গদ্যে কৃষ্ণা মালিক
by
TechTouchTalk Admin
·
Published
· Updated
কারে কয় বসন্ত
একটা আস্ত শীতকাল পেটফোলা বিরাট একটা কোলা ব্যাঙের মতো ওরেবৎ পড়ে থাকে রাস্তায়। – আঃ মর! বলতে বসেছে বসন্তের কথা, কোত্থেকে উড়নচন্ডে শীতকাল এনে ফেললে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, কত্তা! বসন্ত চিনি গো। ওই যে মর মর – ঝর ঝর – হাওয়া – দখনে হাওয়া -! সে বসন্ত বয়ে আনে; মনে – বনে – বনান্তরে – মনান্তরেও। তখন গা–গতরেও ফুসকুড়ি, মনেও ফুসকুড়ি। আকাশের হাটখোলা বুকে শিমূল–পলাশের রঙে রঙে গা ঢলাঢলি। – বিরাট একখানা চাঁদ দোলপূণ্যিমের। তার কুসুম কুসুম লাল কুসুমকুসুম গা–গরম মালুম দেয়। ওপর ওপর কী শান্ত – কী শান্ত! নবযৌবনা যোগিনীপারা চন্ডীদাসের রাধার মুখ উঁকি দেয়। ভেতরে যেন জ্বর – প্রেম বা কাম যাই হোক না কেন, পুড়ছে – ব্যথা ব্যথা ভাব – আবার চাপা উল্লাসও। তাই যখন সন্ধ্যেবেলা পুব আকাশে প্রথম নতমুখ তুলছে, – যেন প্রিয় মানুষের কাছে প্রথম নথ খোলানি;
লজ্জা লজ্জা – গোধূলিপেলব। তখন শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া প্যাঁচাল পাড়ে মনঘরের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে উলুকঝুলুক চোখ ঘষটানো পড়শির মতো। তারপর – রজনী ধীরে! – চাঁদখানা চোখ মটকাতে শিখেছে – কেলিঅভিজ্ঞ পূর্ণ যুবতী। তো এই বসন্তকে খুব চিনি, কত্তা। সে এলেই থেকে থেকেই ব্যথা আওড়ায়। রসের ভিয়েন ঘিরে মৌমাছি ভ্রমর ওড়াউড়ি করে।
কিন্তু ওই – শীতকাল! তাকে টপকানোর এতোলবেতোল চেষ্টা সত্ত্বেও সে রাস্তার উপর পড়ে থাকে ওরেবৎ। যে পাতারা ঝরে গেছে আদিগন্ত – পাতাঝরার নৈঃশব্দকে গাঢ় করে – তারা সব শীতের দলে। গামছায় বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে গেছে আলফাল হাটুরেরা ফাটা পায়ে ধুলোটের মজা নিয়ে। তারা তো আর ফিরবে না! পরিযায়ীর দল ফিরবে বটে – মালদ্বীপ – বা আরও দূর সমুদ্র থেকে ফিরতি পথে সাইবেরিয়ায় ভাঙাচোরা হা–পিত্যেশ সঙ্গী করে। ফেলে যাবে আয়ুফতুর কত সঙ্গীর জন্মকাল।
খেয়োখেউটি পাঁচপুজ্জ্যির ঘর–গেরস্থালি। পলিথিন জড়িয়ে দূর–ছাই শীত তাড়ায়। ভাতাড়ের কিল হজমিয়ে গুঁতোগুঁতি করে গোয়ালে দখল মারে। ছানাপোনারা চটাপড়া পায়ে ধুলো উড়িয়ে শিষ দিতে দিতে খিদের মার ঠেকাতে পলান দেয়। কত মিডডেমিলের থালা আসমুদ্দুর রোদে চকচকায়। চোখ ঠিকরে পড়ে। কানা চোখে অক্ষর সেঁধোয় না।
তাই তে গতরে বড়ো জাড়। ছাড়ন নেই, চাদরের সঙ্গে চাদরের মতো সম্বচ্ছর জড়িয়ে থাকে। ভূতের কেত্তন হয় দেশ জুড়ে, ভূতের ঢেলায় কপাল ফাটে। রক্ত গড়ায় বটে, শীত কিন্তু অন্দরে পাকে পাকে জড়িয়ে থাকে। তাই বসন্ত আসার পথ পায় না। সে বসে থাকে চায়ে দোকানে। কিংবা পিঠের ছেঁড়া ব্যাগ – ছেঁড়া বইতে অক্ষরগুলো ন্যাজেগোবরে মাখামাখি হয় যত -, তত ঠোঁটের কষে থুতু জমে। আর গোড়ালি ক্ষইয়ে ফ্যালে হেঁটে হেঁটে, পৌঁছে যায় বারুদঘরে।
তবু বসন্তের হাওয়া উসখুস করে আসার জন্য। কোনো কোনো নুলো হাত – কানা চোখ – খোঁড়া পা – বুকটানে উঠে দাঁড়াতে চায়। উড়ালী ডানা মেলে শোঁ শোঁ করে হাওয়া গিলে গিলে মাথাখানা সোজা করে। কিল মারার গোঁসাই, আর উলুকঝুলুক চোখ ঘষটানি পড়শিদের হামলানো সামলে কথা বলে ওঠে। তখন, ঠিক তখনই চড়াৎ করে লাফিয়ে উঠে ঢোলকে তাল পাড়ে ডিগা – ডিগা – দ্রিদিম দ্রিদিম। তখন খল খল – সর সর – মর মর – দখনে হাওয়া ফ্যাক করে হেসে ফেলে। গায়ের চাদর সটান মাটিতে ফেলে দিয়ে চাদ্দিক গন্ধবাউল সাজে।
আসতেই হয় যে! শীতকাল গলে পড়ে একদিন কেঠো চালের মটকা থেকে। আর বসন্তও বোষ্টমঠাকুরের মতো আবিরের রেকাবি নিয়ে এসে পড়ে। কী আর করা যাবে! শীতকাল আঁকড়ে থাকলে চলে না। সে ঝরে গেলেও যে চলে তা নয়। তবু চলার চেষ্টা তো করতেই হবে। তাই গেয়ে উঠতেই হয় মনপোড়ানি অনুপম–গান – বসন্ত এসে গেছে–। আমাদের সমূহ পরাজয়, যাবতীয় ব্যর্থতা, হাজার অপমান, নেই–সম্বলের বরফ গলে স্রোতের টানে আদাড়–বাদাড় ভেঙে নেমে যাচ্ছে ওই অন্য গোলার্ধে। কান পেতে শুনুন, সেই সুর্মাটানা চিরকেলে বাউন্ডুলে পিউকাঁহাটা ফি–বছরের মতো এই বসন্তেও ডাকতে শুরু করেছে – চোখ গেল – চোখ গেল – চোখ -…