• Uncategorized
  • 0

কবিতায় পৃথা রায় চৌধুরী

জন্মস্থান ভারতবর্ষের ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ শহরে। সাহিত্য চর্চা শুরু, ছোটবেলা স্কুলে থাকতেই। প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ও পরিবেশ বিজ্ঞানে ডক্টরেট। এপার ওপার বাংলার বিভিন্ন প্রিন্ট পত্রিকা ও অনলাইন ওয়েবম্যাগ ও ব্লগে নিয়মিত লেখালিখি করি ২০১২ সাল থেকেই। নিজের একক কাব্যগ্রন্থ ছয়টি... "মন্দ মেয়ের সেলফি", "জন্মান্তরে সিসিফাস", "শব্দ এক পুরুষপাখি", "চতুর্থ প্রহরে নক্ষত্রের ছায়া", "ঘড়ির তেরো নম্বর কাঁটা" ও "মায়াকীয়া"। এ ছাড়া এপার ওপার বাংলার বিভিন্ন কবিতা সংকলনে স্থান পেয়েছে আমার কবিতা। কিছু কাব্য সঙ্কলনের সম্পাদনা করেছি ও ক্ষেপচুরিয়াস নামক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর মধ্যে, "আমি অনন্যা" পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর মধ্যেও আছি এবং 'শহর' পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বেও আছি। ২০১৬ সালে “শব্দের মিছিল” সাহিত্য গোষ্ঠীর তরফ থেকে “আত্মার স্পন্দন” ১৪২৩ সম্মানপ্রাপ্ত হয়েছি।

আমি বিপিন হতে চাই না 

পচা নর্দমার পাড় ধরে কোনোমতে ঝুলে আছি। নর্দমা ভরা বিচিত্র পুরীষাবৃত
কিলবিলে পোকা। নিজেও আমি পোকাই, ওই যাকে গুয়ের পোকা বলা যায়। বিষ্ঠা মাখা
আমাদের সবার গায়ে। সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের দিকে ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছে,
আঙ্গুল তুলে ওয়াক্‌ তুলছে, হাসাহাসি করছে আমাদের মাথামোটার দল বলেও
ডাকছে। আর আমরা? আমরা দেখছি কার গায়ে কোন রঙের বিষ্ঠা মাখা আছে। রোজ
সকালে নিজের গায়ের ল্যাতপ্যাতে ঘেন্নার আবরণ দেখে গর্ব করে হুঙ্কার দিয়ে
উঠি আমরা… “আমি হিন্দু!” আর ওদিক থেকে হুহুঙ্কার আসে, “শালা কাফের!
ইসলামই সব!” তারপর আমরা দেখে নিই, আর কোন কোন দিক থেকে হুঙ্কার আসছে,
বৌদ্ধ, জৈন, খৃষ্টধর্ম, এদের হাঁক আসে নাকি? নাহ্‌, এদের দেখেছি চুপচাপ
নর্দমার পাড় ঘেঁষে ভেসে আছে নিরুপায়। নিজেদের হাঁড়ি-কড়াই আলাদা করে রেখে
বলি, ওদের ছুঁতে দেবো না। নর্দমার বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি যে চিলতে জমিটুকু
বেঁচে আছে আমার মায়ের নামের, তার প্রায় পুরোটাতেই আমরা নর্দমা ছড়িয়ে দিতে
পেরেছি। জমিতে বাসের অনুমতি নেই আমাদের মতো অমেরুদণ্ডীদের। আর বেঁচে থাকা
জমিতে আমাদেরই বেছে নেওয়া রাজা-রানিরা আমাদের বলে দিচ্ছে, কোন রঙের
বিষ্ঠাবৃত কৃমি দেখলেই মেরে ফেলার জন্য রেরে করে ছুটে যেতে হবে নর্দমা
তোলপাড় করে। বলে দিচ্ছে রঙ আলাদা দেখলেই, তুলে নাও তাদের মেয়েদের, রঙ
ভিন্ন হবার অপরাধে দুফালা করে দাও তাদেরএক-একটাকে।

আবার মেয়ে নামের যে কৃমিগুলো রয়েছে, তাদের গায়ে দুরকম বর্জ্য। ধর্ম আর
লিঙ্গ। টিংটিংটিং ঘণ্টাধ্বনির সাথে জয় মা কালী বা দুর্গে দুর্গতিনাশিনী
ডাকলে তারাও আজকাল মুখ ফিরিয়ে নেয়… মানুষ করে পাঠিয়েছিলাম, মান আর হুঁশ
দুইয়েরই বিসর্জন দিলে তাদের বাঁচাবো না, প্রকারান্তরে তোরাও এখন রাক্ষস
আর পিশাচ; বরং তোদের সংহার হোক। ওদিকে হিজাবের নিচে যে কৃমিললনা, তার
আকুল ডাকেও আল্লা বোধহয় কান বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেন। যে দেশের মাটি
আমাদের ছিল, তার কেবল নর্দমাটাই রয়ে গেছে আমাদের। পচা পাঁক আর বর্জ্য
ঘাঁটতে ঘাঁটতে আর মাখতে মাখতে আমরা ভুলে গেছি, আমাদেরও ছিল উপচে যাওয়া
শস্যভাণ্ডার, আমাদেরও ছিল মিষ্টি জলের সরোবর। এসব এখন শুধু তাদের, যাদের
নোংরা হিংস্র নখে বাঁধা আমাদের সবার সুতো। ওরা আমাদের খায়। আর আমরা
নিজেদের মেরে মরি। মাগো, মা আমার! এ তুমি কেমন সন্তানেদের গর্ভে ধরেছো
মা? যে তুমি জন্ম দিয়েছিলে বীর সন্তান সুভাষচন্দ্রকে, যার কোলে ছিলো
মারাঠা বীরেরা, যে দেশের সংবিধানের জন্ম তোমার কৃতি সন্তানের
ধর্ম-অধর্মের লড়াইয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে, সেই দেশে তোমার সন্তানেরা আজ একে
অপরকে খেয়ে ফেলছে যে!

ওই আসছে ঝাঁসির রানির তরোয়ালের ধার, আসছে মাতঙ্গিনী হাজরার মুষ্টিবদ্ধ
তেজ, দেশবন্ধু আবারও আসছেন মায়ের অমানুষ সন্তানেদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে
যেতে, এগিয়ে আসছেন ইতিহাসের পাতা ছিঁড়ে বিনয়-বাদল-দিনেশের জেদ, বীণা
দাসের সাথে হাতে হাত ধরে এগিয়ে এসেছেন তারা রানি শ্রীবাস্তব, ভিকাজী
কামা, বেগম হজরত মহল! মৌলানা হাসরত মোহানী গর্জন করছেন “ইনকলাব
জিন্দাবাদ” এবং বিস্মৃতির আস্তরণ সরিয়ে এগিয়ে আসছেন মৌলবি আহমেদুল্লাহ
শাহ্‌ ফৈজাবাদী;  আর সবার সামনে তীরের ফলার মতো উড়ে আসছে এক ছোট্ট ছেলে…
ক্ষুদিরাম বসু! চোখ খুলেই স্বপ্ন দেখছি মাগো। দেখছি এঁদের সাথে এগিয়ে
আসছেন তোমার সকল বীর সন্তানসন্ততি! বিশ্বাস করতে চাইছি কাতারে কাতারে
পুনর্জন্ম হোক। এ নরককুণ্ড থেকে আমাদের পরম মমতায় তুলে নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে
আমাদের ক্লিষ্ট মায়ের উজ্জ্বল হয়ে ওঠা দৃষ্টির সামনে। বুকফাটা কান্নায়
ভেঙে পড়ছি এতকালের হানাহানিতে বয়ে যাওয়া এক রক্তনদীর সামনে বসে। বোঝার
চেষ্টা করে চলেছি, কোনটা কার রক্তের বিন্দু… পারছি না, কিছুতেই পারছি না!

নিজের হাহাকারের সাথে জুড়ে যাচ্ছে আশেপাশের সবার হাহাকার। ইতিহাসের পাতা
থেকে উঠে আসা আমাদের দেবতারা রুখে দাঁড়িয়েছেন প্রজাখাদকদের সামনে। পিছু
হটতে হটতে সেসব পিশাচেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে ছায়ার মতো।
আর আমি, ধড়মড় করে উঠে বসেছি আমার বিছানায়। ওঘরে টেলিভিশনের পর্দায়
দেখাচ্ছে দাঙ্গা আর ধর্ষণের রসালো খবর। যাক, আমার ঘরে এখনও আঁচ আসেনি!
মায়ের করা চায়ের কাপ হাতে খবরের চ্যানেল পালটে অন্য চ্যানেলে গেলাম, আর
মিঠুন চক্রবর্তী যেন আমার  নিশ্চিন্ত হাতের চায়ের কাপকে দেখে বলে উঠলো,
“তোমার কথা শুনলে আমার হাগা পায় বিপিন।“

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *