বিদ্যা ভাবছিল, কুপিল্লা ছিল ব্রাহ্মণ। মোটের ওপর ফর্সা রঙ, খাড়া নাক, মুখ, চোখের গড়ন ও চেহারায় একটা পুরুষালী ভাব প্রকট ছিল তার। তার ওপর তার বংশ ছিল রাজপুরোহিতের। মান, সম্মান, রূপ বা গুণে, শিক্ষায়, আচার, আচরণে ওরা ছিল বিদ্যাদের থেকে বেশ কয়েক ধাপ উঁচুতে। বিদ্যাদের পরিবারে কেউই প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডী টপকিয়ে খুব বেশি দূর এগোয়নি। একটা পলিশ ছাড়া লুক্ ওদের গায়ে যেন লেগে ছিল বা আছে। সেখানে কুপিল্লার মতো স্বভাব ভীতু একজন পুরুষের বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না সেসময়ে। এমনকি এখনও জাতিভেদ ওদের মধ্যে প্রকট। একই বংশ বা ওক্কা’র মধ্যে বিয়ে হয় না কোরাবাদের। যদিও কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হয়, কিন্তু দুই ভাই বা দুই বোনের ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিয়ে হয় না। ভাই-বোনের ছেলে মেয়ের বিয়ে হতে পারে। সে যাই হোক, বর্তমানে কোরাগুতে ১০০০ ওক্কা বা পরিবার আছে, যাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। প্রত্যেক ওক্কার মাথায় একজন বয়স্ক সদস্য থাকেন। যাঁর কথা সবাই মেনে চলে। তাঁকে ওরা বলে পাত্তেদারা বা কোরাবুকুরা। প্রত্যেক ওক্কার একটি করে আইনমানে ঘর থাকে, যেখানে সবাই মিলে জড়ো হয় উৎসব, অনুষ্ঠানে। প্রত্যকে সদস্য একসঙ্গে চাষবাস করে। যদিও আজকাল যে শহর গড়ে উঠেছে, না জানি কোরাবা ছাড়াও কোথা থেকে বাইরের লোকজন এসে এখানে বসবাস শুরু করেছে! বিদ্যা শুনেছে শহরে নাকি যে যার মতো বাড়ি বা ফ্ল্যাট তৈরি করে নিজের মতো করে থাকে। এভাবে একা একা থাকার কথা বিদ্যারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তাদের নিজেদের একগুচ্ছ বাড়ি, সম্পত্তি ও গ্রাম নিয়ে তৈরি হয় এক একটা উর। এইরকম একগুচ্ছ উর নিয়ে তৈরি হয় নাড়। আবার একগুচ্ছ নার নিয়ে তৈরি হয় সিমে। কোরাবাদের এমন আটটি ঐতিহ্যবাহী সিমে রয়েছে। প্রত্যেক উর, নাড় ও সিমে’র একজন করে মাথা থাকে, যাঁকে ওরা টাক্কা বলে। কোরাবুকুরা বা টাক্কারা বংশানুক্রমিক ভাবে তাদের প্রথা চালিয়ে যায়। এরাই গ্রামের সব সমস্যা, এমনকি কিছু আইনগত জটিলতাও বয়স্কদের সঙ্গে আলোচনা করে মিটিয়ে দেয়। ফলে তাদের সমাজে একটা সুষ্টু নিয়ম শৃঙ্খলা আছে, একসঙ্গে, একজোট হয়ে থাকার প্রবণতা আছে। এই যে বিদ্যা, যে একজন বিধবা হয়েও সমাজে মাথা উঁচু করে থাকে, সেও এই সমাজেরই নিয়ম। মেয়ে বলে আলাদা ভাবে তাদের হ্যাটা করা হয় না। যদিও বিয়ের পর, যে ওক্কায় বিয়ে হয়, সেই নাম তাদের নিতে হয়। বিধবা হলেও বিদ্যাদের বিয়ে করায় কোন বাধা নেই। আকছার বিয়ে হয় এমন। মুরুগানকে বিয়ে করলেও কেউ কিছুই বলত না বিদ্যাকে। কিন্তু কেন যেন আর সংসারে জড়াতে তার ইচ্ছে হয়নি। যদিও সংসার সে করে নিয়মিতই। যে কোন অনুষ্ঠান বা বিয়ে হলে বিদ্যাকে ওরা ডেকে নিয়ে যায়। পুরোহিত থাকলেও প্রধান পুরোহিতের কাজটা, অর্থাৎ মালা বদল বা মঙ্গল উপাচার বিদ্যাকে দিয়েই করানো হয়। ওদের ওক্কায় বিধবাদের জন্য এমনই রীতি। সম্মানও দেয় সকলে ওদের খুব। ফলে তারা এই সমাজে বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দেই থাকে, এমনটি বলা যায়। কিন্তু প্রেম তো এইসব নিয়মকানুন মানে না। তাই কুপিল্লার মতো ব্রাহ্মণ বিদ্যার প্রেমে পড়ে।
কুপিল্লা যদিও সেদিন না এসে পারেনি। এদিকে ভেতরে ভেতরে খুব টেনশন চলছে ওর। এমন এক জায়গায় যদি ওদের কূলের কেউ ওকে দেখে নেয়, তাহলে এই নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যাবে। প্রায়শ্চিত্ত না করতে হয়! এমনি সময়ে এলে কোন কথা উঠত না। কিন্তু এই ভোজের দিনে আসা—কেউ যদি দেখে নেয়……তো হয়েই গেল কুপিল্লার। ওর বাপ সবার আগে পিটিয়ে ছাল তুলে দেবে পিঠের। বাবাকে খুব ভয় পায় ও। এমন এক ব্যক্তিত্ব তাঁর, সকলে মান্য করে, পণ্ডিত হিসেবে সকলে এক ডাকে চেনে ওঁকে। বাবার কথাই শেষ কথা ওর পরিবারে। আজ পর্যন্ত এই তেইশ বছর বয়সে এসেও ও কোনদিন বাবাকে অমান্য করার কথা ভাবতেও পারেনি। শহরের কলেজে পড়াশুনো করেছে, বাবা যাওয়ার আগে বলে দিয়েছিলেন, ও যেন কোন মেয়ের মুখের দিকে না তাকায়। সত্যি বলতে কী, কুপিল্লা তিরিশ সেকেন্ডের বেশি কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস পায়নি সেই থেকে। বুকের ভেতর ভয়ে শুকিয়ে যেত ওর। বাবার মুখটা মনে পড়লে কেঁপে উঠত ভয়ে। বাড়িতে এসে ওকে পুজোপাঠের কাজে যুক্ত হতে হয়েছে। কিছুদিন আগে মায়ের মুখে শুনেছে, ওর বাপ নাকি মেয়ে দেখছে ওর জন্য। এমনকি একটি পালটি ঘরের মেয়েকে ওর বাবা পছন্দ করে এসেছে, এও মায়ের মুখেই শোনা কুপিল্লার। বাবার ওপর তাদের অগাধ আস্থা। বাবা কোন কাজ বা সিদ্ধান্ত স্থির করবেন, আর তা ওদের মনোমত হবে না, এমন কখনও হয়নি। তাই এ বিয়েটাও যে ভালই হবে, সে নিয়ে ওর মায়ের বা ওর মনে কোন দ্বিধা ছিল না। এই গ্রামে ও আজ এসেছে ওই মেয়েটার ডাকে। ওই মেয়েটাকে বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও সে ভাবেনি বা ভাবেও না। কিন্তু কোন এক অজানা আকর্ষণ তাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে। ওই তো আইনমানের ঘর দেখা দেখা যাচ্ছে ওদের। কাছে আসতেই একটা বিজাতীয় গন্ধ কুপিল্লার নাকে এসে ঠেকল। আরও একটু এগোতেই পেঁয়াজ, রসুন, মশলা কষার উৎকট ঝাঁজে ওর গা গুলিয়ে উঠল। এক দলা থুথু উঠে এলো মুখে। থুঃ করে ছুড়ে দিল—যদিও আর কয়েক পা এগোতেই ওই গন্ধের ঝাঁজ সে আর সহ্য করতে পারল না। রাস্তার ধারে ওয়াক ওয়াক শব্দ তুলে বমি করতে থাকল। পেট গুলিয়ে বমি করার কষ্ট ছাপিয়েও ওর মনে পড়ল বিদ্যার কথা। মেয়েটাকে তো দেখা যাচ্ছে না ধারেকাছে! কী কুক্ষণে এলো সে আজ এখানে!
মুখ ধোয়ার জন্য জলের খোঁজ করছিল কুপিল্লা। মাথা তুলে তাকাতেই দেখে সেই মেয়েটা জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে…ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কুপিল্লা। তিরিশ সেকেন্ডের অনেকটা বেশি সময়ে ধরেই। তারপর সম্বিৎ ফিরল মেয়েটার কথায়, ‘মুখটা ধুয়ে নাও গো ঠাকুর!’