এই সময়ের লেখায় ভজন দত্ত – দ্বিতীয় পর্ব

করোনা – এক পাতি পাব্লিকের ডায়েরি
দ্বিতীয় পর্ব
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার পর সারারাত নানান চিন্তায় ঘুম নেই পাতি পাব্লিকের। নোটবন্দির সময়েও এমন চিন্তা আসেনি। উফ”তারপর কী দুঃসহ দিন গেছে! সেসব মনে রাখে নি কেউ। পাব্লিক কিছুই মনে রাখে না। খারাপ দিনের কথা আচ্ছে দিনে মনে করতে নেই। কিন্তু এবার যে খুব চিন্তা হচ্ছে! প্রথম চিন্তা, কাল কী হবে!অতদিন সংসার চালানোর রসদ তো নেই!রেশনের চাল কিছু আছে আটা নেই, আটা হবে আজ আর কাল, সরষের তেল নেই। শাকসব্জিও তো তেমন কিছু কেনা হয়নি এদিকে আবার জনগণ বলছে ভালো ভালো খেতে হবে। মুরগি কেনা হয়নি কতদিন!বাজারের গুজব,ওটা খেলেও পঞ্চত্বপ্রাপ্তের সুযোগ। গোটা গোটা মুরগি বিকিয়েছে পঁচিশ, তিরিশ টাকায়, কেনা হয়নি। গতকাল দাম জিজ্ঞেস করলাম বললো, দাদা,কাটা ‘একশোতিশ’ চলছে।পরে ফ্রিতে জ্ঞানটাও দিলো, ‘আপনারা তো আবার সস্তার কিছু খান না!’ দ্বিতীয়ত, মাসকাবারি ঔষধটাও কিনে নিতে হবে। আবার গত ১৮মার্চ ছেলেকে বিড়ালে আঁচড়ে আদর করে দিয়ে গেছে।তার জন্য তাকে নিয়ে গিয়ে ইনজেকশন দেওয়াতে হবে ০,৩,৭… তারপরেরটা যেন কত! তা আর মাঝরাতে মনে পড়লো না। এদিকে আবার তেমনই ওয়েদার ফ্যান চালালে ঠাণ্ডা লাগে, না চালালে গরম লাগে। মাঝামাঝি চালালে হতো কিন্তু ইলেকট্রনিক রেগুলেটর ফিবছর কত আর বদলাবো বলে বদলানো হয়ে ওঠে নি!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে পাতি পাব্লিকরা ঘুমোয় সরকার তা কোনোদিনই জানার চেষ্টা করেন না!
প্রধানমন্ত্রী তো বললেন, আপনারা এটা একরকম কার্ফুই ভাবুন। তিনি তো বলার অধিকারী!ভালোই বলেছেন! কিন্তু এই একুশদিন কীভাবে চলবে!খাবোটা কী! ঘরে বসে বসে তো আর এখানে খাবার আসে না।উন্নত দেশগুলিতে হোম কোয়ারান্টাইন যেরকম সম্ভব, এখানে কী সেরকম ভাবে সম্ভব! সকলের জীবনই দামি কিন্তু পাতি পাব্লিক কমিউনিটি টয়লেট ইউজ করলেও তারা এই জীবাণু এনে এখানে ছেড়ে দ্যায়নি। যারা রোজ ভিড় ট্রেন বাসে অটোয় টেটোয় মেট্রোয় গাদাগাদি করে যাতায়াত করলেও তারা কেউ এই রোগ ছড়ায়নি। তারা হেগে সকলেই ছোঁচায়।কেউ ন্যাপকিন ব্যবহার করেনি জীবনে, তবুও কী আশ্চর্য তাদের হাত ধোয়ার নিরন্তর বিজ্ঞাপন দেখতে হয়। ফোনে খকখক কাশির আওয়াজে ভয় হয় শুধু। আর ভয় না করলে চলবে কীভাবে! যে জীবনটা চলে যাবে তার ভয়ে নয়, আসলে পাতি পাব্লিকরা মা-বাবা দাদু ঠাকুমার সঙ্গে থাকে, ভয় তো তাদের নিয়ে।
আর সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু জ্ঞান, ‘ওরে যাস না ঘরের বাহিরে’.. কেউ লাইভে, কেউ অডিওতে, কেউ ভিডিও করে বলছেন।বলছেন,মানুষের ভালোর জন্যই। মানুষের ভালোর জন্যই তারা বলছেন, প্লিজ প্লিজ, আপনারা বেরোবেন না।পোস্ট হচ্ছে, ওখানে আড্ডা চলছে, ওখানে ফিস্টি চলছে, ওখানে খেলা চলছে।
শিল্পহীন,কর্মহীন এই রাজ্যের মানুষরা পেট কি সাওয়াল রাজ্যের বাইরে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়। সেই মানুষগুলো কাজ হারিয়ে আবার গ্রামে ফিরে আসছে, তাদের কারো কারো গায়ে জ্বর, ডাক্তার বাবুরা বলেছেন হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে। আচ্ছা, এতদিন পর গাঁয়ের ছেলে ঘরে ফিরে এসে তার কি আর ঘরে মন বসে! তিনি ঘুরছেন জ্বর গায়ে নিয়েই । এদিকে আবার গ্রামে ঢোকার মুখে চেকপোস্ট করছে একদল উদ্যমী মানুষ। আবার গাঁয়ের হাটদিনে উপচে পড়া ভিড়ের ছবিও উঠে আসে নিউজফিডে। উঠে আসে সাধারণের স্বার্থে পুলিশের ডাণ্ডাবাজির ছবি।পাব্লিক পেটানোর,শাসন করার ভিডিও পোস্ট করেছেন অনেকেই। সেগুলোকে সমর্থন করেছেন সব মানী গুণী মানুষজন। পুলিশই এখন তবে হাতেগরম সাজা দিতে পারছেন। আবার সল্টলেকের সেই মেয়েটির কথা ভাবুন, যে পুলিশকে জড়িয়ে ধরে তার উর্দিতে রক্ত লাগিয়ে দ্যায়!
কিন্তু পাতি পাব্লিক ভয় পায়। ভাবে ওরা,মানে পুলিশ তো কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই কেলাচ্ছে! ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় একজন কয়লাখনি শ্রমিক বাড়ি থেকে আসতে গিয়ে পুলিশের লাঠি খেয়েছে। ওরা বলছেন, পুলিশ এরকম মারলে আমরা আর কাজ করবো না।তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।আর বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হলে হাসপাতাল থেকে শুরু করে সব অন্ধকার। আমপাব্লিকের জীবনের মতো অবস্থা। শাঁখের করাতের জীবন। সরকারি দল ধরলে ‘ধান্দাবাজ’ বিরোধী দলের হয়ে বললে ‘শালা বিপ্লবী’ ! সকালে বের হলে পুলিশের মার না বেরোলো সংসারের মার। পেট ঘাটে এসব ভাবলে।পাতি থেকে আম পাব্লিকের বদহজমের রোগ কোনোদিন সারে না। কীকরে সারবে!
#
পাতি পাব্লিকের ঘর থেকে বেরোবার মন না থাকলেও তাকে যে বেরোতেই হবে।২৫/০৩/২০২০র সকাল। এখনো নটা বাজেনি এখনো। চড়চড়িয়ে রোদ উঠেছে তার সাথে বেশ একটা ঠাণ্ডা বাতাসও আছে। এই তো বসন্ত! পাতি পাব্লিক সব,তার আবার বসন্ত! কার্ফু কেমন তা না জানলেও শুনেছে অনেকেই। ভিডিওতে দেখেছে পুলিশ কেমন বিনা বাক্যব্যয়ে সপাং করে…!আঘাতটা এসে লাগলো বুকে। চা-টা কোনোরকমে গিলে, প্রাতঃকৃত্য সেরে বাজারমুখী হলো। সব মশলাপাতির দোকানে লম্বা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কাতারে কাতারে মানুষ।থলি হাতে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে। দোকান খুললে জানা গেল আটা নেই। ডাল নেই।কোনো রকমের তেল নেই। সব্জির বাজারে মাছ নেই। আলু যথারীতি উর্ধ্বে অবস্থান করছে। ভিড় ঠেলতে ঠেলতে মনে হলো এই বুঝি সোশ্যাল ডিসটেন্স! কোনোরকমে কিছু জিনিস কিনে সে যখন ঔষধের দোকানের সামনে এলো সেখানেও ছোট্ট দোকানের সামনে এক মিটার দূরত্বে বাঁশ বাঁধা। তার এদিকে গাদাগাদি করে মানুষ দাঁড়িয়ে, কারো কারো মুখে মাস্ক,রুমাল, গামছা, আঁচল যে যা পেরেছে তাই দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে সব মানুষ রাতারাতি কেমন যেন অচেনা হয়ে গিয়েছে!সেখানে খানিক দাঁড়িয়ে ভাবে, এখানে তার ছেলেকে এনে কীকরে ইঞ্জেকশন দেওয়াবে! অথচ দেওয়াতে তো হবেই!
এই বুঝি হোম কোয়ারান্টাইন, এই বুঝি সোশ্যাল ডিস্টেন্স! কে কাকে বাঁচাবে এখানে! সবাই বাঁচতে চায় অথচ বাঁচার উপায় কই! সবাই তো বলছেন, ঘরে থাকুন,ঘরে থাকুন, ঘরেই থাকুন। পাতি পাব্লিক কী চায় শখ করো এই রাস্তায় এসে দাঁড়াতে, তার কি পরিবার সংসার নেই! তবুও উপায় নেই। ভয়ে বাড়ি ফিরে সব জামাকাপড় ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে বলে,
– ও বউ খেতে দাও গো বড্ড খিদে… !
তাই শুনে খোকা বলে- বাবা মা তো গেছে বাবুর বাড়ি কাজে ।
পাতি পাব্লিক- হ্যাঁ,সে কি! বলে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ে।
ওদিকে আবার হোয়াটসঅ্যাপে-অ্যাপে মেসেজ,কে জানে, কোনটা যে সত্যি আর কোনটা যে ভূয়া! এরকম ম্যাসেজ কারা যে বানায়, কে জানে! আর তেমনি হয়েছেন একদল মানুষ যারা একটা কিছু মাল(বিষয়) পেলেই একশোজনকে ডেলিভারি না করে তাদের শান্তি নেই। সেরকমই একটি ম্যাসেজ,
” আরে শুনলাম যে,কোনোদেশেই ৫৫ বছরের বেশি বয়স হলে তাদের আর রোগী হিসেবে ধরছে না! তাদের চিকিৎসার বাইরে রাখা হচ্ছে, চিকিৎসা করলেই লোক জানাজানি হয়ে যাবে। তাই এই বয়সীদের খুবই চিন্তার ব্যাপার।” নিন।বুঝুন ঠ্যালা!
পাতি পাব্লিক কি জানে,তার বয়স কত!সহস্র সহস্র বছর ধরে তারা পাতি থেকে আরো পাতিতে চলে গেছে। সে জানে,একদিন শুধু মরে যেতে হবে,কর্ম করে যেতে হবে। ফলের আশা কি ওরা করে!নিজেদের সংসার, মা-বাবা, দাদু-ঠাকুমাকে বাঁচাতে ওরা কাজ করে।বৃদ্ধাশ্রম এখনো ওদের মানে বইয়ে নেই।
পাতি পাব্লিক ঘরের দাওয়ায় বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ভাবে, বউটা আসুক, বলবে মাড়ভাত,নুন,লঙ্কাপোড়া – তেল দিয়ে মেখে দিতে।
ওরা বের না হলে যদি এই সমাজ বাঁচে তো বাঁচুক না!তার পরিবারের কিছু হলে কোন মন্ত্রী আসবে বাঁচাতে? লোকাল লিডাররা তো এখন ঘরে ঘরে দরবার করে, কারো দরজায় ভোট না এলে দাঁড়ায় না!
পাতি পাব্লিক কী পারবে বাঁচতে! পারবে, ওর বউকে কদিন কাজের থেকে সরিয়ে রাখতে! রোজগারের জমায় যে কটাদিন চলবে কে জানে! রিকশা, টোটো,অটো, নির্মান কাজ, কলকারখানার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য গণতান্ত্রিক দেশের সরকার শেষ পর্যন্ত কী ব্যবস্থা করে দেখা যাক।আজকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় আশার বুক বাঁধে, যাক কটা দিন তবে রাষ্ট্রের দয়ায় কেটে যাবে।
(চলবে)
(তাং ২৫/০৩/২০২০, সময় রাত ০৯-৪৪ মিনিট)