এই সময়ের লেখায় ভজন দত্ত – চতুর্থ পর্ব

করোনা – এক পাতি পাব্লিকের ডায়েরি
চতুর্থ পর্ব
আজ, মানে ২৭ মার্চ রাত সাড়ে দশটায় এই লেখা যখন শুরু করছি, তখন ভারতে নতুন করে কোভিড-১৯এ সংক্রমিত হয়েছেন, এরকম মানুষের সংখ্যা ১৪৮ জন (১৫০ রাত ১১-০৫)। ভারতে একদিনে এত মানুষ কিন্তু এর আগে কোরোনাতে আক্রান্ত হয়নি। আমরা কোন পর্বে আছি, দ্বিতীয় না তৃতীয় তা কেউ পরিষ্কার করে বলতে পারছেন না। কোয়ারান্টাইনের লকআউটে কাটছে যখন সব পাতি পাব্লিকের জীবন, তখন তো নেট ঘাঁটতে অসুবিধা নেই। তো,এই নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতেই জানলাম একটি টেলিভিশন সিরিয়ালের কথা। সেটা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার না করে পারলাম না।ঘটনাটা পুরনো।প্রায় এক বছর সাত মাস আগের ঘটনা –
সেপ্টেম্বর,২০১৮ তে কোরিয়ার টিভিতে একটি সিরিয়াল আসে Terrius Behind Me বা My Secret Terrius এই নামে। কোরিয়ার জনপ্রিয় তারকা সো জি-সাব(So Ji-Sub)এই সিরিয়ালটির অন্যতম অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেন এক গুপ্তচরের চরিত্রে ।এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন, জাং ইন-সান( Jung In-Sun),সন হো ইয়ুন( Son Ho-Jun) ও ইম সে- মি) (Im Se-mi)।এই সিরিয়ালের দশ নং এপিসোডের ৫৩মিনিটে একটি ম্যানমেড ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে দেখানো হয়।একজন ডাক্তার রোগের বিবরণ দিতে গিয়ে জানান, পুরনো করোনা ভাইরাসের মারণ ক্ষমতার হারকে বাড়িয়ে কেউ ৯০% করে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন,দুই থেকে ১৪ দিন টিকে থাকা এই ভাইরাসকে কিছু মানুষ বায়োলজিকাল হাতিয়ার হিসাবে রূপান্তরিত করার ফলে এটি সরাসরি মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাতে পারবে পাঁচমিনিটের মধ্যেই। এই সিরিয়ালেই বলা হয়, coronavirus, MERS, SARS and common flu “all fall in the same family with the same gene information” and that coronavirus causes respiratory disease.এই সিরিয়ালের শিশু দর্শকদের দেখানো হয়,সংক্রমণ ঠেকাতে হাত ধোয়ার সঠিক পদ্ধতি কীরকম হবে। সিরিয়ালে ডাক্তার বলেন,“no cure or vaccine [was] available at the moment”.
— বাস্তব ঘটনার সঙ্গে অনেক গোয়েন্দা গল্পের মিল পাওয়া গেছে পরবর্তী কালে। সেখানে অনুপ্রাণিত হওয়ার গল্প থাকলেও থাকতে পারে।সুজয় ঘোষ পরিচালিত ‘কাহানি’ সিনেমার কথা মনে আছে?তাই দেখে কোলকাতা মেট্রোরেলের ভেতর বিষাক্ত গ্যাস ছড়ানোর প্ল্যান কেউ করলে কী করা যাবে! বেঘোরে মানুষ লুটিয়ে পড়বে মৃত্যুর কোলে!
জীবাণু কে যারা অস্ত্র করে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এই সময়ে তাদের জন্য ঘৃণা সঞ্চিত হচ্ছে বিশ্বে।মানবসভ্যতায় গবেষণার প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবেই জীবাণুকে ব্যবহার করা যাবে না,এই দাবি আর কবে জোরদার হবে! বিশ্ব পরিবেশ ধ্বংস করেছে যে সভ্যতা, সেই সভ্যতাকে আজ গৃহের কোণে কোণে বন্দি রেখেছে নভেল করোনা নামের অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাস। বললেই হবে! মানুষ কি আর এমনি এমনিই সভ্য হবে!প্রকৃতিকে ধ্বংস করে করেই তো আমরা সভ্যতার পথ বানিয়েছি। তার মাশুল দিতে হবে না! এই তো ২০১৯এ পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনের জঙ্গল পুড়িয়েছে মানুষ।কত লক্ষ লক্ষ প্রাণি-উদ্ভিদ চিরতরে হারিয়ে গেছে।আর আজ,সামান্য একটা ভাইরাসের ভয়ে পৃথিবীর মানুষ কোণঠাসা। মানুষ কি একবারো ভাববে না, কি দিলাম আমরা প্রকৃতি মাকে?
♠
সারাদেশে লকডাউনের আজ সবে তৃতীয় দিন। বাজার-হাট চলছে। বাজার করছেন কেউ দূরত্ব বজায় রেখে, কেউ না রেখে। জনজীবন বলতে যা বোঝায় তা শুধুই সকালের বাজারে, পেটের তাগিদে মানুষ ভিড় করছেন।সন্ধ্যার রাস্তায় বিষন্ন কুকুররা চুপ করে বসে। তারা যেন এই তিনদিনেই ডাকতে ভুলে গেছে। মোড়ের জটলা চলছে।বস্তিতে আগে থেকে সঞ্চয় করে রাখা দেশি মদের দাম হয়ে গেছে প্রায় ডবল।কিছু মানুষকে নেশার জিনিস তো জোগাড় করতেই হবে! মানুষের হাতে কাজ নেই, এদিকে হাতে জমা টাকাও কমে আসছে।অনেকেই জানেন বা জানেন না সাধারণ অবস্থাতেই গ্রামে বা শহরের বস্তিতে একদল সুদখোর মানুষ থাকে তক্কে তক্কে, তারা তো এই অবস্থার সুযোগ নেবেই।লকডাউনের দিনগুলোতে দিন আনি দিন খাই মানুষের অবস্থা আরো খারাপ হবে একদিকে, অন্যদিকে তারাই আবার আরো আরো ভালো ভোট ব্যাঙ্ক হয়ে যাবে অচিরেই।
দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য অনলাইনে ব্যবস্থার দাবি এখনো সেরকম একটা শোনা যাচ্ছে না। প্রাণ থাকলে তবে তো পড়াশোনা! কিন্তু বিশ্বের অন্যত্র অনলাইন পড়াশোনা চলছে। এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের রেজিষ্ট্রেশন, রেজাল্ট থেকে শুরু করে অনেককিছুই অনলাইন হয়ে গেছে।কিন্তু শিক্ষা দানের জন্য এবার থেকে অনলাইনের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিশ্চয় হবে।
আশার কথা, গ্রামগুলো থেকে এখনো তেমন খারাপ খবর আসছে না, এটা হয়তো ভালো লক্ষণ। অসুস্থরা চিকিৎসায় সুস্থ হচ্ছেন।কেরালা,মহারাষ্ট্রে সংক্রমণ বাড়ছে। সারাদেশ জুড়েই বাড়ছে সংক্রমণের সংখ্যা। আমরা প্রায় চার অঙ্কে প্রবেশ করার দরজায় দাঁড়িয়ে।নেট দুনিয়ায় শোনা যাচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি এই জীবাণু দুর্বল হবে কিন্তু এই covid19 ভাইরাস এত দ্রুত নিজেকে রূপান্তর করছে যে, সে কীভাবে কোনদিক থেকে আঘাত করবে তা নিয়ে আশার কথা কই শোনা যাচ্ছে?আজকের সংবাদে তেহট্টে নতুন করে যে পাঁচজন এক বিয়ে বাড়িতে সংক্রমিত হলেন, তা কি আমাদের রাজ্যে তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করার সংবাদ! ১৬ মার্চ ইংল্যান্ড ফেরত তেহট্টের বাসিন্দা কোয়ারান্টাইন ভেঙে এই যে সংক্রমণ ঘটালেন তার বিরুদ্ধে কি এফ আই আর হবে না?আগেই কি কোনো এফ আই আর হয়েছে? হাতে গোণা কয়েকটি দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের জন্য বাঁশ ১৩৫ কোটির! আশঙ্কা সবদিক থেকেই। ভারত কি পারবে তৃতীয় স্তরের লড়াইটা লড়তে? আমরা তো এতদিন মন্দির মসজিদের জন্য লড়াই করেছি, আমরা স্বাস্থ্যের দাবিতে লড়াই করিনি। এখানে যে স্বাস্থ্যকর্মী বাহিনী চিকিৎসা করছেন তাদের এখনো পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট সরবরাহ করা যায়নি।
এদিকে করোনা যে ভয়ংকর অর্থনৈতিক বিপদ নিয়ে আসছে আগামীদিনে সেটা পরিষ্কার। জানি না সরকার তা মোকাবিলা করার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন? গতকালের প্যাকেজের পর কেন্দ্র সরকারের অনুরোধে ব্যাঙ্ক ঋণের ইনস্টলমেন্টের ক্ষেত্রে তিনমাসের কিস্তি না দিলেও হবে বলে আজ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে।
সরকার সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।গতকাল অন-ক্যামেরা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত সকলের কাছে সাহায্যের আবেদনও জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, সরকার দান-খয়রাতের সময় কেন দুঃসময়ের কথা চিন্তা করবেন না! সরকার তো তখন আমজনতার ভোটে নির্বাচিত হয়ে গেলে রাজাধিরাজের মত আচরণ করে!বিপদের দিনে যাদের কাছে তাদের সাহায্যের অাবেদন জানাতে হয়,সুখের দিনে তাদের কথা কতটা ভাবা হয়! দানখয়রাত করার অনুমোদন কী তাদের কাছ থেকে নেওয়া উচিৎ নয়!সাহায্য নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলার মাঝেও একটা কথা কি বলা যায় না, স্বাধীনতার এতবছর পরেও কেন সরকারকে ঐ তথাকথিত দুর্বল, অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যই ভাবতে হয়! রাজনৈতিক সাম্যের অবস্থায় তাদের ভোটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যই কী তাদের আমরা পিছিয়ে রেখেছি!নির্বাচনে জেতার জন্য চিরদিন এরাই তো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।তো,এটা খুবই স্বাভাবিক যে, সরকারের লক্ষ্য তাদের জন্য যতটা সম্ভব করো।তার মানে কিন্তু এই নয় যে, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত করে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেওয়া বা, তাদের জীবনকে সত্যিকারের ফ্যামিলি কোয়ারান্টাইনের উপযুক্ত করে তোলা।তাদের সবসময় বলা হবে, শোনানো হবে, ‘তোদের জন্য এত করলাম, তত করলাম, নাহলে কী হতো বল!’….
কেউ কি বলতে পারবেন, আগামী কোনো নির্বাচনে ‘করোনা’কে কোনো দল ইস্যু করবে না? করলে, পাতি পাব্লিক কী একবারও ভাববে না, কেন হবে? একটা জাতীয় বিপর্যয় নিয়ে যদি রাজনীতি করা হয়, তা কি আপনি আপনারা সমর্থন করবেন!
(চলবে)
(তাং ২৭ /০৩ / ২০২০ ২০২০, রাত ১১-৩০)