সংগ্রামী লাহিড়ী নিউ জার্সির বাসিন্দা, বৃহত্তর নিউইয়র্ক বলা যায় |
পরিচয় - শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কন্সাল্ট্যান্ট, নেশায় লেখিকা | শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী | উত্তর আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে বসে বদলে যাওয়া প্রবাস-জীবনের ডায়রী লিখছেন |
করোনা-ধারায় এসো – 4
ড্রাইভ-ইনে ত্রিলোকদর্শন
ওষুধ কেনা যে এতো শক্ত তা কে কবে জেনেছে !
এই লকডাউনের বাজারে বলা নেই কওয়া নেই দুম করে জীবনদায়ী ওষুধ গেল ফুরিয়ে | তাও কি আমি খেয়াল করেছিলাম ছাই ? ফার্মেসী থেকেই ফোন করে করে কানের পোকা নড়িয়ে দিল,
– ওগো কাস্টমার, তোমার ওষুধ ফুরিয়েছে | নতুন ওষুধগুলি নিয়ে গিয়ে তুমি আমায় ধন্য করো, অনেকদিন ধরে আমাদের দোকানে পড়ে আছে |
কিন্তু যাবো কি ? আমার বন্ধুবান্ধব, শুভার্থীরা রে রে করে তেড়ে আসছেন – খবরদার বেরোবে না, চাদ্দিকে ভাইরাস গিজগিজ করছে | তোমার বয়েস হয়েছে, রক্তে চিনি, ফার্মেসিকে বলো বাড়িতে ওষুধ ডেলিভারি করে যাক |
অগত্যা | মিষ্টি রোগ মধুমেহর কল্যাণে পাকা আমটি হয়ে বসে আছি | বাড়ী থেকেই চেষ্টা চালালুম, ওষুধটা অনলাইনে ডেলিভারি আনাতে পারি কিনা দেখি |
কিন্তু সে যে কি যন্ত্রণা ! ফোন করলে অনন্তকাল বাজনা বেজে যায়, যান্ত্রিক গলা বলে যায় – “দয়া করে অপেক্ষা করুন, যথাযথ সময়ে আপনাকে উত্তর দেওয়া হবে | আপনার ধৈর্যের জন্য ধন্যবাদ |”
টানা তিনদিন চেষ্টার পর এক শুভক্ষণে দূরভাষে নারীকণ্ঠে শুনলুম,
– হাউ মে আই হেল্প ইউ ?
হাতে চাঁদ পেয়ে আমি তড়বড়িয়ে আমার অভিলাষ ব্যক্ত করলুম | সহৃদয়া তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন অনলাইন ডেলিভারির খাতায় আমার নাম তুলে দিতে | কিন্তু বিধি বাম | ঘন্টাখানেক পর গলদঘর্ম হয়ে মাননীয়া আমায় জানালেন,
– আমাদের অনলাইন ডেলিভারি সিস্টেমটা একটু বেগড়বাঁই করছে, বুঝলে ? আসলে এতো লোড নেওয়ার জন্যে তো তাকে তৈরী করা হয় নি, সব্বাই এখন বাড়িতে ডেলিভারি চাইছে, তাই আর কি, হেঁ হেঁ….
এবার আমি ধুত্তোর বলে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে গাড়ি নিয়ে বেরোলুম ফার্মেসী অভিমুখে | আর গাড়িতে যেতে যেতেই মাথায় বিদ্যুৎ ঝলক – আচ্ছা ফার্মাসির ড্রাইভ-ইন কাউন্টারে গেলে হয় না ? দোকানে ঢোকার তো দরকার নেই ?
যেমন ভাবা তেমনি কাজ | ড্রাইভ-ইন লেন দিয়ে গাড়ি চালিয়ে জানলা ঘেঁষে দাঁড়ালুম | জানালা গলে দুখানি গ্লাভস-পরা হাত বেরিয়ে এসে আমায় ওষুধ ডেলিভারি করে দিলো | আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমি বাড়ি চলে এলাম | এসে অবিশ্যি জামাকাপড় কেচে, স্নান-টান করে নিতে হলো | তা সে হোক, রিস্ক ফ্যাক্টর কত কমে গেল ভেবে আমি উল্লসিত |
ড্রাইভ-ইন কথাটা আমেরিকায় আসবার আগে কক্ষণো শুনিনি | গাড়ি চালাতে চালাতে কেনাকাটা ? সে আবার কি করে হয় রে বাবা ? চিরটাকালই আমার পায়ের তলায় সর্ষে, যখন যা দরকার কালবিলম্ব না করে দোকানে গিয়ে সেটি বগলদাবা করে বেরিয়ে এসেছি | এমন সিস্টেমের কথা তো শুনিনি ?
আমার মতো বাঙালকে দেখে এদেশের অভিবাসীগণ নিশ্চয়ই প্রথমটায় হাস্য করেছিলেন | পরে তাঁরাই দয়াপরবশ হয়ে আমায় শিখিয়ে দিলেন কেমন করে যাবতীয় কাজ গাড়ি থেকে না নেমেই সেরে ফেলা যায় | সময় বাঁচে, গাড়ি থেকে নেমে হাঁটার কষ্টটিও বাঁচে !
কিন্তু গেঁয়োর বুদ্ধি কি আর সহজে খোলে ? এতো চমৎকার সব ড্রাইভ-ইন জানলা থাকতেও আমি বরাবর ম্যাকডোনাল্ডে ঢুকে কফির অর্ডার দিয়েছি (ঐটেই ওদের বেস্ট আইটেম, সে আপনি বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, বয়েই গেল তাতে), ব্যাংকে গিয়ে ক্যাশ তুলতে তুলতে ক্যাশিয়ারএর সঙ্গে দেশের দুরবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি, ফার্মেসী অর্থাৎ ওষুধের দোকানে গিয়ে ওষুধের সঙ্গে আরও নানা হাবিজাবি ঘর সাজানোর জিনিস কিনে এনেছি – সস্তায় দেয় কিনা |
পুরো ব্যাপারটা বদলে গেল করোনা-আক্রমণের পর | আমার সুখের ঘরের চাবিটি গেল হারিয়ে, সর্বদাই মৃত্যুর আশংকায় কাঁটা হয়ে থাকি | বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ | বাজার দোকান বন্ধ | ভাঁড়ারে যা আছে তার থেকেই টিপে টিপে খরচ করে চালাই |
তা সেই করোনা-কালে ওষুধ কিনতে গিয়েই আমার প্রথম ড্রাইভ-ইনে দীক্ষা |
তারপর তো শুনলুম করোনা ভাইরাসের টেস্ট হচ্ছে ড্রাইভ-ইনে, অল্প-স্বল্প ডাক্তার দেখানোও ড্রাইভ-ইনেই হয়ে যাচ্ছে | গাড়িতে বসেই বিশ্বজয় !
কিন্তু আমার চমকের তখনো কত যে বাকি !
এর পরের ঘটনা দেখালো টিভিতে | ড্রাইভ-ইন কনফেশন অর্থাৎ কিনা গাড়ি থেকেই স্বীকারোক্তি | ইস্টারএর আগে ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিকগণ প্রিস্টের কাছে সবকিছু খুলে-টুলে বলেন – কোথায় কি দুটি-একটি পাপকাজ হয়ে গেছে, না জেনে অন্যায় করে ফেলেছি, সবই সদাপ্রভুর চরণে দিলাম | পোল্যান্ড এ প্রথায় যুগান্তর নিয়ে এলো | স্বীকারোক্তি-কামী লোকজন গাড়িতে বসে রইলেন | বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন প্রিস্ট | লম্বা গাড়ির লাইনে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে সবাই কর্তব্যকর্ম সুসম্পন্ন করলেন | সে ড্রাইভ-ইন স্বীকারোক্তির মডেল পরে সবকটা দেশে হৈ-হৈ করে চালু হয়ে গেল |
এরপর এলো গ্র্যাজুয়েশন | মে-জুন মাসে এখানে স্কুল-কলেজের অ্যাকাডেমিক ইয়ার শেষ হয় | তার মানে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্র্যাজুয়েশন আগতপ্রায় | এদেশে কিন্ডারগার্টেন থেকেই গ্রাজুয়েশন আর সম্বর্ধনার ছড়াছড়ি | পাঁচ বছরের খুদে প্রেপ স্কুল থেকে কিন্ডারগার্টেনে গেল – গ্র্যাজুয়েশন ! এলিমেন্টারি স্কুল পার হলো – গ্র্যাজুয়েশন ! মিডল স্কুল থেকে হাইস্কুলে গেল – গ্র্যাজুয়েশন ! তারপর গ্র্যান্ড ফিনালি হবে হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন দিয়ে | কত খাল বিল নালা পুকুর সব পেরিয়ে তবেই তরণী হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশনের সাগরে পড়ে ! কত পরিশ্রমে বারোটি বছর ধরে স্কুল-শিক্ষা নিয়ে ছেলেমেয়েগুলো পা বাড়াবে কলেজের দিকে | সেখানে নতুন জীবন | সেই বিশেষ হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন উৎসব করোনার দাপটে প্রায় বন্ধ হয়ে যায় আর কি |
মে মাসে কাগজে দেখেছি কয়েকটি স্কুল ড্রাইভ-ইন গ্র্যাজুয়েশনের কথা ভাবছে | তাই নিয়ে ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবককুল উদ্বেলিত | কত মতামত, আবেগ, সম্মতি-অসম্মতির ঝড় বয়ে গেল | কিন্তু ঘটনাটি ঘটছে | স্কুলের মাঠের চারপাশ ঘেরা রাস্তায় সুসজ্জিত গাড়িতে ক্যাপ আর গাউন পরা ছাত্রছাত্রী, তাদের বাবা-মা | গাড়ির মধ্যে বসেই হাইস্কুল ডিপ্লোমা নেওয়া হচ্ছে | আর তারপর গ্রামের মধ্যে দিয়ে গাড়ির শোভাযাত্রা | কোনো কোনো স্কুল অবশ্য থিয়েটার ভাড়া করেছে ড্রাইভ-ইন গ্র্যাজুয়েশনের জন্যে |
বলতে ভুলেছি ড্রাইভ-ইন মুভি থিয়েটারের কথা | শুনে প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলুম – জানলা দিয়ে সিনেমা ? কতগুলো জানলা ? একেকটা জানলায় কি একেকটা মুভি দেখাবে ?
আমার বাড়ির জেনারেশন ওয়াই হেসে আমায় বুঝিয়ে দিল,
– আরে না না, মুভি স্ক্রিনের সামনেই তো গাড়ির পার্কিং | এক এক থিয়েটারে চলছে এক এক মুভি | অডিও সোজা চলে আসবে গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমে, FM রেডিও-বাহিত হয়ে | গাড়িতে বসেই দ্যাখো যা খুশি, যত খুশি – নামবার দরকারটা কি ?
চট করে মনে পড়ে গেল সেই ছেলেবেলায় মফস্বলের মাঠে পর্দা টাঙ্গিয়ে চাটাই পেতে বসে সিনেমা দেখা | হরেদরে ব্যাপারটা একই |
আরো জানা গেল এই ব্যবস্থা নাকি আজকের নয়, বরাবরই ছিলো ! নিউইয়র্কেই নাকি গত একশো বছর ধরে এমন ড্রাইভ-ইন মুভি থিয়েটার আছে | করোনার কারণে তাদের এখন হু-হু কাটতি | টিকিট পড়তে পাচ্ছে না | বোঝো কাণ্ড !
এবং সবশেষে ভগবানও দর্শন দিলেন ড্রাইভ-ইনে !
লকডাউনে এতদিন ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতি সন্ধ্যায় ফেসবুক লাইভে আরতি দেখে প্রাণ জুড়িয়েছেন | এখন ভগবান মুখ তুলে তাকিয়েছেন, তাই নিউজার্সি আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে, লকডাউন উঠছে | তিনি এবার ড্রাইভ-ইনে ভক্তদের দর্শন দেবেন |
দিনের একটি বিশেষ সময়ে মন্দিরের দরজা থাকবে খোলা | ম্যাপে এঁকে দেখিয়ে দেওয়া আছে কিভাবে কোন পথে গেলে তাঁর দর্শন হবে | দর্শনের সময় অবিশ্যি বাঁধা |গাড়ি নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে এসে তাঁকে ভক্তি নিবেদন করেই এগিয়ে যেতে হবে | পিছনের গাড়ীর ভক্তের পালা এবার |
মন্দির কর্তৃপক্ষের ইমেল পেলুম – সামনের সপ্তাহ থেকেই শুরু হচ্ছে সে প্রচেষ্টা | খবর পড়ে যুক্তকরে বললুম – সকলি তোমারি ইচ্ছা |