• Uncategorized
  • 0

স্মরণ ২০০: কবিতায় – মধুসূদন দরিপা

বাঁকুড়া শহরের মানুষ । বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর । ১৯৭৯ থেকে নিয়মিত প্রকাশিত সাহিত্য পত্র ' আর্ষ ' পত্রিকার সম্পাদক । কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা,ভ্রমণকাহিনী, সমালোচনা --সাহিত্যের সব কটি শাখাতেই লিখে থাকেন । প্রকাশিত গ্রন্থ : অমৃত সান্নিধ্য (ভ্রমণ উপন্যাস ) এবং ' আ মরি বাংলা ভাষা ' ( ভাষা কবিতা ফোল্ডার )।সম্পাদিত গ্রন্থ : ' বাঁকুড়ার ছোট গল্প ' (গল্প সংকলন ) । ' অমৃত সান্নিধ্য ' গ্রন্থের জন্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মাননীয় শ্রীপ্রণব মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে জাতীয় স্তরে প্রদত্ত কামদাকিংকর মুখোপাধ্যায় পুরস্কার সম্মাননা প্রাপ্ত হয়েছেন । সাহিত্য ব্যতীত সংগীত ও নাটকের চর্চার সংগেও যুক্ত । নাট্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি এবং বাঁকুড়া পৌরসভা কর্তৃক সংবর্ধিত ।

অন্য বিদ্যাসাগর 

সত্যি বলছি বিদ্যাসাগর
এতদিন আপনাকে জানতাম শুধুমাত্র
অসাধারণ মানুষের কিছু সাধারণ গল্পের মতো
পথের ধারে মাইলস্টোন দেখে
আপনার ইংরেজি সংখ্যা শেখা
কিংবা মা ভগবতী দেবীর টানে রাতের অন্ধকারে
উত্তাল দামোদর পার হওয়ার বিতর্কিত কাহিনী
রেলের ইস্টিশনে কুলি সাজার চমৎকার
কিংবা সাহেবের সবুট পদ প্রদর্শনের প্রত্যাঘাতে
টেবিলের উপর আপনার সেই বিখ্যাত পাদুকা প্রদর্শন
পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে
আপনার ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার
কিংবা দুরবস্থা বনাম দুরাবস্থার বৈচিত্রে
আপনার অসাধারণ রসবোধের পরিচয়
সত্যি বলছি বিদ্যাসাগর
এতদিন আপনাকে জানতাম শুধুমাত্র
অসাধারণ মানুষের কিছু সাধারণ গল্পের মতো
আর আপনার বিধবাবিবাহ আন্দোলন
কিংবা বহুবিবাহ রোধ
সতীদাহ নিবারণ কিংবা স্ত্রীশিক্ষাবিস্তার
এসব জ্ঞান ছিল নেহাতই ইশকুলের পরীক্ষায়
‘ বিদ্যাসাগর’ রচনা লেখার সাধারণ স্মৃতিসম্পদ
কিন্তু আজ যখন আপনার জন্মদ্বিশতবর্ষে
সমস্ত সমাজ নিরক্ষর মানুষের
বর্ণপরিচয় আন্দোলনে উত্তাল
ঠিক তখনই নতুন করে আপনাকে খুঁজতে গিয়ে
উপলব্ধ হ’ল সম্পূর্ণ এক অন্য বিদ্যাসাগর
‘ স্পেয়ার দ্য রড স্পয়েল দ্য চাইল্ড ‘
জানি এর বিরোধী ছিলেন আপনি
বরং কুসুমের মতো কোমল, কিন্তু
বজ্রের মতো কঠিন ছিল আপনার চরিত্র
মেট্রোপলিটন স্কুলে যেদিন কানমলা খেয়ে
নরেন্দ্রনাথের কান দিয়ে রক্ত পড়ছিল
তখনও তিনি বিবেকানন্দ হন নি
কিন্তু আপনার তিরস্কারে সেদিন
লজ্জিত সংকোচিত হয়েছিলেন প্রহারী শিক্ষকটি
শ্যামবাজার মেট্রোপলিটন স্কুলের
দ্বিতীয় শ্রেণীর সব ছাত্রকে
আপনিই বহিস্কার করেছিলেন ক্লাসরুম থেকে
অন্যায় আচরণের শাস্তিবিধানে
অথচ অপরদিন বাদুড়বাগানে আপনার কাছে
ক্ষমা চেয়ে পৌষ পার্বণের ছুটি চাইতেই
আপনার নিজের বাড়িতে পিঠে খাওয়ানোর
বিস্তর ব্যবস্থা করেছিলেন আপনি

বিদ্যাসাগর
আপনি নিজেই তো বাল্যবিবাহের শিকার ছিলেন
শুধু আপনি কেন
দেবেন ঠাকুর কেশব সেন
সত্যেন ঠাকুর নবীন সেন
জ্যোতি ঠাকুর অমৃতলাল
মায় বঙ্কিমবাবু ভূদেব মুখুজ্জে সব
আপনারই মতো ভোগ করেছিলেন
বাল্যবিবাহের কুফল
তাই বাল্যবিবাহরোধ আন্দোলন
এত তীব্রতর হতে পেরেছিল

‘ বিধবাদিগের শরীর কি শরীর নয় ?
তাহারা কি মহাবল ইন্দ্রিয়দলকে
হাত বুলাইয়া শান্ত রাখিবে ? ‘
আপনি সাহস না যোগালে
তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে পারতেন কি
গৌরী ভটচায্যির মতো শাস্ত্রীয় মানুষ
এমন খোলাখুলি আক্রমণ শানাতে ?
আসলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল
‘ বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয় ব্যাপার ‘
তাই শাস্ত্র দিয়ে শাস্ত্রের মুখ বন্ধ করতে
পরাশর সংহিতাকে হাতিয়ার করে
উঠে এসেছিলেন আপনি
বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়েছিল
কিন্তু বিদ্যাসাগর
যেদিন প্রথম বিধবাবিবাহকারী শ্রীশচন্দ্র
কালীমতীর মৃত্যুর পর
পন্ডিতদের ব্যবস্থা অনুযায়ী
‘ আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম ‘  করে জাতে ওঠেন
সেদিন বিধবাবিবাহ সম্পর্কে মোহভঙ্গে
আপনার অনার্দ্র হৃদয় কি অশ্রুসিক্ত হয় নি ?
কিংবা যখন জীবনপ্রান্তে পৌঁছে দেখলেন
চন্দ্রনাথ বসুর মতো এম এ পাশ অনুগামী
অক্ষয়চন্দ্র সরকারের মতো পন্ডিত পর্যন্ত
বহুবিবাহ বাল্যবিবাহের সমর্থনে
বক্তব্য রাখছেন, বিধবাবিবাহের প্রতি
বিষোদ্গার করছেন । তখন
ইয়ং বেঙ্গলের এই পিছু হটা দেখে
আপনার উদাসীন দৃষ্টিপাত কি
আকাশের মহানীলকে আশ্রয় করতে চায় নি ?
আসলে সমাজমন সেদিন
আপনার আন্দোলনকে স্বীকার করে নি
আজ করেছে
বিদ্যাসাগর
বাংলার ‘ ক্যাপ্টিভ লেডি ‘ আজ মুক্ত
লক্ষ লক্ষ চন্দ্রমুখী বসু
আজ ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে
বিধবাবিবাহ চালু না হলেও
বহুবিবাহ কিংবা বাল্যবিবাহরোধ
সম্ভব হয়েছে । আপনার বালিকা বিদ্যালয়গুলি
আজ ঘরকে বাহির করেছে ভারতবর্ষে
সতীদাহকে আমরা ঘৃণা করতে শিখেছি
আপনার প্রদর্শিত পথ অনুসরণে আমাদের
মাতৃভাষাকে আমরা সমৃদ্ধ করেছি
কিন্তু বিদ্যাসাগর স্বাধীনতার এই মধ্যবয়সেও
সমাজের সর্বস্তরে যেটা আমাদের
প্রাথমিক কাজ তথা প্রধান দায়িত্ব ছিল
সেই বর্ণপরিচয়টা ঘটানোই
সম্ভব হয়ে ওঠে নি আজও
তাই আপনার জন্মদ্বিশতবর্ষে
নিদারুণ এই সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে
আজ মোতি বাগদি রাবেয়া খাতুন
কিংবা মুন্নী ডোমের প্রাত্যহিকীতে
আপনাকে আমরা ‘ এসেনসিয়াল কমোডিটি ‘ করে
ওদের হাতে তুলে দিয়েছি
বিদ্যাসাগর
আপনি আমাদের আশীর্বাদ করুন
সমাজের এই বহতা নদী
যেন একদিন মোহনায় গিয়ে
বিদ্যাসাগরে ডুব দিতে পারে
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।