আমার একটা ছোট্ট ঘর ছিল, তা তোমার মনে পড়ে কৃষ্ণেন্দু ? আমার একার সেই ঘরটা, যেখানে তুমি, আমি, আমার প্রিয় বন্ধুরা, সবাই মিলে তুমুল আড্ডা মারতাম যখন-তখন ? চলে আসত উৎপল, চলে আসত রানা, এবং এরকমই আরও কেউ কেউ ! আর তখনই গান, গল্প, নাটক আর সিনেমা, পৃথিবীর এইসব কান্ডকারখানা নিয়ে হুল্লোড় করতে করতে আমরা হয়ে উঠতাম সত্যজিৎ কিংবা গদার, স্তানিশ্লাভস্কি অথবা দ্য ভিঞ্চি !
নিশ্চয়ই মনে পড়ছে তোমার ? আর সেইসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে আমার সেই ছোট্ট টেবিলটাও, যার ওপর আমি নিজের হাতে একটা ফুলদানী বানিয়ে তাতে রেখে দিয়েছিলাম কিছু কাগজের ফুল ! মাঝে মাঝে রানা যখন আসত, সেইদিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠত, ‘কাগজের ফুলগুলি আজও ঝরেনি, সত্যি সে ফুল হলে ঝরে যেত ।’
আজ সেই ঘরটাও নেই, ফুলগুলোও শেষ অবধি ঝরে গেছে, সময়ের মাটিতে ।
(৩৪)
মাঝে মাঝে একটা কথা খুব ভাবি, জানো তো ? এই যে আমরা, মানুষরা, আমরা তো কত কিছু নিয়ে থাকি । কত অজানা মানুষের সঙ্গে সারা জীবন কেটে যায় আমাদের, কতো অচেনা প্রাণের অনুভূতি আমরা মিশিয়ে নিই আমাদের জীবনযাপনে, অথচ শেষ অবধি কিছুই থাকে না । সমস্ত খেলা শেষ করে চলে যেতে হয় একদিন । তারপর ? শূন্য । তবু এই ছোট্ট অঙ্গনে আমরা হাসি, কাঁদি, রাগ-অভিমান করি, ভালবাসি, ঝগড়া করি । আর জীবজন্তুরা ? তাদের তো সৃষ্টি বলে কিছু নেই । এই বিরাট বিশাল পৃথিবীর বুকে তারা শুধুই একটা স্রোতের মতো বয়ে যায় । জীবন থেকে মৃত্যু, এর মাঝে কোন অবদান নেই তাদের । আর আমরা মানুষেরা ? আমাদের অনুভূতিগুলো আমাদের মধ্যে ছবি, গল্প, গান, কতকিছুরই না সৃষ্টি করে । তবু সেইসব ছুঁড়ে ফেলে আমরা ছোট ছোট স্বার্থের জন্য কী অসম্ভবভাবে নষ্ট করি নিজেদের । মনুষ্যত্বের মহিমা আমরা বুঝি না কিছুতেই । হায় রে জীবন ! এই সামান্য বোধটুকু তুমি জাগিয়ে তুলতে পারো না মানুষের মনে ?
(৩৫)
আমাদের লাইনধারে একটা ঘর তৈরী হচ্ছে, সারারাত ধরে । লাইনধারটা তুমি চেনো তো কৃষ্ণেন্দু ? সেই যে সাউথ ইষ্টার্নের ট্রেনের লাইনটা, যেটা চলে গেছে মাথার ওপর দিয়ে, যার পাশে একটা চমৎকার পার্ক আছে ? সেই পার্কে তোমার আমার তো কত সন্ধে কেটে গেছে গল্পে আর কবিতায়, মনে আছে তো ? সেই রেললাইনের নিচে রাস্তার ধারে আজ সারারাত ধরে একটা ঘর তৈরী করছে কারা যেন ।
ঘর মানে আসলে অবশ্য ছোট্ট একটা ঝুপড়ি । বাঁশের খুঁটি দিয়ে তার গায়ে দর্মা বেঁধে আর মাথার ওপর টিনের চাল খাটিয়ে সামান্য একটা ঘর । হয়তো কাল থেকে ওখানে দোকান খুলবে কেউ । তৈরী করবে রুটি রুজির ব্যবস্থা । তাই দেখতে সামান্য হলেও এ তার কাছে জায়গীর পাবার মতো । হয়তো এ থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যাবে । সংসারের হাল ফিরে যাবে তার । অথচ এই সূত্রপাতটা হতে চলেছে মাত্র এক রাত্রের মধ্যে । তার নিজস্ব ঘর ।
বড়ো ভাল লাগলো দেখে । মানুষের জয় দেখে আজও যেন জীবনের প্রতি বিশ্বাস জন্ম নেয় । গড়ে ওঠে আশা । এই ঘর তৈরী হল একদিনে । ঘর কি সত্যিই একদিনে তৈরী হয় ?
(৩৬)
ছায়া কাছে আসে, দূরে সরে যায় । আমার মধ্যে কি নির্ভরতা নেই ? কোন অধিকার কায়েম করে নেবার মতো জোর নেই ?
তোমার মতামত জানাটা আমার কাছে খুব দরকারী, জানো ? কারণ আমার নীলাঞ্জনা বোধহয় সম্প্রতি আমায় কোনওভাবে ভুল বুঝেছে । কিন্তু তুমি তো চেনো আমায় । বহুকাল হল আমরা একসঙ্গে মিশছি । আমার দৃষ্টি, মনন, চেতনা, সবই তোমার জানা । তবে বলো তো তুমি, কোথায় আমার অ-ভাব ? আমি তো আমার সমস্ত নিয়ে আমাতেই বর্তমান । তবু নিঃস্ব লাগে কেন ? আমি তো ভালবাসতেই ভালবাসি । তবু দুঃখ পেতে হয় কেন ?
অথচ দুঃখ পাই বলে বারবার মন সরিয়ে নিতে চাই আবেগ থেকে, আকর্ষণ থেকে, রাঙিয়ে নিতে চাই বিশ্বরঙে, তবু সব রাগ-দুঃখ-অপমান বারবার ঘুরে আসে একই বৃত্তে, সেই ছোটবেলায় দেখা জন্মাষ্টমীর মেলার অটোমেটিক পুতুলের মতো, একবার ঘরে যাচ্ছে, আবার বেরিয়ে আসছে, একই বৃত্তে চলছে ঘোরাফেরা —
(৩৭)
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, আগে সাধনা, পরে সিদ্ধি । আগে খাটনি, পরে পেনশন । আগে সিঁড়িভাঙা, পরে পাহাড়ের মাথায় পরেশনাথের মন্দির ।
কেন কে জানে, আজ সকাল থেকে উঠেই মনটা হঠাৎ খুব হাল্কা হয়ে গেল । কী ফুরফুরে চাঙ্গা লাগছিল নিজেকে । যেন হঠাৎ কারও ডাক কানে বেজেছে, যেন হারিয়ে-যাওয়া নিজেকে বহুকাল পরে খুঁজে পেয়েছি হঠাৎ ।
কৃষ্ণেন্দু, এই অবসরে একটা কথা তোমাকে খুব জোরের সঙ্গে জানাতে ইচ্ছে করছে, জানো ? আমি ভালো হবো । আরো ভালো হবো । আমায় ভালো হয়ে উঠতেই হবে । হতাশ নিরাশ এ-জীবনের একমাত্র মরূদ্যান যদিও কেবল ভবিষ্যৎকে আঁকড়ে ধরা, তবুও আমি জানি যে তুমি জানো, আমি অস্ত্যর্থক ভাবধারায় বিশ্বাসী ।
অন্ধকার যতই ছেয়ে ফেলুক না আকাশ, আমি জানি, তার পেছনেই আছে মেঘ, আছে জলধারা, আছে নিবিড় গভীর সিঞ্চন । স্নাত হবো, স্নিগ্ধ হবো, শুদ্ধ হবো । হবোই । প্রবল ঝড়ের মুখেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারার মানসিকতা আমায় শক্তি দেবে । প্রায় সেই মোটরগাড়ির ‘আনব্রেকেব্ল্’ কাচের মতো । ফেটে গেলেও ভেঙে না পড়ে যেন ।
খুব শীঘ্রই হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে । আমাদের আয়নাটাতে নতুন করে পারদ লাগানো হচ্ছে ।
(৩৮)
১। জীবন হচ্ছে কাউকে হাসানো এবং কারুর জন্যে কাঁদা ।
২। জীবন একটি জিজ্ঞাসাচিহ্ন ।
(৩৯)
মনের তারে ঘা দিয়ে দিয়ে বেজে ওঠা, একের হৃৎস্পন্দন অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া, আর ‘অন্যের’ সেই অনুভবকে টের পাওয়া যে কী অদ্ভুত আনন্দময় !
আজ যখন গোধূলিলগ্নে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল, আর লাইনধারের শিমূল গাছটা থেকে বীজ ফেটে অজস্র তুলো বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল চারধারে, কী অদ্ভুত যে লাগছিল — অবর্ণনীয় !
এই সব-হতাশার মধ্যেও বেঁচে থাকার আর্তি, এর যে কী অসম্ভব মূল্য ! আজ চোখের জলে আমাদের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হল, জানো ? এ মূল্য — অমূল্য ।
(৪০)
“… তারপরে ? তারপরে আছে অনন্ত জগতের পথ, অসীম জীবনের বেগ । … সামনে যে বাঁশি বাজছে কান দিয়ে যদি শুনি তো শুনতে পাই, বিচ্ছেদের সমস্ত ফাটলগুলোর ভিতর দিয়ে তার মাধুর্যের ঝর্ণা ঝরে পড়ছে ।”
আমার মনের কোণায় কোণায়, সকল কোষে, সকল রন্ধ্রে সেই ঝর্ণার বিশ্বজনীন কলতান । এক অদ্ভুত সোনার হরিণের ছোঁয়ায় সোনালী স্বপ্ন আমার হৃদয় জুড়ে । সেই সোনালী আলো কি ছড়িয়ে পড়বে না চারিদিক আলোকিত করে ? বৃষ্টি কি হবে না চরাচর জুড়ে ? আমিও তো চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছি । ধেয়ে আসছে মহাকালের রথের চাকা । শোনা যাচ্ছে ঘর্ঘর ধ্বনি । হাত বাড়িয়ে দাও । জীবন বুনা করো হে, জীবন বুনা করো ।