• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ২ ।। খন্ড – ৪)

কফি পাহাড়ের রাজা

দ্বিতীয় পর্ব:

৪)

টিপু! রাজেন্দ্র এখনও ভোলেননি সেই প্রথম সাক্ষাতের কথা। তারা তখন গোরুর দুর্গে রয়েছে। কানাঘুষোয় শুনছিল সেই সময়ে যে, হায়দার আলী মারা যাওয়ার পরেই টিপু নাকি তাদের কোরাবা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছেন, আর সমস্ত সেনাদের ওঁর দলে যোগ দিতে বাধ্য করেছেন। তাদের মুদ্দুকেরির প্রাসাদও টিপুর দখলে। এতদিন নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে একলা থাকতে থাকতে রাজেন্দ্রর মানসিক বয়স বেড়ে গেছে অনেকটাই। তিনি তখন সব বোঝেন। বোঝেন—এই যে এখানে তাঁরা আছেন, রাজকীয় মর্যাদায় আছেন, সে আসলে লোক ঠকানোর এক বাহানা। সবসময়ে ছায়ার মতো রক্ষীরা তাঁদের অনুসরণ করে, খেলতে খেলতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে গেলেই বাধা আসে। স্নেহ সম্বোধনে কেউ ডাকার নেই, আদর, যত্ন, ভালোবাসার ছোঁয়া নেই। প্রাচুর্যের অভাব নেই বটে, কিন্তু শৈশব, কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার যে রসদ, পরিবারের স্নেহ, যত্ন বা শাসন তার কোনটাই নেই এখানে। যবে থেকে এই সব বোধ তাঁর মনে জেগেছে, তবে থেকেই তিনি শুধু এখান থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছেন, তার ছক কষেছেন আপন মনে। সেই কিশোর রাজেন্দ্র কবেই মরে গেছে। তার দুচোখ এখন শুধু জ্বালা করে, দাউদাউ করে আগুন জ্বলে বুকের ভেতরে। আজন্ম স্বাধীন কোরাবা রাজপুত্রদের পরাধীনতার শেকলে বেঁধে রাখার যে কৌশল হায়দার আলী নিয়েছেন, সেই উদ্দেশ্য সফল বলা চলে। পুরো জাতি এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে।
  কিন্তু টিপু আসার পর যে চিত্রটা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, এটা বুঝতে পারেননি তখনও রাজেন্দ্র। গোরুর দুর্গে টিপুর সামনে তাঁদের আনা হল একদিন। সরাসরি তাঁর চোখের দিকে তীব্র চোখ মেলে তাকালেন টিপু। উফ! সে চোখ কী কঠিন আর নিষ্ঠুরের! ক্রুর আর খল! সারা শরীরে ভয়ের একটা হিম স্রোত বয়ে গেছিল সেদিন রাজেন্দ্রর সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে। চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। তবে মাথা নিচু করেননি টিপুকে দেখে। চোয়াল শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন অন্যদিকে। অনুভব করছিলেন রাগে গনগন করছে টিপুর মুখ। সেদিন তাঁদের অন্যত্র চলে যেতে হবে, এই আদেশ দিয়ে টিপু চলে গেছিলেন। পরের দিন খুব ভোরে এক শকটে যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁদের। সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে তারা পৌঁছেছিলেন আরেক কেল্লায়। পরে জেনেছিলেন এই কেল্লা পেরিয়াপাটনায়। আগের চার বছর তবুও যেখানে ছিলেন রাজেন্দ্ররা, সেখানে একরকম অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। রক্ষী, পাহারা, এসব থাকলেও তেমন কড়াকড়ি কিছু ছিল না। যেহেতু ওঁরা তখন নেহাতই ছোট ছিলেন। কিন্তু এখানে এলেন যখন ওঁরা, গায়েগতরে অনেকটাই বড় হয়ে উঠেছেন তিন ভাই। ফলে এখানে পাহারা জোরদার। পদে পদে রক্ষীর বাধানিষেধ। দমবন্ধ হয়ে উঠছিল ওঁদের। রাজেন্দ্র গোরুর দুর্গে পালাবার যে ছক কষেছিলেন, সেসব জলে গেল একপ্রকার। এই দুর্গে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ নেইই প্রায়। ফলে দুর্গের কোথায় কী আছে ওঁর পক্ষে আঁচ করা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। হতাশায় ছেয়ে গেছিল রাজেন্দ্রর মন। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হত একেক সময়। কিন্তু সেও উপায় ছিল না ওঁদের। ঘুমের সময়েও রক্ষী দাঁড়িয়ে থাকত শোবার ঘরে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইত, বদলে বেরত আগুনের হল্কা। কান্না ভুলে গেছিলেন রাজেন্দ্র। একজন বীরের কখনও কাঁদতে নেই, এ ছিল তাঁর পিতার শিক্ষা।
  এই যে এখন রানী মহাদেবাম্মা ঘুমোচ্ছেন অঘোরে, তাঁর প্রিয় রানী, প্রিয় সঙ্গিনী, যাঁকে বিবাহ করার উদ্দেশ্য ছিল একটি পুত্র সন্তান অর্জনের। অথচ এই রানী তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দিতে পেরেছেন কত সহজে। কী অদ্ভুত এই নারী চরিত্র! অজানা, অচেনা এক নারী ছেয়ে গেছে তাঁর দিনযাপনে, তাঁর বিশ্বাসে। আশায়, ভরসায় যাঁর ওপর নির্ভর না করলে, তিনি এখন উন্মাদ হয়ে যাবেন, এ দিব্যি বুঝতে পারেন তিনি। তবে এও ঠিক, তিনি যে স্বেচ্ছায় পুত্র সন্তান চাইছেন তাও না। বড় রানীর দুই মেয়ে, তাঁরও দুই প্রিয় সন্তান। গোল বাঁধিয়েছে তাঁর নিজেরই দুই ভ্রাতা। যে ভাইদের সঙ্গে ওই বন্দি জীবন কাটিয়েছেন একসঙ্গে, যে ভাইরা ছিল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়, সেই ভাইরাই এখন তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেছে। নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস! কালেদিনে বিষয়, আশয়, সিংহাসন সবাইকে কেমন মনুষ্যত্ব ভুলিয়ে দেয় কী অনায়াসে! ভাইদের দাবী, রাজেন্দ্রর যেহেতু পুত্র সন্তান নেই, তাই রাজেন্দ্রর পরে তাঁদের সিংহাসনের উত্তরাধিকার দিয়ে যেতে হবে। আজ এই কোরাবা পুনরুদ্ধারের তিনিই একমাত্র পথিকৃৎ, কীভাবে কীভাবে পালিয়ে এসেছিলেন ওই পেরিয়াপাটনা থেকে সে শুধু তিনিই জানেন আর জানেন স্বয়ং বিশ্বনাথ। আর সেই সময়ে তাঁরই অধীনে কোরাবারা টিপুকে তাড়িয়ে দিতে পেরেছিল, ফিরে পেয়েছিলেন তিনি মুদ্দুকেরি প্রাসাদ, তাঁর নিজস্ব রাজত্ব। আর তারপর এই বৃটিশদের সঙ্গে মেলামেশা, তাঁদের থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস, সব কিছুই তিনি নিজের উদ্যোগে, নিজের ক্ষমতায় আয়ত্ব করেছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র পুত্র সন্তানের অভাবে তাঁর নিজের হাতে গড়া এই কোরাগু ভাইদের দিয়ে যেতে হবে? এ তিনি কিছুতেই মানবেন না। মহাদেবাম্মার যদি কন্যা সন্তানও হয়, সেই কন্যাকেই তিনি সিংহাসনে বসিয়ে যাবেন। এই তাঁর শপথ। মহাদেবাম্মা তাঁর চোখ খুলে দিয়েছেন। একজন নারীর মনোবল একজন পুরুষের থেকে অনেক বেশি, এ কথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শিখেছেন কেবলমাত্র মহাদেবাম্মাকে দেখে। তাঁদের কন্যাও তাঁদের তেজের অংশ নিয়ে জন্মাবে। সেও কিছু কম যোগ্য হবে না এই কোরাগুর জন্য। এই নালকানাড়ু প্রাসাদেই তিনি মেয়েকে অস্ত্র শিক্ষা দেবেন ঠিক করে রেখেছেন।
   রাজেন্দ্রর আর আজ চোখে ঘুম আসবে না। অন্ধকার জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে। ভাবছিলেন সেই আগেকার কথাই। স্মৃতিচারণ ছাড়া সময় কাটানোর মোক্ষম অস্ত্র কী থাকতে পারে আর! সেই যে রাতে ঘুমোতে চলে গেলেন রানী গল্প শুনে, তারপরে ঘুম চোখ খুলেই একরাশ কৌতূহলে রাজেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাহলে তুমি কীভাবে পালিয়ে এলে ওই কেল্লা থেকে?’ রাজেন্দ্র হেসে সেই সময়ে এড়িয়ে গেলেও, সে রাতে তাঁকে এড়াতে পারেননি। সবিস্তারে বর্ণনা করতে হয়েছিল তাঁকে তাঁরই পালানোর কাহিনি। সেই সময়ে হতাশা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল তাঁর নিজের ভাইরা, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই আজ। তাঁরা তিনজনে মিলে নিজেদের মনের জোর বাড়িয়েছেন একে অপরকে। বড় ভাই হিসেবে তিনি নিজেই ছোট দুভাইয়ের অসহায় মুখ দেখে নিজেকে ক্রমশ শক্ত করেছেন, আর দুই ভাইও তাঁর দুই কাঁধ মজবুত করে গেছিল তখন। যেখান থেকে পালানোর উপায় নেইই বলে মনে হচ্ছিল এক সময়, সেখান থেকেই পালানোর সহজ রাস্তা বেরিয়ে এলো একদিন। ঘুমের ঘোরেই রাজেন্দ্রকে কে যেন উপায় বাতলে দিল। পরে তিনি মাথা ঠাণ্ডা করে ভেবেছিলেন—সেই ব্যক্তি আসলে তাঁদের পিতা। যেহেতু রাজপরিবারের সদস্য তাঁরা, রাজকীয় আদব কায়দা বজায় ছিলই। গায়ে পরার মতো কিছু হিরে, চুনী, পান্না, মুক্তোর গহনাও ছিল তাঁদের সঙ্গে। আর একে একে সেইগুলিকেই উৎকোচ হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁরা। রক্ষীরা তাঁর কেনা গোলাম হয়ে গেছিল টিপুর অনুপস্থিতিতে। একসময়ে শুভ মুহূর্ত এসেই গেল। তখন কোনখানে বৃটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলেন টিপু। ফলে সেই সময়কেই ওঁরা বেছে নিয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে দুজন রক্ষী পথ দেখিয়ে কেল্লার বাইরে নিয়ে এসেছিল রাজেন্দ্রকে। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিল এক অশ্বারোহী। মুখ ঢাকা ছিল রাজেন্দ্রর। ফলে সেই অশ্বারোহীও জানত না তাঁর পরিচয়। তাকে বলা হয়েছিল একজনকে রাতের অন্ধকারে কোরাগু অঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। সে মোহর পেয়েছিল কয়েকটি তার বদলে। কোনরকম অসুবিধের সম্মুখীন হননি সেদিন রাজেন্দ্র। কয়েক ঘন্টার ঝড়ো সফরে ঘোড়ার পিঠে চেপে তিনি পৌঁছে গেছিলেন কোরাগুতে। আর সেখানে তখন গোপন সংবাদ পৌঁছে গেছিল তাঁর আসার। সারা রাত জেগে অপেক্ষায় ছিল সমস্ত কোরাগু। সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন তাঁদের নতুন রাজাকে। আর সেই অশ্বারোহীকে সকলে এত বখশিশ দিয়েছিল যে, সে প্রথমটা হকচকিয়ে গেছিল। পরে যখন রাজেন্দ্রর পরিচয় সে পেল, আভূমি কুর্নিশ জানাল তাঁকে, আর সেও থেকে গেল কোরাগুতে রাজেন্দ্রর অনুচর হয়ে। সেই থেকে আজ অবধি সে এখনও রাজেন্দ্রর সঙ্গ ছাড়েনি।
 ‘বুঝলে রানী! এই হল আমার পালিয়ে আসার গল্প। এরপরে অবশ্য এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল টিপুর সঙ্গে। সে আরেকদিন বলব তোমায়। সেই সব রক্তাত দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠি আমি। টিপুর সঙ্গে মোকাবিলা কী সহজ ছিল!’
  কুপিল্লাও কি পালাবে? এই মেয়েটার মোহ কাটিয়ে পালাতে পারবে? কিন্তু এখন আর সে উপায় নেই তার। এইমাত্র অস্ত্র পুজো করে উঠল ও আসন ছেড়ে। বাইরে তখন হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে।     আর সেই ভিড়ের মধ্যে খিলখিল করে হাস্যরত একটা কালো শরীর থেকে বিদ্যুৎ ঠিকরে বেরচ্ছে। আজ মেয়েটা বেশ সেজেগুজে এসেছে। আরও বেশি করে ভালোলাগায় ছেয়ে গেল কুপিল্লা। আরও বেশি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল ওর মন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। নিজেকে সাহস দিতে থাকল ও। কুপিল্লা, কুপিল্লা…ভয় পাস না। ওই দ্যাখ! মেয়েটাও কেমন ঠোঁট টেপা হাসি নিয়ে তোকে দেখছে। ওর চোখে আহ্বান রয়েছে। বুঝিস না কেন তুই!

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *