দলিপের আজ বড় বেশি মনে পড়ছে সেই ছোটবেলার কথা। মায়ের যৌবনবেলার মুখ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ কেশরিলাল রণজিৎ সিং-এর প্রতাপ—কীভাবে ভুলবে সে! কতবার চেষ্টা করেছে মায়ের সঙ্গে দেখা করার, কিন্তু ওরা তাকে মায়ের কাছে যেতে দেয়নি। ১৮ বছর বয়সে ওর মা তখন কাঠমান্ডুতে থাকত, সেখানে চিঠি লিখেছিল মাকে। যাতে মা ওর কাছে এসে থাকতে পারে। কিন্তু বৃটিশরা সেই চিঠি ওর মায়ের কাছে পৌঁছতে দেয়নি। সেই খবর জানতে পেরে, এরপর দলিপ পণ্ডিত নেহেমিয়া গোরে’কে মায়ের কাছে দূত হিসেবে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাঁকেও ওর মায়ের কাছে যেতে দেয়নি ওরা। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে নিজেই যেতে চেয়েছে মায়ের কাছে। লগইনের নাম করে কাঠমান্ডুর বৃটিশ অফিসারের কাছে দরবার করেছিল ও। এর মধ্যে সুখের কথা এটাই যে, ওরা এবার আর ওর মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতে বাধা দেয়নি। অবশ্য তার আগে রিপোর্টে লেখা ছিল—জিন্দ কৌর, মহারাজা রণজিৎ সিং-এর ছোট রানী, এখন আগের মতো সুস্থ নন। বার্ধক্যের ভারে শরীর অশক্ত হয়ছে তাঁর এবং চোখেও প্রায় দেখেন না বললেই চলে। এই রিপোর্ট পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে তবেই এবারে দলিপকে ভারতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দলিপ ভারতে যাবে দশ বছর পরে। আর মায়ের সঙ্গে দেখা হবে তেরো বছর বাদে! ভাবলেই অবাক লাগে ওর। এত দীর্ঘ সময় কেটে গেল এই বিদেশে! একবারও মনে পড়ল না নিজের দেশের কথা, মায়ের কথা! যদিও এই সব ভাবনা এখন ওকে কুরে কুরে খায়। প্রিন্স অ্যালবার্টের দেওয়া ভাতা আর এক বহর সেনা নিয়ে বহাল তবিয়তে এদেশে সুখে দিন কাটছে তার। এদিকে মা অশক্ত, অন্ধ হয়ে পড়ে আছে একা, একা! নিজের ওপর লজ্জা, ঘেন্নায় কুঁকড়ে রয়েছে দলিপ। সেও তো একমাত্র সন্তান তাঁর মায়ের। তার কি উচিত ছিল না আরও আগে দেশে গিয়ে নিজের মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসার? অবশ্য সে চেষ্টা যে করেনি ও তাও তো না! ওরাই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি ওকে। আবারও রাগ গিয়ে পড়ল রানীর ওপর। তবে রানী ওকে আরাম আয়েশ আর বিলাসের ব্যবস্থায় কিন্তু কোন কার্পণ্য করেননি, এও সত্যি। আর এই বিলাসের অভ্যেস এমন এক কুঅভ্যেস যে, সাধারণ ভাবে থাকার কথা দলিপ এখন ভাবতেই পারে না।
সেদিন বিদ্যা হঠাতই বমি করছিল বারবার নয়ত ওয়াক তুলছিল ক্রমাগত। কুপিল্লা বিদ্যার মুখে জলটল দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করছিল মরিয়া হয়ে। আর তাই দেখে বিদ্যার মায়ের কী ফিকফিক হাসি! শেষ পর্যন্ত তিনি বলেই বসলেন, ‘ও জামাই! তুমি কেমনধারা লোক বল তো? মেয়ে আমার গর্ভবতী হয়েছে, এটুকুও বোঝনি?’ একথা বলেই অবশ্য মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তিনি অন্য ঘরে চলে গেলেন। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না কুপিল্লা। বিদ্যারও মুখচোখ ক্লান্তি কাটিয়ে জেগে উঠেছে আবার। কুপিল্লা ওর পেটে হাত দিয়ে বলল, ‘তার মানে এখানে রয়েছে সে এখন! কেমন দেখতে রে ওকে?’ খিলখিল করে হেসে উঠল বিদ্যা। কেমন বোকাসোকা লোক দেখ! এখনই কি বোঝা যায় সে কেমন দেখতে হবে! এরপর আর ওদের যেন কথা ফুরোচ্ছিলই না সেদিন। নিরন্তর বকবক করে যাচ্ছিল ওরা। একসময়ে বিদ্যার মা আবার এসে খাবার জন্য ডাকলেন ওদের। খাবার বেরে দিতে দিতে অবশ্য গম্ভীর মুখে বললে, ‘শোন এবার তোমরা! আরেকটা জীবন আনছ পৃথিবীতে। তার জন্য নিজেদের রোজগার বাড়াতে হবে তোমাদের। কলসির জল গড়ালে আর কদ্দিন যাবে?’ সম্বিত ফিরল যেন কুপিল্লার। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তিনিই উপায় বলে দিলেন অবশ্য। মায়ের জাত তো। মেয়ের বা মেয়ের জামাইয়ের ভালই চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। পরেরদিন ওদের পরিবারেরই একজনের সঙ্গে কুপিল্লাকে কফিবাগানে কাজের জন্য পাঠাবেন, স্থির হল।
দলিপের বিলাস ব্যসনের জন্য এমনিতেই তাঁর নাম সুপরিচিত ছিল সেই সময়ে। শুটিং পার্টি আর হাইল্যান্ড কস্টিউমে তার সাজসজ্জার জন্যই তাকে ব্ল্যাক প্রিন্স অফ পার্থশায়ার নাম দেওয়া হয়েছিল। দলিপের পূর্ব বাসস্থান ক্যাসেল মেনজিস-এর লীজ শেষ হয়ে যাওয়ায়, ১৮৫৮ সালে দলিপ আর্ল অফ ব্রেডেলবেন-এর কাছ থেকে এক অকলিন ভাড়া নেন। দলিপ ভাবছিল, এই সময়ে—যখন গৌরাম্মা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, একমাত্র মায়ের কাছে গেলেই ওর হৃদয় শান্ত হবে। গৌরাম্মার বিয়েতে সে যাবে না কিছুতেই, এতদিনে সে সব খবরই পেয়েছে, গৌরাম্মার মুখ দর্শন করবে না সে আর।
একদিকে গৌরাম্মা বিয়ের প্রস্তুত্তি শুরু হয়েছে, অন্যদিকে দলিপের ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল। কলকাতায় স্পেনসেস হোটেল আপাতত তার লক্ষ্য। এই হোটেল নাকি একমাত্র হোটেল, যা এশিয়ার মধ্যে, ভারতের কলকাতায় বৃটিশরা প্রথমবারের মতো স্থাপন করে। ফলে এই হোটেল দেখাও তার কাছে এক অভিনব ব্যাপার হবে। আজ এই বাইশ বছর বয়সে এসে মায়ের কী রূপ দেখবে, এখন সেই ভাবনাই তার মাথায় ঘুরছে। দেখতে দেখতে যাত্রার দিন এসে গেল। ১৮৬১ সালের ১৬ই জানুয়ারি স্পেনসেস হোটেলের ঘরে মায়ের সঙ্গে দেখা হল দলিপের। তিনি এখন পুরোপুরি অন্ধ। দলিপকে আদর করলেন, ছুঁয়ে দেখলেন তিনি। মুখ চুম্বন করতে করতে তাঁর অন্ধ চোখ থেকে জলের ধারা বেয়ে নামল গাল বেয়ে। দলিপও সামলাতে পারল না। পাঞ্জাবের দুই কঠিন হৃদয়ের মানুষ আবেগে ভেসে যাচ্ছে—এই দৃশ্য দেখার জন্য সেই ঘরে যদিও আর কেউ ছিল না তখন। দলিপকে জিন্দ কৌর পাঞ্জাবের বীরত্বের কাহিনি শোনাচ্ছিলেন একে একে। শোনাচ্ছিলেন তাদের ধর্মের কথা। শিখ ধর্মের মাহাত্ম্য যে না বুঝেছে, সে আদৌ পাঞ্জাবের নয়। কয়েকটি দিন কেটে গেল দলিপের এভাবে মায়ের কাছে। নিজের শেকড়ের সন্ধান পেল যেন সে, মাটির গন্ধ মাখল গায়ে। এই তার দেশ, এই তার সব। যদিও আপাতত তাকে সেই বিদেশেই যেতে হবে মাকে নিয়ে। এখানে তাকে থাকতে দেবে না ওরা। বৃটিশদের হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হবে তাদের।
কুপিল্লা যেহেতু পড়াশুনো জানে, তাই খেতের কাজে নয়, অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট সামলানোর কাজে সহায়তা করার জন্য তাকে নিযুক্ত করল স্বয়ং মুরুগান। মোটের ওপর কুপিল্লার কাজ হল, খেতের একটা অংশে গিয়ে চারা লাগানো থেকে তার পূর্ণ দশা পর্যন্ত পৌঁছতে যা খরচ হয় তার হিসেব রাখা। এতে কুপিল্লার মর্যাদাও বাড়ল বৈ কমল না। মাইনেপত্রও মুরুগান ভালই দেবেন। ফলে এর থেকে উত্তম কিছু আপাতত তার আর চাওয়ার নেই। বিদ্যার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেদিনই ঠিক করে নিল, এবারে তাদের নিজস্ব একটা ঘর বানাতে হবে। কেন সে শ্বশুরের ঘরে থাকতে যাবে? খুব স্বাভাবিক ভাবে বিদ্যাও খুশী। এভাবে পূর্ণতা নিয়ে জীবন সামনে এসে দাঁড়াবে, কিছুদিন আগেও ওরা ভাবেনি। এখনও লেনিনের কথা মনে পড়ে। অসময়ের বন্ধুকে কি ভোলা যায়? তাকে এই সুসংবাদ পৌঁছে দিতে হবে একদিন নিজে গিয়ে। এমনিতে গোপীর চাকরি ছেড়ে চলে আসার খবরও লেনিনকে দেওয়া হয়নি। এই সব ভাবতে ভাবতে নতুন চাকরিতে মন লাগিয়ে কাজ করতে শুরু করল কুপিল্লা। নতুন কাজ, নতুন বিষয়, ছুটিও পায়নি—ফলে লেনিনের কাছে আর যাওয়া হল না। এই হয়ত দুনিয়ার দস্তুর। নতুন এসে পুরনোকে ভুলিয়ে দেয়। তবে মুরুগানের সঙ্গে কুপিল্লার দেখাসাক্ষাৎ কমই হত। বন্ধুত্বের প্রশ্নই নেই। সে বস্, কুপিল্লা তাকে বসের সম্মানই দিত। কিন্তু সুখ তো আর নিরন্তর বয়ে যাওয়ার নয়। স্বস্তির সঙ্গে তার আবহমানের বিচ্ছেদ। একদিন দুপুরে কুপিল্লা খবর পেল, বিদ্যা অসুস্থ। ততদিনে তাদের নিজের ঘর হয়েছে। সেই ঘর, দালান নিজে হাতে মেজে, ধুয়ে তকতকে করে রাখে বিদ্যা। অনেকবার তাকে বারণ করেছে, এই সময়ে ভারী কাজ না করতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ফলে বিপদ ঘটেই গেল। পিছলে পড়ে গিয়ে গর্ভপাত হয়ে গেল তার। বাড়ি ফিরে কুপিল্লা রক্তাক্ত বিদ্যাকে ফার্মের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল তড়িঘড়ি। তাঁর চিকিৎসা অনুযায়ী সুস্থও হয়ে উঠল কিছুদিন পরে। কিন্তু বিদ্যার মনের ঘা বোধহয় শুকনোর সময় পেল না। প্রতিবার গর্ভাধানের কিছুদিন বাদেই রক্ত দেখতে হত তাকে। এক অনাগত সন্তানকে ঘিরে আশা, কল্পনা, আকাঙ্ক্ষার জগতটা তৈরি হতে না হতেই ভেঙে চুরমার হয়ে যেত বারবার। বিদ্যা ক্রমশ শুকিয়ে আসছিল। সেই উচ্ছলতা চলে গিয়ে তার চোখের তলায় গভীর কালির দাগ জেঁকে বসেছিল। ডাক্তারের পরামর্শে কিছুদিন শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হল ওর। কিন্তু কিছুতেই কিছু সুরাহা হল না। একসময়ে কুপিল্লা বিদ্যাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সন্তানের আশা ত্যাগ করতে বলল। মুখে মেনে নিল সে ঠিকই। কিন্তু মনের ভেতরে যে শূন্যতা স্থায়ী হয়ে রইল, তার খবর কুপিল্লাও পায়নি।
দলিপ মাকে নিয়ে পার্থশায়ারে ফিরে আসে। সেখানে অল্প কিছুদিন থাকার পরে অ্যাবারফেলডি’র কাছে গ্র্যান্ডুলি এস্টেট ভাড়া নেয়। সেখানেই মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করে। তাদের সঙ্গে সেখানে থাকতেন ফাদার লগইনও। ১৮৬৩ সালে দলিপের মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন পরে লগইনেরও মৃত্যু হয়। মায়ের সৎকার করার জন্য আরও একবার এবং শেষবারের মতো দলিপ ভারতে পা দিয়েছিলেন। তারপরে দলিপ আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।
এরপরে তিনি নরফোক ও সাফোকের বর্ডারে এলভেডেন-এ ১৭,০০০ একর জায়গা কেনেন কোম্পানির অর্থে। এই এলভেডেন হল আর তার চারপাশের এলাকায় স্কুল, চার্চ, কটেজ বানিয়ে দেন। খেলার জন্য বিশাল এলাকার বন্দোবস্ত করেন। এই কারণে ইংল্যান্ডে তার সুনাম বৃদ্ধি হয়েছিল সেই সময়ে। যদিও কোম্পানির বক্তব্য ছিল, দলিপ হিসেব বহির্ভূত প্রচুর খরচ করেছিলেন। ফলে তার মৃত্যুর পরে তার সম্পত্তি বেচে সেই দেনা শোধ করতে হয় তাদের। স্যার দলিপ সিং দুবার বিবাহ করেন। বাম্বা মুলারকে ১৮৬৪ সালে এবং আডা ডগলাসক ওয়েথেরিলকে ১৮৮৯ সালে। আট সন্তানের মধ্যে বাম্বার ছয় সন্তানের পিতা তিনি।
এরপরে ভারতে তার কাজিন ভাই সর্দার ঠাকুর সিং সন্ধাওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। ১৮৮৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাওয়ালা তার ছেলে নরিন্দার সিং ও গুর্দিত সিং এবং এক শিখ গ্রন্থি, প্রতাপ সিং গিয়ানির সঙ্গে অমৃতসর থেকে তার কাছে ইংল্যান্ড রওনা দেন। এইভাবে দলিপ আবার শিখ ধর্মের প্রতি আনুগত্য দেখান। ১৮৮৬ সালে দলিপ ভারতে ফিরে যেতে চাইলে ইন্ডিয়া অফিস তাকে অনুমতি দেয়নি, যদিও তার আগেই দলিপ ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যদিও তাকে জোর করে অ্যাডেন-এ অ্যারেস্ট করা হয় এবং আবারও ইউরোপ ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৮৯৩ সালে দলিপ সিং ৫৫ বছর বয়সে প্যারিসে মারা যান। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মৃতদেহ ভারতে নিয়ে যায়নি বৃটিশরা। তাদের ভয় ছিল সেই মৃতদেহ দেখে ভারতীয়দের ক্ষোভের মুখে পড়তে হতে পারে তাদের। ফলে এলভেডেন চার্চে তাঁর প্রথম স্ত্রী বাম্বার পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের ছেলে প্রিন্স এডওয়ার্ড অ্যালবার্ট দলিপ সিংকেও সমাধি দেওয়া হয়েছিল।