• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ২ ।। খন্ড – ৭)

কফি পাহাড়ের রাজা

দ্বিতীয় পর্ব:

৭)

যথাসময়ে রানী মাহাদেবাম্মার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে কেঁদে উঠলো। মা ও শিশু সুস্থ শরীরেই ছিল তখন। রাজারাজেন্দ্রর কন্যা সন্তান লাভ করেছিলেন আবারও, আর তাঁদের প্রিয় কন্যার নাম রেখেছিলেন রানীর নাম অনুসারে—দেবাম্মাজী। রানীকে কথা দিয়েছিলেন বলেই শুধু না, এই মেয়ে রাজার অতি প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাঁর পরে দেবাম্মাজিকেই তিনি রানীর মর্যাদা দিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে যাবেন, এমন স্থির করে ফেলেছিলেন। তাঁর ভাই লিঙ্গ রাজেন্দ্র বা আপ্পাজির সমস্ত ষড়যন্ত্র তিনি উপেক্ষা করছেন এই মুহূর্তে। ঠিক সময়ে ওদের থামিয়ে দিতে তাঁর দেরি হবে না। আপাতত দেবাম্মাজি বড় হোক। আর রানীর কথামতো তাকেও বিলেতে নিয়ে যাবেন তিনি। স্যার রবার্ট অ্যাবারক্রম্বের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা তিনি সেরে রেখেছেন আগেই।
  খুব ভোরে উঠে পড়েছিল কুপিল্লা। আসলে সেভাবে ঘুমোতে পারেনি ও কাল রাতে। দুঃস্বপ্ন দেখছিল বারবার। মায়ের আর্ত চিৎকার আর বিলাপ দেখতে পাচ্ছিল সেই স্বপ্নে। এখন এই সকালের আলোয় মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ও। রান্নাঘরে কিছু করছে মা। বয়সের ছাপ পড়লেও মা যেন এখনও নাবালিকাই রয়ে গেছে। সম্ভবত অমন প্রতাপশালী স্বামীর তত্ত্বাবধানে থাকতে থাকতে নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছে বা মতামত, কিছুই তৈরি হয়নি তাঁর। অল্পেতেই হাসে, অল্পেতেই কাঁদে। আর মায়ায় জড়িয়ে রাখে তাঁর ছোট্ট পৃথিবীকে। বেচারি মা! এখনও জানেই না ছেলে তাঁর সামনে কী বলতে চলেছে একটু বাদেই! একে একে থালা সাজাচ্ছে মা। বাবাও স্নান, পুজো সেরে চলে এসেছে। নাঃ! এবারে আর বুক কাঁপল না কুপিল্লার। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সে মুখে প্রশান্তি, আত্মতৃপ্তি, সুখ, সবই লেখা রয়েছে। হয়ত কুপিল্লা এবার ওই মুখে কিছুটা অসম্মানের দাগ আর বিচ্ছেদের যন্ত্রণা লিখে দেবে। হয়ত তাকে স্বার্থপর বলবে দুনিয়া, হয়ত কেন, তাকে তাড়িয়েই দেবে তার জাতের লোকেরা। যাইই হোক না কেন, ফয়সালা একটা করার সময় এসে গেছে। খেতে বসে খাবার নাড়াচাড়া করছে কুপিল্লা। মা জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, খিদে নেই নাকি? খাচ্ছিস না যে!’ মায়ের মুখের দিকে তাকাল না ও। খাবারের থালার দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করল—আমার তোমাদের একটা কথা বলার আছে। বাবা কপাল কুঁচকে একটু থমকালো। তারপর আবার খাবার চিবোতে চিবোতে জানাল—বলে ফেল! ‘আমি এ বিয়ে করতে পারব না’। মা চিৎকার করে উঠল—কেন? বিয়ে করতে পারবি না কেন? হাত ধুয়ে উঠোনে নেমে দাঁড়িয়ে বাবার মুখের দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকাল কুপিল্লা। ‘একটি মেয়ের কথা বলি। ব্রাহ্মণ নয়। কিন্তু সে খুব ভালো মেয়ে, এটুকু আমি হলফ করে বলতে পারি। তোমাদের কোনরকম অসম্মান বা অবহেলা সে করবে না। আমি ওকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করতে পারব না’। বারান্দার খাবার জায়গায় দুই বয়স্ক মানুষ চিত্রার্পিতের মতো স্থির হয়ে রইল। ওদের ওভাবেই রেখে কুপিল্লা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এল। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর ওপরওলাকে ধন্যবাদ দিল, কেন জানি। হয়ত এতদিনের গোপন ইচ্ছে প্রকাশ করতে পেরেছে বলে।
  দিন কেটে যাচ্ছিল একরকম। দেবাম্মাজির আট বছর বয়স হয়ে গেল দেখতে দেখতে। তখন রাজারাজেন্দ্রর পরিকল্পনা দেখে বোধহয় অলক্ষে কেউ হেসেছিলেন। যাঁর ইচ্ছায় কর্ম, তিনিই মূল কর্মকাণ্ডের স্রোত অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন একদিন। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। হঠাতই একদিন মহাদেবাম্মাজি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কোন ওষুধেই তাঁর শরীর আর সুস্থ হল না। দেহ রাখলেন তিনি আচমকাই। পুরো কোরাগু শোকে মুষড়ে পড়ল। দেবাম্মাজির বোঝার বয়স হয়নি তেমন। মাতৃহারা হয়ে সে পিতাকে আঁকড়ে ধরল প্রাণপণে। এদিকে বিপুল প্রতাপান্বিত বীরা রাজারাজেন্দ্র তাঁর প্রিয় রানীর অভাবে একপ্রকার দিশেহারা হয়ে উঠলেন। যেন তাঁর শরীর থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রাণ নেই তাঁর আর। জীবন্ত মড়া হয়ে কোনরকমে বেঁচে রইলেন আরও দুবছর। দুঃসহ এই শোক সামলে উঠতে না পেরে অকালমৃত তাঁর স্ত্রীর কাছে চলে গেলেন। দেবাম্মাজিকে যদিও রানী হিসেবে ঘোষণা করে দিয়ে গেছিলেন রাজা রাজেন্দ্র। ১৮০৯ সালে দেবাম্মাজির তখন দশ বছর বয়স। দুবছর দেবাম্মাজিকে সামনে রেখে কোরাগুর শাসনভার হাতে রেখেছিলেন রাজারাজেন্দ্রর ছোট ভাই লিঙ্গরাজেন্দ্র বা লিঙ্গরাজা। কিন্তু ১৮১১ সালেই লিঙ্গরাজা দেবাম্মাজিকে সরিয়ে নিজেই রাজা হয়ে বসলেন। ১৮২০ সালে তিনিও মারা যান। তারপরেই সিংহাসনে বসেন তাঁর কুড়ি বছরের পুত্র চিক্কাবীরারাজেন্দ্র। যিনি নিজে ছিলেন অত্যন্ত কুটিল, হিংস্র আর প্রতিশোধ পরায়ণ। তাঁরও নাম ছিল বীরারাজেন্দ্র। দোদ্দা বীরারাজেন্দ্রর নামের থেকে নিজেকে পৃথক দেখানোর জন্য নিজেই চিক্কাবীরারাজেন্দ্র নাম নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। প্রথমেই তিনি সিংহাসনের জন্য নিজের পথ পরিষ্কার করার অভিপ্রায়ে নিজের সমস্ত আত্মীয়, সহচরকে খুন করেন, এমনকি দেবাম্মাজিকেও খুন করতে তাঁর হাত কাঁপেনি।
  এর কিছুদিন বাদেই, ১৮২১ সালে চিক্কা বীরারাজেন্দ্রর মাথায় আরও এক খেয়াল চাপে। পাহাড়ের ওপর শায়িত দোদ্দাবীরারাজা, পরম সুখে নিদ্রিত রয়েছেন তাঁরই প্রিয়তমা পত্নী, মহাদেবাম্মার পাশে। সেই সমাধি ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল দুই মিনার। দোদ্দাবীরারাজা নাকি পত্নীর মৃত্যুর পর থেকেই নিজের সমাধি তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। পত্নীর সমাধির পাশেই থাকবেন চিরদিন, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা। আর এ ইচ্ছার সঙ্গে আরও এক জেদ কাজ করেছিল তাঁর মনে। তাঁর চিরশত্রু টিপুর সমাধির থেকেও যেন তাঁদের সমাধি রূপে ও স্থাপত্য নিদর্শনে প্রকৃষ্ট হয়। আর সেই ইচ্ছে থেকেই সমাধি তৈরি করতে শুরু করেন নিজের। তাঁর ভাবনায় ছিল এক নতুন স্থাপত্য শৈলীর কল্পনা। যা কিনা ইসলামিক রীতির নয়, নিজেদের অর্থাৎ লিঙ্গায়ত রাজাদের বিশ্বাস মতে হিন্দু ধর্মীয় চিন্তার। স্বয়ং মহাদেবের কৃপাদৃষ্টি যেন চিরদিন থাকে তাঁদের সমাধির ওপর। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন এক, আর বিধাতার ইচ্ছে ছিল আরেক। ফলে যে বছর, তিনি সমাধির কাজ শুরু করেছিলেন, সেই বছরেই মারা গেলেন। এবারে তাঁর সমাধির কাজ হতে থাকল সম্পূর্ণ মিস্ত্রীদের ইচ্ছে মতো। দোদ্দা বীরারাজেন্দ্রর নতুন চিন্তাকে যেটুকু রূপ দিতে পেরেছিলেন, তার সঙ্গে মিশেল হতে থাকল মুসলমান কারিগরদের তৈরি ইসলামিক গথিক স্ট্রাকচারের। ফল স্বরূপ এক নতুন সংকর স্থাপত্য তৈরি হল। ঠিক টিপু সুলতানের সমাধির অনুকরণে তৈরি হল পাশাপাশি দুটি একইরকম সমাধি। সমাধির মাথায় গম্বুজের ওপর স্থাপিত হল পিতলের কলস। মুদ্দুকেরি শহরের উত্তরে পাহাড়ের ওপর মাটির বাঁধ দিয়ে ঘেরা এই দুটি সমাধির পিতলের কলসির ওপর সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ে রোজ। আর সেই সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পুরো মুদ্দুকেরি শহরে। এ যেন শিবের প্রসাদ ধন্য দোদ্দা বীরা রাজেন্দ্র ও তাঁর মহিষীর আশীর্বাদ। উপরন্তু দুটি সমাধিতেই রয়েছে সুচিত্রিত ও সুগঠিত বেশ কিছু জানলার আকার, মাথা ঢাকা, সরু আর খাড়া সিঁড়ি দিয়ে সমাধির একটানা প্রশস্থ বারান্দায় গেলে পুরো কোরাগুর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় এখান থেকে। মুদ্দুকেরি শহরটির চেহারা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কোরাগুর এই সমাধি দুটি স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে রয়ে গেছে।
  চিক্কা বীরা রাজা একদিন হঠাতই এই পাহাড়ে এসে সমাধিদুটি দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লেন। এবং তৎক্ষণাৎ স্থির করলেন, এখানেই তিনি তাঁর পিতা লিঙ্গরাজার সমাধিও তৈরি করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গড়ে উঠল লিঙ্গরাজা ও তাঁর রানীদের সমাধিস্থল। কাজ শেষ হলে একদিন বিকেলে চিক্কা বীরারাজেন্দ্র এসে দাঁড়ালেন সমাধির খোলা বারান্দায়। হুহু করে হাওয়া পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে তাঁর। বিকেলের রোদ পড়ে আছে নিচের শহরে। যেন এই এক টুকরো আলো দেখার জন্যই তিনি আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন। যদিও এখানে ছায়া ছায়া ভাব। পশ্চিমের পাহাড়ের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কেঁপে উঠলেন রাজা। শীত করল তাঁর? নাকি কোন এক অলৌকিক প্রভাব? রাজা ক্রমশ মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ছেন। শনশন হাওয়া বেগ বাড়িয়ে এসে তাঁর কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে। আঁধার নেমে আসছে বারান্দায়। চারিদিকে কেউ কোথাও নেই, তবু মনে হচ্ছে কে যেন এসে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পাশে। কে ও? চোখ কচলে আবার তাকালেন রাজা। মনে হল যেন এক বীরের দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনতে পেলেন তিনি। হ্যাঁ, এবারে আর চিনতে ভুল হয়নি ওঁর। এই সেই প্রবল পরাক্রমী যোদ্ধা রাজা, দোদ্দা বীরারাজেন্দ্র। সারাজীবন যিনি এই রাজ্য, এই শহরকে কেন্দ্র করে লড়াই চালিয়ে গেলেন। জীবনপাত করে দিলেন এখানে। মৃত্যুর পরে যেন তিনি এখানে তাঁর প্রিয় রানীকে সঙ্গে করে নিশ্চিন্তে, একটু শান্তিতে থাকবেন বলে এসেছেন। এখান থেকে নিজের প্রিয় শহর, পাহাড় আর কোরাগুর ওপর নজর রাখবেন বলে এসেছেন। আর সেই শান্তি বিঘ্নিত করতে এসেছেন চিক্কা! চমকে উঠে আবারও তাকালেন চিক্কা চারপাশে। নাহ! কেউ কোথাও নেই। তবু যেন একজন বীরের পদধ্বনি, তৎসহ কাপড়ের খসখস ও মৃদু চুড়ির শব্দ তিনি পাচ্ছেন এখানে। নিজেকে চিক্কার সেই মুহূর্তে মনে হল, অনাহূত এক আগন্তুক তিনি, স্রেফ হিংসার বশে যিনি তাঁরই পূর্বপুরুষের কীর্তিকে ছাপিয়ে যেতে চাইছেন।
  এই ঘটনার পর থেকে চিক্কাবীরারাজার ক্রমশ মনোভাব বদলাতে থাকে। নিষ্ঠুর এক রাজা, যেন নিজের পূর্বকৃত পাপ কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়ে পড়লেন। এবং এ জন্য কী করণীয় ভেবে উঠতে না পেরে, অনাবশ্যক বৃটিশদের সঙ্গে বচসায় মেতে উঠলেন। ভাবখানা এমনই, যেন বৃটিশরাই তাঁর শত্রু, তাদের অধীন থেকে কোরাগুকে মুক্ত করলেই সমস্ত পাপস্খলন হবে তাঁর।
  সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসেছিল কুপিল্লা। আর ভেবেছিল, আজই হয়ত এ বাড়িতে ওর শেষ রাত। সে একপ্রকার নিশ্চিত ছিল, বাবা ওকে তাড়িয়ে দেবে। বাড়ি ফিরে দেখল মা ঘরে শুয়ে আছে। আলো জ্বালেনি, সন্ধ্যা দেয়নি। বাবা তাঁর নিজের কেদারায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। আলো জ্বালল ও সব ঘরে। মা কফি বানাতে উঠে গেল ওকে দেখে। আর কফির গ্লাস হাতে নিতে যাওয়ার মুহূর্তে বাবার প্রবল চিৎকারে খানখান হয়ে শব্দ আছাড় মেরে পড়ে গেল মেঝেতে। স্টিলের গ্লাসটা গড়াতে গড়াতে কোথায় যে গেল…কফি ছিটকে এলো কুপিল্লার জামায়। মায়ের বুঝি হাত পুড়ে গেল! রাগে বাবা থরথর করে কাঁপছে তখন। তিনি নিজেই জানেন না, কী করবেন বা বলবেন। ‘এখুনি তুমি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও! এই বাড়িতে থাকতে গেলে আমার কথা শুনে চলতে হবে। আর নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী চলার ইচ্ছে হলে নিজের রাস্তা নিজে দেখ! এই বাড়ির জলও বন্ধ হয়ে গেল আজ থেকে তোমার জন্য!’ কুপিল্লার কি মন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল? ও কি জানতে না, এমন হতে পারে? সব জেনেশুনেই নিজেকে প্রস্তুত করেছে ও এই কদিন ধরে। বরং বাবামায়ের কাছেই এই ঘটনা অপ্রত্যাশাতীত। মা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কফির গ্লাসটা ঠুং করে দাওয়া থেকে নিচে পড়ল। চমকে উঠলেন যেন উনি। কুপিল্লা নিচে নেমে গ্লাসটা কুড়িয়ে মায়ের পায়ের কাছে রেখে ওঁকে একবার প্রণাম করল। বাবার ঘরের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। কিছুদূর চেনা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই ওর মনে হল—এখন তাহলে কোথায় যাবে ও? বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এই একটাই জামা ওর গায়ে। পকেটে খুব সামান্য কিছু অর্থ। কাল হয়ত কোনরকমে খাওয়া জুটে যাবে, কিন্তু রাতে কোথায় থাকবে ও? এই গ্রামে যে গাছতলায় শুয়ে থাকবে, তাও হয় না। লোকেরা হাজারও প্রশ্ন করবে। কোন এক অচেনা জায়গায় গিয়ে কাজের খোঁজ করতে হবে। তবে আজ রাতটা বরং কোনো বন্ধুর ঘরে গিয়ে কাটিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কার বাড়ি যাবে? তাদের পরিবারকেও তো হাজার একটা কৈফিয়ৎ দিতে হবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল কুপিল্লা। মাথার ভিতরটা এখন পাথরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে ওর। হঠাতই মনে এলো লেনিনের কথা। একা থাকে, বয়সে অনেকটাই বড় ওর থেকে। সাতকূলে কেউ নেই। সারাদিন নেশাভাঙ করে আর বাড়ির সামনে একটা ছোট সাইকেল, বাইক সারানোর গ্যারেজ আছে, ওই তার রুটিরুজি। আর দেরি না করে ও লেনিনের গ্যারেজের দিকে এগোল। গ্যারেজের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে আলো জ্বলছে। কুপিল্লার ডাকে সাড়া দিল লেনিন। আর এত রাতে ওকে এভাবে আসতে দেখে বেশ অবাকই হল যথারীতি। ওর ঘরে গিয়ে সমস্ত খুলে বলল কুপিল্লা। প্রথমে থমকে গেল কিছুক্ষণ সে। তারপর বলল, ‘যাহ শালা! এসব কিসসা শুনে আমার নেশাই ফেটে গেল! কিন্তু জাত খোয়াবি ভাই? প্রেমট্রেম ভালই, কিন্তু জাত খুইয়ে, সমস্ত ঝঞ্ঝাট সামলে ভবিষ্যতে চলতে পারবি তো? আগে ভেবে দ্যাখ ভাল করে’। ওর কথা শেষ করার আগেই কুপিল্লা বলে উঠল, ‘আমার সব ভাবা হয়ে গেছে। আমি ওকেই বিয়ে করব। তার আগে আমার কিছু কাজ চাই’। ওর পিঠ চাপড়ে লেনিন বলে উঠল, ‘সাবাশ ভাই! কাল থেকে নাহয় আমার গ্যারেজেই কাজকাম শুরু কর আপাতত। তারপর ভাল কিছু কাজ পেলে চলে যেও’। সেই থেকে শুরু হল কুপিল্লার আরেক নতুন জীবন।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।