• Uncategorized
  • 0

গদ্য বোলো না -তে সঙ্কর্ষণ ঘোষ

মাউন্টেন অফ মুন

নামের আগে বা পরে হঠাৎ ক’রেই কবি বা সাহিত্যিক উপাধিটি ব’সিয়ে নিজের ঢাক নিজে পেটানোর যে মোহ তার নির্দিষ্ট একটি সময়কাল থাকে জানেন? এটি দৈর্ঘ্যে কারোর নেহাতই স্বল্প হয় কেউ আবার স্বেচ্ছায়ই হোক কী অনিচ্ছায় এই মোহ কাটিয়ে উঠতেই চাননা। সত্যি ব’লতে কী কেবল সাহিত্যচর্চাই নয়, এই পৃথিবীতে যতো প্রকারের শিল্প-সৃষ্টি-সংস্কৃতির চর্চা হয় তাদের প্রতিটির ক্ষেত্রেই জনৈক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বকে (যিনি সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিষ্ঠিত ব’লে গৃহীত, আপন বা ব্যক্তিগত পরিসরের বিচারে নন) এই অবস্থার প্রলোভন কাটিয়ে উঠতেই হয়। সেই সাবালকত্ব লাভই আসল জ্ঞানার্জন যা বুঝতে শেখায় “সুবিশাল সমুদ্রের তীরে আমি একটি ক্ষুদ্রকায় নুড়ি কুড়োতে সাহস ক’রেছি মাত্র”। এই আমাকেই দেখুননা (না না ভাববেননা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ম’নে ক’রছি, পরিবর্তনটুকু বোঝাতেই আর কী) প্রথমে ‘সাহিত্যিক’ ছিলাম (কবি ব’লতে কেমন লাগে যেন), তারপরে জ্বালাময়ী থেকে আপাদমস্তক ঝগড়াটে ‘সমালোচক’ হ’লাম, তারপরে এই ‘না-সমঝের’ বাজারে হ’লাম ‘লিখিয়ে’ আর আজকাল নিজেকে ‘সর্দার-পোড়ো’ বা ‘ভালো পাঠক’ বলাতেই আনন্দ লাগে।
আচ্ছা এতো মজা, এতো গৌরচন্দ্রিকা যার জন্য, সেটিই এবার ব’লি। সেই স্কুল থেকে শুরু ক’রে কলেজ পার হ’য়ে আজ এই উচ্চশিক্ষার পেছনে যে প্রায় ১৮ বছর, যার মধ্যে পেশাদারি লেখালেখি শুরু ক’রেছি মাত্র ২১ মাস হ’লো, যাতায়াতের সময় ব্যাগের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরের অন্ততঃ কোনো একটি বিষয়ের বই আমার সঙ্গে সর্বদা থাকবেই সে আমি প’ড়ি আর না প’ড়ি। আজকাল নয় মোবাইল হাতে নিয়েই রাস্তায় সময় কেটে যায়… কিন্তু এমনও দিন ছিলো যখন নন্টে-ফন্টে থেকে আনন্দমেলা ঐ মাঝারি-ভীড়ের ট্রেনে ব’সেই আর বাকি সময়টুকু বাড়িতে থেকে কার্টুন দেখার পাশাপাশিই ছোটোদের রবীন্দ্রনাথ শেষ ক’রেছি। বইপত্র কিনে দেওয়ার ব্যাপারে আমার বাবা-মায়ের কার্পণ্য কোনোদিনও ছিলোনা (এখনই যা একটু হ’য়েছে, উঠতে-ব’সতে কিনি তো) বরং যে সময়ে আমার ভাইবোনেরা সারাদিন টিভি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো আমাকে তখন টিভি দেখার জন্য বাঁধা সময়টুকু ছাড়া বাধ্য হ’য়ে গল্পের বইই প’ড়তে হ’তো আর কোনো আনন্দদায়ক উপাদান হাতের কাছে মজুত ছিলোনা ব’লে।
আমার এক কাছের বন্ধুর কথা ম’নে পড়ে যে একবার আমার ব্যাগে বই রাখবার অভ্যাস দেখে ব’লেছিলো, “ভাই আমার এসব বই-টই একদম পোষায়না জানিস? ” অনেক ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েও সদ্য চাকরি পেয়ে সে আজকাল মোটামুটি ভালোই জীবন কাটাচ্ছে… তো যাই হোক, তার ঐ কথাটি কখনও ভুলতে তো পারিইনি বরং আরো বেশী ক’রে যেন কানে বাজে আজকাল। সত্যিই তো শিশু থেকে যুবক, পুরুষ থেকে নারী এই আপাতসাফল্যের পেছনে যাঁরা ছুটছেন তাঁদের কেন পোষাবে ব’লুন তো বই পড়া? বিশেষ ক’রে যেকোনো অনামী প্রকাশনীর বাংলা ভাষার বই? তেমন উন্নতমানের পাতা নেই, তেমন রঙিন ছবি নেই, তেমন আকর্ষণীয় অক্ষরে ছাপা নেই, মোবাইলের মতো কাছে রাখার তেমন গৌরবও নেই… নামী প্রকাশনীগুলিরও ঠিক কাছাকাছিই অবস্থা ছাপা আর কাগজই যা একটু ভালো, তাও মোটা মোটা বইগুলিতে তেমন ছবিও নেই।
“মানব জাতিসহ এই পৃথিবীতে যতো প্রাণ আছে প্রত্যেকে নিজের উত্তরপুরুষের ভেতরে নিজেকে জীবিত রেখে যায়”, জলাশয়ের যক্ষের “বার্তা কী” প্রশ্নতে এইই ছিলো ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উত্তর। আমরা ছোটো থেকেই নৌকাডুবি প’ড়িনি, প’ড়িনি পথের দাবীও… কিন্তু হাঁদা-ভোঁদা, গোপাল ভাঁড় থেকে শুরু হ’য়ে ভাষার যে বিস্তৃত সমুদ্রের দেখা পাওয়া শুরু আমরা তার আরম্ভ ক’রেছিলাম “ছোটো খোকা বলে অ আ” দিয়েই। ‘মাতৃভাষার প্রাসঙ্গিকতা’ যে কোনোদিন একটি জাতির আলোচ্য বিষয় হ’তে পারে তা আমাদের বড়োরা যেমন ধারণাতেও আনতে পারেননি আমরাও তা উত্তরাধিকার সূত্রে শিখিইনি কখনও… যার ফলে বাংলা কোনো বই (গল্পের বইয়ের অনেক পরে গবেষণাধর্মী বইয়ে হাতেখড়ি) হাতে পেলে সেই বইয়ের বক্তব্য বুঝতে প্রতিটি শব্দের সাথে সাথে আমরা একটি অবস্থার ছবি মাথার ভেতরে এঁকে নিতে শিখে গিয়েছিলাম এবং সেইজন্যেই এই তথাকথিত কেজো দুনিয়া ছাড়াও শৈশবে আমাদের একটি কাল্পনিক সুখী পৃথিবী বর্তমান ছিলো আর তদ্দ্বারা আমাদের অভিভাবকেরা অত্যন্ত সচেতনভাবে কোনোদিনও ফলাফলের উদ্দেশ্যে আমাদের জাগতিক শিক্ষালাভের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হ’তেই দেননি। আজকের পৃথিবীতে স্বোপার্জিত অর্থের বিনিময়ে যে জাতি তার ‘পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট’ (আক্ষরিক অর্থ ব্যক্তিত্বের উন্নতিসাধন, অন্তর্নিহিত অর্থ ঔপনিবেশিকতাবাদী সভ্যতার আদর্শ শিকারে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পাদন) ক’রতে রাজি হ’য়ে যায় তার কীসের প্রয়োজন কোনো একটি বিষয় স্রেফ বলপূর্বক গলাধঃকরণ না ক’রিয়ে তাকে আত্মস্থ করার প্রক্রিয়ায়? তবে কী চায় সে? বৈষয়িক প্রেক্ষিতে দেখলেও ঠিক কীভাবে তাকে এমন খুশি করা যেতে পারে যাতে সে নিজের প্রয়োজনেই কখনও না কখনও বইমুখী হয়?
খুব সংক্ষেপে এর একেবারে মূর্তিমান উত্তর হ’লেন সেই ভদ্রলোক যিনি গতকাল ৪৯৫/- খরচ ক’রে ইংলিশে ছেলেকে ‘মাউন্টেন অফ মুন’ কিনে দিলেন। ঝকঝকে উপাদানের অসংখ্য রঙিন ছবিযুক্ত পাতার মধ্যে ক্ষুদ্রাকৃতি বিদেশী অক্ষরগুলি ঠিক এভাবেই যেন একরাশ উপহাস ছুঁড়ে দেয় পাশের স্টলে প’ড়ে থেকে থেকে হলদেটে হ’য়ে যাওয়া চটকবিহীন আদি ও অকৃত্রিম বাংলা ‘চাঁদের পাহাড়ের’ দিকে। আসলে ভদ্রলোক এক ঢিলে একাধিক পাখি মারলেন, ১। ইংলিশ আরো জোরদার হবে, ২। বাঙালি লেখকের বই ছেলেকে কিনে দিয়েছেন মানে তিনি আসলেই সংস্কৃতিবান, ৩। এতো দাম যখন দিয়েছেন জিনিস হিসাবে সে ঐ কমদামীটির তুলনায় শ্রেষ্ঠ বইকি। ঠিক এঁরাই বইমেলায় ‘খাবার খেতে’ যান, ভেবে দেখুন খেতেও ঠিক ওখানেই যেতে হয় যেহেতু ঐ যে সংস্কার পেয়েছেন-টুকু জনসমক্ষে আনবার দরকার আছে, এঁরাই ছেলেমেয়ের বাংলা না জানায় পরোক্ষে গর্ববোধ করেন, এঁরাই বংশানুক্রমে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একজন আদর্শ ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তি হওয়ার বার্তা রেখে যান। অর্থাৎ এঁরা সেই বিখ্যাত জাতির প্রতিভূ যারা ‘আত্মসম্মানঘাতক’ ব’লে একটি বিশেষ প্রজাতি হ’য়ে জন্ম নেয় এবং দেয়।
ফলস্বরূপ বাংলা ভাষায় ভালো গবেষণামূলক প্রবন্ধ দূরে থাক… গল্প আমাদের ইতিহাস থেকে ধার ক’রে নিয়ে চ’লতে হয়, পাঠক টানতে কিশোর প্রেমের গল্পের নামে চটুলতাকে স্বাভাবিকভাবে চালানো হয়, কেবলমাত্র পরকীয়ার নির্লজ্জ উদযাপন ক’রে জনৈকা প্রৌঢ়া শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হ’য়ে যান, প্রতিবাদের নামে ইতরামির পক্ষ নেওয়ার লোকের অভাব হয়না, অধিকাংশ আদর্শ সাহিত্যিক দারিদ্র্যের শিকার হ’য়ে মারা যান, তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন ভাঙে, পুরস্কার চুরি হ’য়ে গেলে এলাকাপ্রধান ‘ক্ষতিপূরণ’ দিয়ে দেন। এদিকে শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য যখন দূর প্রবাসে ছেলেটি রিগিঙের শিকার হয়, সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক যখন নিজে উক্ত স্কুলের ছাত্র হ’য়ে ভালো ঘরের ছাত্রের অভাবে নীরবে অশ্রুমোচন করেন আমরা তখন দুর্বোধ্য কিছু একটি সৃষ্টি ক’রে বুক ফুলিয়ে ব’লে বেড়াই, “তোমায় বোঝাতে হবে ব’লে তো আমার কলম চলেনা, সাহিত্যসেবার প্রতি আমি দায়বদ্ধ”। তারপর লজ্জার মাথা খেয়ে বইও বের ক’রি আর নীরবে বুঝিয়ে চ’লি, “অ্যাট প্রেজেন্ট দ্য হোল কালচার কনসিস্টস অফ আ বাঞ্চ অফ সাম ব্লাডি হিপোক্রিট স্কাউন্ড্রেলস”। কথা কাল্পনিকই, কিন্তু কিছুদিন বাদে এই কথা লেখা বইই আপনি আপনার ছেলেকে কিনে দিতে পারেন… শুধু ভাষা বাংলা না হ’লেই হ’লো, আপনার মতো তারও ভাবান্তর ব’লে কোনো বস্তু আদৌ থাকবেনা আর যদি বা থাকে আপনার তাকে দেওয়ার মতো সময়ই নেই।
সবশেষে ব’লবো গর্ববোধ হয়, খুব গর্ববোধ হয়। চারিদিকে এতো লেখক, লিখিয়ে, আলোচক… আমি ব’লছিনা আমি বিশাল বড়ো পাঠক, শুধু বই খুঁজে প’ড়তে পারি ঐ ‘কল্পনায় ছবি দেখা’র ‘মানুষিক’ ক্ষমতাটুকু পেয়েছি ব’লে মাত্র। দুয়েকজন পাঠক দরকার বিশ্বাস ক’রুন, খুব খুব দরকার, কারণ ভাষার সাথে জাতিও যে শেষ হ’য়ে যেতে ব’সেছে। অন্ততঃ বৈষয়িক দিক থেকে ভেবেও চাহিদাটুকু অন্ততঃ পাল্টে প্রকাশকদের ওপর এই চাপ সৃষ্টি ক’রুন, যে কী জাতীয় গঠনমূলক সাহিত্য আপনাদের প্রয়োজন। সমুদ্র অনেক বড়ো… যদি পাড়েই না পৌঁছোতে পারি ঢেউয়ের উচ্চতা মাপবো কেমন ক’রে?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।