• Uncategorized
  • 0

গদ্য বোলো না -তে সঙ্কর্ষণ ঘোষ

হন্তারক

ব্যক্তিগত আবেগ মাত্রেই বিপ্লবের চরমতম শত্রু। নকশালবাড়ি আন্দোলনের ইতিহাস নির্ভর সাহিত্যে ব্যক্তিগত পরিসরের বিভিন্ন সুখ বা দুখস্মৃতি যদি একান্ত স্রষ্টার কল্পনাও হয়, তা’ও ব’লি নকশালপন্থীদের কাছে (বিশেষতঃ আন্দোলনের মধ্যভাগের শেষার্ধে যোগ দেওয়া তরুণদের কাছে) এহেন টানাপোড়েন নতুন কিছু বিষয় ছিলোনা। সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে চারুবাবু যে আটটি ঐতিহাসিক দলিল রেখে গিয়েছিলেন (দেশহিতৈষীতে প্রকাশিত) ধ’রে নেওয়া যায় তার মূল্যায়ন করার মতো সহকর্মী সেই মুহূর্তে ভারতীয় মাওপন্থী রাজনীতিতে কেউ ছিলেননা।
সরোজবাবুর খোঁজ পুলিশ না দিলেও তাঁর শেষ পরিণতি আসলে কী হ’য়েছিলো অনেকেই জানেন। জঙ্গল সাঁওতালের মৃত্যু থেকে কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ, কানুবাবু বা অসীম চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্নহীন আনুগত্য, দক্ষিণী মাওপন্থার স্বাভিমানের প্রতিযোগিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা, সর্বোপরি কংগ্রেসি পুলিশের প্রচণ্ড দমননীতি সব মিলিয়ে চারুবাবুকে তাঁর ভুল বুঝতেই দেওয়া যায়নি কোনোদিনও। তিনি বুঝতে পারেননি লালকুর্তা বাহিনীর সেনাপতি লিন পিয়াও ‘খতমের’ যে সংজ্ঞা অর্থাৎ শ্রেণীশত্রু হত্যার ধারণা দিয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ ভুল। মাও-সে-তুং স্বয়ং এই হত্যাকাণ্ডের কথা আদৌ বলেননি, তিনি শ্রেণীশত্রুর অন্তর্গত বিভেদের মনোভাবকে হত্যা করা অর্থাৎ ‘শ্রেণীশত্রুতাকে’ খতম ক’রতে ব’লেছিলেন। সেই কারণেই চৈনিক কমিউনিস্ট পার্টি লিন-পিয়াওকে মরণোত্তর যথাযোগ্য সম্মান দিতে অস্বীকৃত হয় এবং পিকিং রেডিওতে প্রথমে ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ ব’লে ঘোষণা ক’রলেও পরে নকশালবাদকে মাওপন্থার সমগোত্রীয় মেনে নিতে তারা পিছিয়ে আসে। পুলিশের নজর এড়িয়ে অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীনই চারুবাবু অনেক দেরিতে হ’লেও সেই কথা জানতে পারেন এবং গ্রেফতারির মধ্যেই হাসপাতালে তাঁর মৃত্যুর পর পার্টি ‘অ্যান্টি লিন-প্রো সিএম’, ‘প্রো লিন-অ্যান্টি সিএম’ বিভিন্ন টুকরো হ’য়ে ৬৪টি ভাগে ভেঙে যায়। মহাদেব মুখার্জী শেষ চেষ্টা ক’রেও পারেননি আন্দোলনের ঐক্যকে বাঁচাতে। কারণ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দই দলীয় মতবাদ নিয়ে দ্বিধান্বিত হ’য়ে প’ড়েছিলেন।
‘নকশালবাদ’ কি তবে একটি ঝড় মাত্র? বেশ কিছু আবেগপ্রবণ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ যৌবন ও তারুণ্যের একটি গিমিক? আজ্ঞে না। একটু ভেবে দেখুন কেবলমাত্র ছাত্র পরিসরে কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ও তদোদ্ভূত সংগঠন কতোখানি শক্তিশালী হ’লে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারকে চিরকালের মতো বঙ্গীয় রাজনীতি থেকে ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে? দুঃখ এইই র’ইলো, যে তারপরে মার্ক্সবাদী এবং বামপন্থী মতবাদের ধ্বজা নিয়ে যে রাজনৈতিক দলটি পরিবর্তে ক্ষমতায় এসেছিলো এবং অস্তিত্বটুকুই বর্তমানে যাদের টিকে আছে তারা আসলেই সাম্য, সমাজ ও বামপন্থা থেকে কয়েকলক্ষ গুণ দূরে অবস্থান করে।
এই মুহূর্তে খতম ক’রতেও নকশালবাদ খুব খুব বেশী ক’রে প্রয়োজন জানেন? না না, প্রাণ নয়। আমরা ভেতরে একেকজন যে বিষাক্ত বিশ্বাসগুলি পুষছি তাদের শেষ ক’রে দিতে, ‘ভালোবাসাকে’ ভালোবেসে নিতে। নতুন যৌবনের দূত হওয়া যদি এতোখানি সোজাই হ’তো ‘কু-রাজনৈতিক চিন্তাধারা’ ব’লে কোনো শব্দবন্ধ হয়তো তৈরীই হ’তোনা। ত্যাগগুলি পুলিশের খাতায় একেকজন ‘হন্তারক’ হ’য়েই র’য়ে গেলো, বিপ্লবী হওয়া আর হ’লোনা তাঁদের।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।