• Uncategorized
  • 0

গদ্য বলো না -তে সঙ্কর্ষণ ঘোষ

সুখময় সুকুমারেষু

এ খবর সুকুদা ঠিক কোথায় ব’সে পেয়েছিলেন, তা জানা সঙ্গত কারণেই সম্ভব ছিলোনা কখনো। সুদূরপ্রসারী ফলাফল বিষয়টিই এমন যে লাভের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত গোপনীয়তা যদি কখনো নিতেই হয়, জড়িত বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়াও এমনভাবে নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে মানুষ বাধ্য হয় যে বাইরে থেকে তার দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বেও অনুভূতির ছাপ প্রায় পড়েইনা। মজঃফরপুরে আগুনের আঁচ সেভাবে টের পাওয়া যায়নি ব’লেই যে তেমনভাবে লাল পাগড়ির কড়াকড়ি হয়নি তখনও, তা বুঝেই দুই অনভিজ্ঞকে এতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পাঠিয়েছিলেন তিনি। একশো শতাংশ সাফল্যের আশা কখনোই ছিলো কি? দশও ছিলোনা হয়তো সত্যি ব’লতে। কিন্তু ঐ… আশায় মরে চাষা।
শহরের রাস্তায় রাস্তায় জিভে জল আনা বিরিয়ানির দোকানে দাপিয়ে বেড়াতে গিয়ে যখন মা বাবার মুখে শুনি, একদিন দুই-পাঁচ টাকার চপও কিছু লোকের কাছে অমূল্য ছিলো… তাৎক্ষণিকভাবে উপহাস ক’রলেও, অন্তরে কিন্তু বিস্ময়ই জাগে জানেন? সেদিন যখন হরেন ট্রেন থেকে নেমেই বুঝেছিলো দু’জনের জন্য সুকুদার দেওয়া হাতখরচাটুকু (হাতখরচা মানে চালিয়ে নেওয়ার মতো খরচাই, উপভোগের মূল্য নয়) ইতিমধ্যেই পকেটমারের ভোগে গেছে, নিজের বড়ো দাদার মতোই আগলে রেখেছিলো দীনেশদা। পকেটের পয়সাতে মোগলাই-পরোটা খাইয়েছিলো এই ক্ষণিকের পরিচিত ছোটো ভাইটিকে। দুজনেরই বড়ো ভালো লেগেছিলো পরস্পরের সান্নিধ্য।
দিনকয়েক পরে স্পিরিটে ডোবানো দীনেশদার কাটা মাথাটি দেখে যখন শনাক্ত ক’রেছিলো হরেন, কিছু দুঃখ তার একান্ত নিজের ছিলো আর কিছু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন স্বয়ং ভারতমাতা। সুকুদা জেনেছিলেন চ’লে যাওয়ার আগে প্রথম দু’দিন দুটি মাত্র কথা আদালতে খরচ ক’রেছিলো সে। ঠিক কথা নয়, অনুতাপ বলা যায়। প্রথমতঃ দায়িত্ব পালনে তার ব্যর্থতা, দ্বিতীয়তঃ ২ নিরপরাধ মহিলাকে ভুলক্রমে হত্যা করা। এই ব্যতীত দীনেশদার বিচ্ছেদে কিছু মনমরা থাকা নিয়ে কাঠগড়ায় বিচারের সময় হেসে হেসে ঢুলতো সে। সত্যি ব’লতে কী এ ছেলের জন্মই বিপদলগ্নে ছিলো। ভাগ্যিস সত্যেন বুদ্ধি খাটিয়েছিলো আর হাসিমুখে নিজের চাকরিটি খুইয়েছিলো… ন’ইলে তো সেদিনই ইশতেহার বিলোনোর অপরাধে বেত খেয়ে ম’রে যেতো।
ছেলেটি জানেনি তার দীনেশদাকে ধ’রিয়ে দিয়েছিলো যে সে একজন বাঙালি দারোগা নন্দলাল বাঁড়ুজ্যে, আবার যিনি দীনেশদাকে প্রথমবারের মতো বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তিনিও একজন বাঙালি সরকারি কেরাণী ত্রিগুণাচরণ সেন। সরকার পক্ষের বাঙালি উকিল শামসূল আলমই হ’ন বা নন্দলালের পুরস্কারদাতা (পদোন্নতি নয়, দু’টি বুলেট) শ্রীশচন্দ্র পাল গর্ব এবং ঘৃণা উভয়েরই ভার নিজের বুকে বহন ক’রেছিলেন ভারতমাতা। সেদিন সুকুদাই হোক বা বোমা-বিশেষজ্ঞ পালু, বয়সে আরেকটু অভিজ্ঞ সত্যেনই হ’ন বা কানাই, দলের গুরুস্থানীয় অরবিন্দ ঘোষই হ’ন বা তাঁর হ’য়ে দাঁড়ানো বিশ্ববিখ্যাত উকিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এরা সকলেই নিশ্চিন্ত হ’য়েছিলেন আলালের ঘরের দুলাল না হোক এই পোড়া দেশে তিন মুঠো ক্ষুদের দামে জীবন বিকিয়ে দেওয়া রোগাপ্যাঁটকা ছেলেগুলির অভাব হবেনা কোনোদিন। যুগান্তর দল সত্যিই একটি যুগেরই সূচনা ক’রেছিলো যারা যুগপুরুষ হওয়ার ক্ষমতা রাখতো। এই নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী বা কুমুদনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এগুলি দুয়েকটি ব্যতিক্রম… না ব্যতিক্রম ব’লবোনা, বলা উচিত বেশ কিছু সংখ্যক ব্যতিক্রমীর অন্তর্গত সাধারণ মেরুদণ্ডহীন ‘বেঙ্গলি ইন্ডিয়ান’ ছিলো, বাকিদের মতো ভারত মায়ের পাগল ছেলে নয়।
নিজস্ব ভাষা যেমন চিরাচরিত বিষয়কে সহজবোধ্য রূপে পরিবর্তন ক’রে নেয়, সংস্কৃতিরও তদ্ভব একটি রূপরেখা আছে। যার জন্য আমাদের একান্ত নিজস্ব মা দুর্গা কৈলাসে বরমুদ্রায় হাসিমুখে ব’সে না দেখে ছেলেমেয়ের কষ্টে ঝাঁজিয়ে উঠে তাঁর নেশাগ্রস্থ স্বামীকে ব’লতে পারেন, “তণ্ডুল লইয়া আসো শূল দিয়া বান্ধা”, “বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়” জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ না ক’রে হ’য়ে যায় “একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি”। ফাঁসি হাসিমুখে প’রতে পারা আসলে একটি শিল্পের উপাদান… বলা উচিত সেই অসংখ্য লাল রঙেরই সমাহার আজকের চিত্ররূপময় স্বাধীন ভারতবর্ষ। মূর্তিতে গাল ভাঙা ক’রেই তাঁকে বানানো হয় তৎসত্ত্বেও ‘হরেন সরকারের’ মাথা কিন্তু সর্বদা উঁচুতে থাকে তাইনা?  সুকুদা জানতেন ঐ মাথার দিকে তাকানোর সাহস নেই গুটিকতক লালমুখোর, সেই জন্যই একটি মাথা তারা গুম ক’রে দিলো আর অন্যটি দিলো ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে। প্রাকৃতজনের মতো সেদিন কাঁদেননি সুকুদা, শুধু পরের বার উল্লাসকর দত্তেরই আরেকটি তাজা বোমা সহ স্বয়ং সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে প্রতিশোধের দায়িত্বে পাঠিয়েছিলেন বারীন্দ্রনাথ ঘোষ। যা তাঁর আদরের পালুকে বানাতে শিখিয়েছিলেন বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সুসংহত সলতে কে আজ যদি কেউ তিন মুঠো ক্ষুদে কিনতে চেষ্টা ক’রতো পারতো কি? অপরূপা দেবী আসলে কী ধনে ধনী যে ছিলেন…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *