জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর।
বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন।
চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
করোনার সময়ে গোরাকে মনে পড়ছে। গোরা, গৌরমোহন, উচ্চ শিক্ষিত, শক্ত দেহ, মন, চরিত্রবান যুবকটি স্বাধীনতা স্পৃহার দ্বারা চালিত হয়ে ক্রমেই গোঁড়া, সঙ্কীর্ণ, সনাতনপন্থী হিন্দুয়ানির দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। যা কিছু প্রাচীন ও সনাতনী ভারতীয় মূল্যবোধ ও অভ্যাস, তা বিনা প্রশ্নে মান্য করতে হবে, এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি সে নিজের মধ্যে তৈরি করছিল ও প্রচার করছিল। কিন্তু শিক্ষিত, স্বচ্ছল, কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান গৌরমোহন বাস্তব ভারতকে কখনো দেখতে পায় নি। ভারতীয় গরিব হিন্দু ও ভারতীয় গরিব মুসলমান আসলে যে কতখানি দুর্বল, মনের দিক দিয়ে, নীতিবোধের প্রশ্নে, সচেতনতার প্রশ্নে, তা গৌরমোহন আগে জানার সুযোগ পায় নি।
গোরা নিজে উচ্চ পর্যায়ের ইংরেজি শিক্ষিত ও শক্ত চেহারার ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হবার কারণে তখনকার শাসকদের, পড়ুন ব্রিটিশ চালিত প্রশাসনের তল্পিবাহক হতে লজ্জা বোধ করত। কিন্তু শুধু উচ্চশিক্ষা ও শক্ত শরীর ছাড়াও তার আরো কিছু সুবিধা ছিল। সেটা হল পরিবারের আর্থিক মজবুতি। তার বাবা কৃষ্ণদয়াল ব্রিটিশের চাকরি করতেন। সাহেবদের নেকনজরে থাকতে পারা ছিল তাঁর কর্মজীবনের লক্ষ্য। তিনি প্রচুর টাকার অবসরকালীন সুবিধা পেয়েছিলেন। গোরার বৈমাত্রেয় দাদা মহিমও চাকরি করতেন। সুতরাং এই পরিবারে ইংরেজের চাকরি করার ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু তারপরেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কল্যাণে জমিদারি তালুক থেকে আয় এই পরিবারের আর্থিক মজবুতির অন্যতম উৎস ছিল। আর্থিক মজবুতি মানুষের আত্মবিশ্বাস যোগাতে বড় ভূমিকা পালন করে। গোরার ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে এই আর্থিক মজবুতির ভূমিকা ছিল না, বলতে পারব না।
অতি সাধারণ ভারতীয় মানুষের এই আর্থিক মজবুতি ছিল না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তো আরো দূরের জিনিস। শিক্ষিত ভারতীয় যাঁরা এমন কি সমাজসংস্কারে ব্যস্ত, তাঁরাও ব্রিটিশ প্রশাসনের তল্পিবাহক হতে লজ্জা পেতেন না। ব্রিটিশ স্বার্থকে বিন্দুমাত্র ঘা দিতে পারার নৈতিক মনোবলটুকুও তাঁদের ছিল না।
এই সময় গোরা এক মুসলমান মালবাহকের অসহায়তা লক্ষ্য করল। সেই গরিব মুসলমান নিজের উপর অন্যায়ের প্রতিকারের দায়িত্ব চাপায় আল্লাহর হাতে। আর বলতে হবে ছুতোরের ঘরের স্বাস্থ্যবান কিশোর নন্দের অকালমৃত্যুর ঘটনাটি। যে নন্দ স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, হাসিখুশি, খেলাধূলায় সবার সেরা, সে যখন পায়ের উপর বাটালি পড়ে আহত হয়, তার আধুনিক চিকিৎসা র প্রয়োজন কে অগ্রাহ্য করে তার বাড়ির লোক। তারপর জীবাণু সংক্রমণের কারণে ধনুষ্টঙ্কার দেখা দিলে নন্দের মা ওঝার ব্যবস্থা করে। অশিক্ষিত ওঝা ঝাড়ফুঁকের নামে সারারাত নন্দের উপর ঝাঁটাপেটা জুতোপেটা করে। জ্যান্ত ভূতের শাসনে নন্দ মরে।
গোরাকে নন্দের এই মৃত্যু ভীষণভাবে নাড়া দেয়। সনাতনী ভারত বলে যার পূজা সে করে, তা যে কতদূর অসার, অবাস্তব, অকিঞ্চিৎকর, তা ধরা পড়ে গোরার কাছে। শ্রেণিবৈষম্য জিনিসটা সে যেন ধরতে পারে। গরিবদের উপর ব্রিটিশ প্রশাসন যে ধরনের অত্যাচারকে প্রশ্রয় দেয়, বড়লোক উচ্চ প্রতিষ্ঠিত ভারতীয়দের জন্য তা কখনোই করে না। শ্রেণিদর্শনের অনুষঙ্গে গোরার চোখে অনেক কিছু ধরা পড়ে, তাকে সনাতনী হিন্দুত্বের অলীক জগৎ থেকে মুক্ত করতে চায়।
দেশ কুসংস্কারের তলায় তলাতে থাকলে, অপবিজ্ঞান দেশ শাসন করলে, সে দেশের মুক্তি পাওয়া কঠিন। উন্নতি বলতে তখন হাতে গোনা পুঁজিপতির উন্নতি। শিক্ষার সুযোগ পেয়ে সুশীল সমাজ নিজেরটুকু গোছাতে শিখেছে। অতি সাধারণ মানুষের তাতে মুক্তি আসবে না।
বিজ্ঞানমনস্ক, পার্থিব জীবনের মূল্যে আস্থাবান, উদ্যমী যুক্তিবাদী মানুষ দেশকে আলো দেখাতে অগ্রসর হোন। নয় তো দেশের মানুষ নন্দের গ্রাম্য মায়ের মতো কুসংস্কারাচ্ছন্ন থেকে যাবে। আল্লাহ ও ভগবানের হাতে অন্যায়ের প্রতিকার করার দায়িত্ব দিয়ে গরিব দিনের পর দিন মার খেতেই থাকবে।