচিত হ’তে হ’তে তৎকালীন ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম তার চাহিদায় কিছু চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটালেও উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত মনোবৃত্তিকে পুরোপুরি নির্মূল ক’রতে পারেনি তখনও। অতএব ভক্তের সংখ্যা যতোই বাড়ুকনা কেন, আদর্শ অভিনেতাদের কাঙ্ক্ষিত মঞ্চের খোঁজ বেড়েই চ’লেছিলো ক্রমাগত এবং এই ছদ্মবেকারত্বজনিত অস্থিরতাই তাঁদের আস্তে আস্তে ঠেলে দিচ্ছিলো অবসাদের দিকে।
সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, পেটানো স্বাস্থ্য বা কৃত্রিম ঔজ্জ্বল্য ব্যতীত কোনো ব্যক্তি যদি কেবল অভিনয়-দক্ষতার জোরে একপাল নির্বোধের বিচারে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ ক’রতে চায় সে যে হালে পানি পাবেনা এ’কথার কিছুই স্বাভাবিক নয়। তথাকথিত-দর্শকের সেই নির্বুদ্ধিতায় অবাক হওয়ারও কিছু নেই, কারণ সারাদিন ক্ষেতে নিড়েন দিয়ে আসার পর সন্ধ্যায় মুড়ি খেতে খেতে একটিমাত্র ছোট্টো পর্দায় একশো লোক মিলে গল্পের প্রেক্ষিত বুঝে তার বিচারে কারোর অভিনয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ ক’রবে তা ভাবাও বাতুলতা। কিন্তু তাদের কথা ভেবে মুখশ্রীর সহজাত নিষ্প্রভ কোমলতা, ধীর লয়ে কথা বলা সেসব অভ্যাস ছেড়ে হঠাৎ ক’রেই নিজেকে ঝাঁ চকচকে চেহারার উদ্দাম নাচা-গাওয়া নায়ক হিসাবে গ’ড়ে তোলা যায় কি? হয়তো যায়ও, কিন্তু যে ব্যক্তি এহেন বিষয়ে কাজ করার স্বতঃস্ফূর্ততাই খুঁজে পাচ্ছেনা সে কৃত্রিমতা দিয়ে আর কতোদিন চালিয়ে যাবে? এদিকে জীবনধারণ ক’রতে হ’লে এতোদিনের ঔজ্জ্বল্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গড়পড়তা কেরাণী বা রাঁধুনির চাকরি তো করা যায়না। নতুন কোনো পরিচালকও অভিনয়ের সুযোগ দিতে হয়তো রাজি হবেনা, কারণ একে তো দশ-পনেরো বছরের পুরোনো ‘জিনিস’ তায় যুগের সাথে তাল মেলাতে গেলে চ’লছেওনা তেমন।
অতএব চলো তবে দেশীয় রাজনীতিতে। রাজনীতিকে পরবর্তী পেশা হিসাবে নিতে নিজের এতোদিনের ‘জনপ্রিয় অভিনেতা’ পরিচয়কে ব্যবহার ক’রি। আগেই ব’লি, যেকোনো শিল্পের মতোই রাজনীতিকেও জীবিকা নির্বাহনের পন্থা হিসাবে গ্রহণ করায় বিন্দুমাত্র অপরাধ নেই যদি তা নিতান্ত সৎ পথে হয় এবং এহেন সমস্ত বিষয়ের চর্চায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনোই বাধ্যবাধকতা না থাকায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ এখানে স্বাগত। মনে রাখবেন, যেকোনো উন্নততর সভ্যতায় বৌদ্ধিক বিষয়সমূহের অনুশীলন যাঁরা করেন তাঁরা যথেষ্টই সম্মানের অধিকারী হন আর জনৈক সংসদের কম দামে খাবার, টেলিফোন খরচ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য থেকে শুরু ক’রে ভারতের রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ বেতন এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা ঠিক এই কারণেই রাখা হ’য়েছে, তা ব্যক্তিগতভাবে যতো বড়ো অপরাধই তাঁর থাকনা কেন। এ’কথা ধ’রে নেওয়াই হ’চ্ছে, সেই ব্যক্তি যিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের একজন নির্বাচিত সদস্য, তিনি তাঁর অমূল্য চিন্তাধারা ও সহমর্মিতা দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে ব্যয় ক’রছেন। তাই তাঁকে দেওয়া সমস্ত সুযোগসুবিধা, বেতনই একান্ত সাম্মানিক। সংবিধান তো আর হিসেব করেনি যে উক্ত ব্যক্তি কি তাঁর জনপ্রিয়তার বিচারে নির্বাচিত হ’য়েছেন না দেশীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে যোগ্যতার?
ফলতঃ হাতে ক্ষমতা, গ্লাসে মদ আর মুখের কথা তিনটিই লাগামহীন। ক্ষুধা যা ছিলো মিটেছে সেসব কবেই। অভিনয় দক্ষতা? ফেলে এসেছি। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান… ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোভ। নেশার ঘোরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে মহিলাদের উদ্দেশ্যে যে কথা তিনি ছুঁড়ে দিলেন ‘দাদার কুকীর্তি’ হ’য়ে সেই অসভ্যতার দাগ তাঁর মুখে লেপ্টে র’ইলো আমরণ। সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে যাঁদের জানা নেই তাঁদের ব’লি, যেটুকু জেনেছি এই সাক্ষাৎ নরকবাস জনৈক অপরাধীর ভেতর যে পরিমাণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে তার তুলনায় পুলিশের প্রহারেণ ধনঞ্জয়ও সম্ভবতঃ সুখের। এ’কথা খুবই দুঃখের যে ঝানু অপরাধী না হওয়ায় টানা আতঙ্কগ্রস্থ হ’তে হ’তে এবং অকস্মাৎ আবিষ্কৃত একাকীত্বের অবসাদে একটি সম্ভাবনাময় জীবন এতো অল্প বয়সে শেষ হ’য়ে গেলো, কিন্তু আরোও বেশী দুঃখের যে ভুক্তভোগীরা এখনও সুবিচার পেলেননা।
সবশেষে ব’লি, আমি সদ্যপ্রয়াত তাপস পালের অভিনয় কখনোই দেখিনি তাঁকে নিয়ে করা মশকরায় তাঁর অভিনীত ছবির কিছু অংশ ছাড়া। ‘দাদার কীর্তি’ দেখার মনোবৃত্তি সেভাবে কখনও জাগেনা, এখনও জাগছেনা। ২০০১ থেকে… অর্থাৎ গত ১৯ বছর ধ’রে এক ‘চন্দননগরের মাল’ ব্যতীত তাঁর কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ও সেভাবে পেয়েছি ব’লে আমার অন্ততঃ মনে প’ড়ছেনা। কিন্তু উপরোক্ত আলোচনার তাৎপর্য এটুকুই, যে ‘সর্বহারার হাতে ক্ষমতা তুলে দিলেই কিন্তু তার সুফল সুনিশ্চিত নয়’ এবং ‘জনৈক কর্মহীন বা অক্ষম শিল্পীর দায়ভার অবশ্যই প্রশাসনের হাতে ন্যস্ত হওয়া উচিত’। কেবলমাত্র পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি কীভাবে জনৈককে অপরাধের অন্ধকার জগতে টেনে নিয়ে যায় একজন তাঁর মৃত্যুতে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। রাজনীতি যদি সততার নীতির ব্যবসাও হয় তার অবশ্যই মূল্য আছে, কিন্তু স্বৈরাচারের পৃষ্ঠপোষক হ’লে তা নেতাকে নিজস্ব দায়িত্ব থেকে মুখ ফেরাতে প্ররোচিত করে। কেউ অন্তর থেকে যতো বড়ো অভিনেতাই হোকনা কেন, পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে সকলের মতো সে’ও একজনের হাতের পুতুল।