বিদেশে ভারতীয়দের শনিবারের বড় টাইমপাস হল আড্ডা । অবাঙ্গালীরা বেশিরভাগ শনিবার দুপুরে ডাব্বায় শুকনো বা আধাভিজে খাবার নিয়ে কোনো পার্কে গিয়ে বসে। বউরা গোল হয়ে বসে শ্বশুরালের গল্প করে, ছেলেমেয়ের স্কুল ইত্যাদিও। বরেরা টেনিস , ব্যাডমিন্টন খেলে , মাঝেমাঝে বউরাও উঠে খেলে আসে। বাচ্চাগুলো ধুন্ধুমার দুষ্টুমি, ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়। মা বাবারা তৃপ্তির হাসি হাসে। আজ আর রাতে ঘুমোতে দেরি করবে না অন্যদিনের মত। রাত্রের আড্ডা ব্যাপারটা ওঁদের মধ্যে কম। খুব টেনেটুনে সন্ধ্যের ডিনার। দশটার মধ্যে ঝাঁপ ফেলা।
অন্যদিকে বাঙ্গালীদের আড্ডা মানেই ছাপ্পান্ন ভোগ, নরম গরম পানীয় এবং বুশ ক্লিন্টন ওবামা থেকে কাস্ত্রো কিউবা কলকাতা বিচরণ। সেখানেও মেয়েরা একদিকে ছেলেরা অন্যদিকে নিজেকের বৃত্ত তৈরি করে নেয়। পরের দিকে মোবাইল আসার পর দেখি আড্ডার এক কোণ থেকে কর্তা বা গিন্নি (যিনি বেশী ক্লান্ত বা বোর হয়ে গেছেন) তিনি অন্যজনকে মেসেজ করছেন “চল, ওঠো এবার…”
বাচ্চারা নিচে বেসমেন্টে নতুন বন্ধু তৈরি করে নেয়, কেউ কেউ নিজের বই নিয়ে এসে এক কোণে বসে পড়ে। ওদের জন্য খেলনার সম্ভার আর পিজ্জার স্লাইস বরাদ্দ। ওপরে এলাহি খাবার দাবার। স্ন্যাক্স খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেললে বিশাল ভুল হবে। কারণ বেশিরভাগ বাড়িতেই অ্যাপেটাইজার টু ডেজার্ট-এ অষ্টআশি পদ সাজিয়ে বলবে “এ আর এমন কী! কিছুই তো করতে পারিনা! সব খেও প্লিজ”। যারা বেশ পুরোনো তাঁদের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে পুঁই, কুমড়ো, জুকিনি, বাড়ির ভেতরে বড় টবে কলা গাছ, কারি পাতা। তাঁদের “বাড়ির পুঁই”-এর চচ্চড়ি খেয়ে নতুন প্রবাসিনী মেয়েটি মনে মনে ভাবে আহা, মার হাতের সেই চচ্চড়ি আবার যে কবে খাব। মাকে হোয়াটস অ্যাপ করে “খুব মিস করছি মা তোমাকে আর তোমার হাতের পুঁই মেটুলি। ”
আড্ডার মাঝেই ফোনে মেসেজ ঢোকে টিং করে। মা-র উত্তর “তুই এলেই আবার করব রে। তুই না আসা অব্ধি আমরাও খাইনা ওসব”
“দ্যাটস রং মা। এরকম কোরো না একদম। আই ডোন্ট লাইক দিস”
আবার টিং…
মা উত্তর দেন “আরে আমাদের তো ইউরিক অ্যাসিডের জন্য এমনিতেই খাওয়া ঠিক না ওসব। আর পুঁই-তে বাত বাড়ে জানিস না?”
মেয়ে ভুরু কোঁচকায়… ভাত বাড়ে পুঁই তে? মানে? তারপর হেসে ফেলে, ওঃ বাত! বাত বাড়ে… টাইপো ছিল।
এরই মধ্যে কেউ কেউ মাঝেসাঝে বাড়িতে গানের আসর বসান। নিজেরা গানবাজনা করেন। তিন চারবার “দেখা হয়ে যাওয়া” নতুন প্রবাসীদের সাথে হালকা আলাপের পর বাড়িতে কর্তা গিন্নিতে একটু নোটস আদান প্রদান করে নেন। গিন্নী বলেন অমুকের বাড়িতে তমুক মেয়েটিকে দেখলে?
কর্তা মনে করতে পারেন না।
গিন্নী আবার সুতো ছাড়েন … ওই যে, মেয়েটি সল্ট লেকের ছেলেটি বোধহয় সাঁতরাগাছির। কম্পিউটারের ছেলেমেয়ে।
কর্তা এবার হালে পানি পান। তিনি বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ শংকরের আমলে। পালিয়ে বাঁচা নকশাল তিনি। এগ্রিকালচার নিয়ে পড়েছেন বিদেশ গিয়ে। ভুট্টার রাজনীতি আর ভুট্টোর রাজনীতি নিয়েই মশগুল মানুষ। নেহাত ও দেশে রিটায়ারমেন্টের বাধ্যবাধকতা নেই তাই চাকরি করছেন। এই দু হাজার সালের পর আসা ছেলেপুলেরা মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে সত্তরের কালো দিনের গল্প শোনে। তার মধ্যেই নতুন মুখ পেলে কর্তা সস্নেহে জিজ্ঞেস করেন গাড়িটারি কিনেছ? আছ কোথায়? তোমাদের তো জীবন সুখের এখন। ফ্রিতে কথা বলতে পার বাড়ির লোকের সাথে। আমরা, যখন এসেছিলাম, তখন যে মাসে একদিন মা বাবার সাথে কথা বলতাম সে মাসে আর রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা ভাবতাম না। কী সব দিন ছিল, বুঝলে না?
নতুন মুখগুলি কি বলবে বুঝে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে আপনার বাড়ি কলকাতার কোথায়?
কর্তা বলেন “কলকাতা? আরে নাহ, আমার বাড়ি বিষ্ণুপুর। কলকাতায় পড়াশুনো… তার মাঝেই আগুন জ্বলে উঠল চারদিকে।”
এইভাবেই আদানপ্রদান হয় কথার। ছেলেটির মামারবাড়ি হয়ত বিষ্ণুপুরের কাছেই বা হয়ত সে বিয়ের আগে প্রি ওয়েডিং শ্যুট করতে বিষ্ণুপুর গিয়েছিল।
এইভাবেই আলাপ, পরিচিতি। এভাবেই এবারও কর্তার মনে পড়ে সাঁতরাগাছির ছেলেটির কথা। পাখিরালয় না কি যেন আছে সেখানে। প্রচুর পাখি যায় শীতে। ছেলেটি ফটোগ্রাফি করে। ডিএসএলআর নিয়ে ঘুরে বেড়ায় জলে জঙ্গলে। তবে তার বউটিকে মনে করতে পারেন না ।
গিন্নী বলেন “মেয়েটা খুব মিষ্টি। আমাদের টুপাইয়ের স্কুলে পড়েছে। কত গল্প করল আমার সাথে”
কর্তা বোঝেন মেয়েটির মিষ্টি হওয়ার বড় কারণ হল সে শালীর স্কুলতুতো বোন।
“পরের বার ভাবছি ওদের ডাকব গানের আসরে বুঝলে?”
কর্তা মাথা নাড়েন। ভাল বুদ্ধি। গানের আসরে ডাকলে খুব বেশী কথা বলতে হবে না কিন্তু ডাকাও হবে। গানের আসরে ওঁরা স্পেশাল লোকজনকে ডাকেন। হ্যা হ্যা করে আড্ডা দেয় যারা তারা সংস্কৃতিটা ঠিক চুপচাপ বেশিক্ষণ নিতে পারে না। তবে এসব নতুন ছেলেমেয়ে গানের আসরে এলে মন দিয়ে শোনে। পুরোনোরা পুরোনোদের গান আর কত শুনবে? দোল দুর্গোৎসব পয়লা বৈশাখেও তো এরাই গায় সবাই। তবু গানের আসর বসানো কারণ
মানে বুশ ক্লিন্টন ওবামা ট্রাম্প কারুর জাঙ্গিয়ার রং অবধি আলোচনায় আর বাকি নেই তাই মুখ বদলাতে “একটু গান বাজনা হোক”। তবে এই সব বাড়িতে নেমন্তন্ন পাওয়া ইজি নয় বাপু। একটা “ভেতর ভেতর চেনা”ও লাগে অনেক সময়।
অমন “ভেতরে ভেতরে চেনা” আমিও পেয়েছি কয়েকবার। নেমন্তন্নও সেই সুবাদে । তখন সবে বছরখানেক হল গেছি ওদেশে। আমার গ্রুপটিও তাই, সবই বাছুরে। পুজোয় একসাথে হইচই, গান, নাটক, ম্যাগাজিন। অল্প পরিচিতি একটু এলিট সিনিয়র, সেমি সিনিয়রদের সাথে। সিনিয়ররা আমাদের তেমন পাত্তা দিতেন না। তাঁরা বহু বছর এনআরআই। বাঙালি দেখলেই আদেখলামোর স্টেজ পেরিয়েছেন। তাঁদের আড্ডার বড় টপিক হল ছেলেমেয়েদের আই বি লিগ-এর আন্ডারগ্র্যাড, গ্র্যাড স্কুল ইত্যাদি। তবে সেমি সিনিয়ররা একটু মাইডিয়ার টাইপ। নতুনদের ভাল লাগলে ডেকে ফেলেন মাঝেসাঝে। তেমনই একজন সেমি সিনিয়র বউদি বাড়িতে ডেকেছেন আমাদের । গিয়ে দেখি আমরা তিন বন্ধু ছাড়া আর সবাই বাঘাবাঘা জনতা। সবারই হাতে রোল করা কাগজ। তাতে গান কবিতা ইত্যাদি গিজগিজ করছে।
তো স্ন্যাক্স ড্রিঙ্কস ইত্যাদির পালা শেষ হতেই হোস্ট বউদি এক গেস্ট দাদাকে বললেন গাইতে। গেস্ট দাদা বললেন আহ, আমি কেন? আগে ও গাক… যার দিকে দান গেল তিনি আবার হোস্ট দাদাকে ঠেললেন “আরে তুমি গাও” … এভাবেই হোস্ট দাদা গেস্ট বউদিকে গেস্ট বউদি হোস্ট বউদির বেস্ট ফ্রেন্ডকে মানে সবাই সবাইকে বলছে তুমি গাও তুমি গাও এদিকে সবারই আস্তিনে গানের গুঁতো রাখা।
তো এই তুমি তুমির মাঝে আমার বন্ধু আমাকে বলল এই, তুই গা-না, তুইও তো গাস…
যেই বলা, ওমনি আমাকে সম্মতি বা আপত্তি কোনোটাই জানানোর সুযোগ না দিয়ে গেস্ট হোস্টদের মধ্যে বয়ঃজ্যেষ্ঠ ‘স’ বাবু বললেন আচ্ছা, তোমরা যখন বলছ, আমিই শুরু করছি…
আমি বন্ধুর দিকে কটমটিয়ে তাকাই। ভাগ্যিস বলার সাথে সাথে গান ধরিনি!
তো সে ‘স’ বাবু গাইলেন, হারমোনিয়াম গেল ‘ন’ বউদির কাছে। সেখান থেকে ‘গ’ বাবু, ‘ছ’ বউদি ইত্যাদি করে কত গান কত গান আর কত গান… হোস্টে গেস্টে কষ্টেসৃষ্টে গোটা উনপঞ্চাশ গান শোনা হল। তারই সাথে সঙ্গতে “ভ” বাবু তবলায় উত্তাল। এবং প্রতিটি বাবু ও বউদির মাঝে মাঝে সে তবলায় ঠাঁই ঠাস ঠুং টুং, ঠাস টুং ঠাঁই টং করে হাতুড়ির ঘা কারন স্কেল তো দৌড়ে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। তবে ভাগ্যিস এত গানের আওয়াজ নইলে আমাদের খিদেজনিত পেটের গর্জন লোকে পাশের বাড়ি থেকে শুনতে পেত।
এই সময় হোস্টদা বউদির দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন কী যেন। আমার ফিচেল বন্ধু কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলল যাক, এবার খেতে দেবে… কিন্তু হায় খিদে! শেষ শিল্পী হিসেবে হোস্ট বউদি হারমোনিয়ামটি কোলের কাছে টেনে গান ধরলেন সাথে হোস্টদা তবলা। “ভ” বাবু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন অথবা হোস্ট বউদি নিজের বরের সঙ্গতে গাওয়া পছন্দ করেন ।
গান শুরু হল। বউদি এক লাইন গান… দু লাইন গান, তাল কাটে…
দাদা বলেন উঁহু,
বউদি বলে এহেঃ… রিপিট…
ফের দু লাইন, এবার বউদি কথা ভুলে যান …
দাদা বলেন আহ্,
বউদি বলেন যাঃ… রিপিট…
ইতিমধ্যে ফোন বাজে… বউদি ফোনের দিকে তাকান
দাদা বলেন “মীরা… স্কেল স্কেল.”
বউদি বেচারি আর স্কেল থেকে নামতে পারেন না। এক ধাপ উঁচুতেই চেঁচিয়ে গান শেষ করেন
সব শেষে খাবার বেরোতে থাকে আভেন থেকে একের পর এক। আমি কী খাই কী বাদ দিই ভাবছি… হঠাৎ পাশ থেকে “ভ” বাবু টুনার চপ তুলতে তুলতে বলেন “আরে! আপনার গান তো শোনাই হল না! কে যেন বলল আপনি গান গান?”
আমি কথা ঘুরিয়ে দিই “এই বিদেশে আপনি তবলার চর্চা রেখেছেন দেখে খুব ভাল লাগল। তবলা দেশ থেকে এনেছিলেন?”
“না না, নিউ জার্সিতে এক ভদ্রলোক আছেন তিনি দেশ থেকে যা চাইবেন এনে দিতে পারেন। আমার ছেলের জন্য ক্যারম বোর্ড এনে দিয়েছেন, এক্কেবারে ম্যাচ বোর্ড যাকে বলে”
কথার মোড় ঘুরে যায়।
সেদিন কী কী খেয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। শুধু মনে আছে হোস্ট বউদির বার বার ভুলে যাওয়া গানটি ছিল “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”
বলাই বাহুল্য সেদিনের পর ওই বাটে আর এই আমার পায়ের চিহ্ন কখনও পড়েনি।