• Uncategorized
  • 0

উইলিয়াম কেরি : প্রয়াণলেখ – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

উইলিয়াম কেরি (১৭৬১ - ১৮৩৪)
ছিলেন জোলা, হলেন মুচি। মুচি হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন না। মানুষটি একটি গোটা উপমহাদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির সূচনা করে দিয়ে গেলেন। তিনি উইলিয়াম কেরি ( ১৭ আগস্ট ১৭৬১ – ০৯ জুন ১৮৩৪)। কী করেন নি মানুষটি? বাংলাভাষায় অধ‍্যাপনা করেছেন। বাংলা সহ আরো আঠাশটি ভাষা ও উপভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছেন। মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে অজস্র পুঁথি মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করেছেন। বাংলা সংস্কৃত ও মরাঠি ভাষায় অভিধান রচনা করেছেন। মরাঠি ভাষার ব‍্যাকরণ লিখেছেন। ভুটিয়া ভাষার ব‍্যাকরণ সম্পাদনা করেছেন বন্ধুর সাথে মিলে মিশে। জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল স্তরের শিশুদের শিক্ষার ব‍্যবস্থা করেছেন। রামায়ণ মহাকাব‍্য ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কথোপকথন নামে বাংলা কথ‍্যভাষার পুস্তক লিখেছেন। দুটি উদ্ভিদবিদ‍্যার পুস্তক সম্পাদনা ও প্রকাশনা করেছেন। কলকাতার আলিপুরে হর্টিকালচারাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাওড়ার শিবপুরে বটানিকাল গার্ডেনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। শ্রীরামপুর শহরে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে উন্নীত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এশিয়া মহাদেশের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
সত‍্যি সত‍্যিই গরিব জোলা ছিলেন তাঁর বাবা এডমণ্ড কেরি, ও মা এলিজাবেথ কেরি। হদ্দ গাঁয়ের জোলা। জোলাদের জাতব‍্যবসা তাঁতের কাপড় তৈরি করে বিক্রি।
ব্রিটেনের নর্থহ‍্যাম্পটনশায়ারের পলারসপুরি গ্রামের অজ গাঁ পুরি এণ্ড। পাঁচ পাঁচটি বাচ্চা নিয়ে গেঁয়ো জোলা এডমণ্ড আর এলিজাবেথ এর নড়বড়ে সংসার। বড়টি উইলিয়াম কেরি। পড়াশুনা করতে ইচ্ছা খুব। কিন্তু অজ গাঁ পুরি এণ্ড এ কোথায় স্কুল আর কোথায় মাস্টার। উইলিয়াম এর বয়স যখন ছয়, তার বাবা এডমণ্ডের কাজ জুটল স্থানীয় চার্চের কেরানীপদে। ওই সাথে বাড়তি জুটল গাঁয়ের পাঠশালায় পড়ানোর কাজ। ব্রিটেনে অবশ‍্য জোলাদের ঘরের লোকের কাছে পড়ব না, এমনটা বলার বদভ্যাস ছিল না।
গরিবানার জ্বালার মধ‍্যে লেখাপড়া করতে কি যে কষ্ট, তা জানতেন বলেই শ্রীরামপুর শহরে গরিবের ছেলেদের পড়বার শিক্ষাসত্র তৈরি করেছেন উইলিয়াম কেরি। চৌদ্দ বছর বয়স যখন, উইলিয়াম কেরির বাবা এডমণ্ড তাঁর বড় ছেলেটাকে পাঠালেন নিজের মালিক ক্লার্ক নিকোলস্ এর কাছে। কাজ শিখতে।
 কিন্তু উইলিয়াম কেরির পড়াশোনার প্রতি গভীর টান। ছোট বয়সেই একে ওকে ধরে লাতিন আর গ্রিকভাষা শিখে নিলেন।
পরে হয়ে উঠবেন বহুভাষাবিদ। ইংরেজি তো মাতৃভাষা ছিল‌ই। এর সাথে শিখেছেন ফরাসি, হিব্রু, ইতালিয়ান, ডাচ। ভারতে এসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কাছে সংস্কৃত। পরে মরাঠি, অসমিয়া, ওড়িয়া, হিন্দি, ভুটিয়া।
বিজ্ঞানচর্চায় কেরির আগ্রহ ছিল বালক বয়স থেকেই। বিশেষত‌ঃ উদ্ভিদবিদ‍্যা। ১৮২০ তে ষাট বৎসর বয়সী প্রৌঢ় উইলিয়াম কেরি কলকাতার আলিপুরে এগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী উইলিয়াম রক্সবারো ছিলেন কলকাতার লাগোয়া হাওড়া শিবপুরের বটানিকাল গার্ডেনের দায়িত্বে। তিনি ছুটিতে গেলে কেরির উপর দায়িত্ব পড়েছিল ওই সংস্থা সামলে দেবার। তিনি তা করেছেন। ওই রক্সবারো সাহেব উদ্ভিদবিদ‍্যা নিয়ে ব‌ই লিখলে নিজেদের মুদ্রণালয় থেকে ১৮১৪ সালে প্রকাশ করেন হরটাস বেঙ্গালেনসিস আর মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে ১৮৩২ সালে ফ্লোরা ইণ্ডিকা।
কথায় বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। কেরি যেন ঠিক তাই করে দেখিয়েছেন। ছিলেন চর্মকার, হলেন পুঁথি মুদ্রক, বাংলা ব‍্যাকরণবিদ, অনুবাদক, অধ‍্যাপক।
 ১৭৭৯ সালে বছর আঠারোর উইলিয়াম কেরি স্থানীয় মুচি টমাস ওল্ডের কাছে গেলেন। জুতো সেলাই করার শিক্ষানবিশি করতে। ওল্ডের শ‍্যালিকা ছিলেন ডরোথি। একেবারেই গেঁয়ো মেয়েটি। লেখাপড়ার নামগন্ধ টুকুও ছিল না ডরোথির। তবু তার সাথেই কি করে জড়িয়ে গেলেন কেরি। ১৭৮১ সালে কুড়ি বছরের তরুণ কেরি পাণিগ্রহণ করলেন চর্মকার পরিবারের ডরোথিকে। টমাস ওল্ডের বয়স হয়েছিল। ডরোথির বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চোখ বুজলেন। টমাসের জুতোর কারবার পুরোপুরি দেখভাল করার দায় এসে পড়ল কেরির ঘাড়ে। জুতো বানাতে বানাতেই তরুণ কেরি পড়াশোনা করেছেন। নিজে নিজে ঘষে ঘষে শিখেছেন হিব্রু, ইটালিয়ান, ডাচ আর ফরাসি ভাষা।
১৭৮৩ সালে কেরির জীবনের একটা মোড় ঘুরল। অক্টোবরের পাঁচ তারিখে তিনি ব‍্যাপটাইজড হলেন। এর পর ১৭৮৫ সালে মৌলটন নামে এক গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার কাজ জুটল। ১৭৮৯ সালে লিসেস্টারের হারভে ল‍্যাণ্ড ব‍্যাপটিস্ট চার্চে পূর্ণ সময়ের জন্য প‍্যাসটর পদে কাজ পেলেন।
খ্রীস্টীয় ধর্মমত ও দৃষ্টিভঙ্গি সারা পৃথিবীতে পৌঁছে দেওয়া, ও আলোকচর্চায় উজ্জীবিত করার দায় অনুভব করেন কেরি। অন‍্য ধর্মের লোকের ধর্মমত পরিবর্তন করিয়ে তাকে আলোকিত করার লক্ষ্যে প্রকৃত খ্রীস্টানদের দায়িত্ব কি, সে সম্পর্কে একটা পুস্তিকা লিখে ফেললেন।
এরপর‌ই সপরিবারে কলকাতা পাড়ি। সালটা ১৭৯৩। কেরি এলেন কলকাতায়। কেরি চাইছেন শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চাকে অবলম্বন করে প্রাচ‌্যদেশীয় অশিক্ষিতদের আলোকিত করতে। অথচ ইংরেজ শাসক তা চাইছে না। কেরি চাইছেন সাধারণ ভারতীয়দের খ্রীস্টীয় ধর্মমতে দীক্ষিত করতে। ইংরেজ শাসক তা চাইছে না। শাসক চাইছে স্থিতাবস্থা বজায় থাকুক। কেরি চাইছেন শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চা প্রসারের পথে খ্রীস্টীয় রুচির প্রসার হোক।
কেরি এমনকি কলকাতার খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের কোনো সমর্থন পেলেন না। ১৭৯৪ সালে পারিবারিক আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে মেদিনীপুরের এক নীলকুঠিতে ম‍্যানেজার হিসেবে কাজে যোগদান করলেন।
এই সময় তিনি খ্রীস্টধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে বাইবেল অনুবাদ করেছেন। এখানে আমাশয় রোগের শিকার হয়ে পিটার নামে কেরির এক সন্তান বিয়োগ হয়। সেই আঘাতে কেরির স্ত্রী চিরতরে মানসিক ভারসাম্য হারান।
মেদিনীপুরে কেরি পেয়েছিলেন জোশুয়া মার্শম‍্যান নামে এক বিদ্যালয় শিক্ষককে আর উইলিয়াম ওয়ার্ড নামে এক মুদ্রণ শিল্পীকে।
ব্রিটিশ সরকারের ক্রমাগত বিরূপতা ও বিরোধিতা এড়াতে সদলবলে কেরি সাহেব ১৭৯৯ সালে পাড়ি দিলেন শ্রীরামপুর শহরে। ওটি ছিল ডেনমার্কের দখলে। ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিক এর সম্মানে শ্রীরামপুর শহরের নাম ছিল ফ্রেডরিক নগর।  ওখানে ইংরেজ শাসকদের বিরোধিতা তত প্রভাব ফেলতে পারবে না। মার্শম‍্যান আর ওয়ার্ডের সহযোগিতা নিয়ে ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারিতে কেরি শ্রীরামপুর শহরে একটি পুরোনো সেকেন্ডহ‍্যাণ্ড ছাপাখানা কিনলেন। সেখানেই শুরু হয় ভারতীয় প্রাচীন পুঁথি ছাপা। বাংলা মুদ্রণের ইতিহাসে একটা যুগ সূচনা করে এই শ্রীরামপুর মিশন ছাপাখানা।
ওই ১৮০০ সালেই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনা করেন ব্রিটিশ সরকার। তারিখটা ছিল ১০ জুলাই। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষাশিক্ষায় তালিম দিয়ে প্রশাসনিক কাজে দক্ষ করে তোলা। লর্ড ওয়েলেসলি ছিলেন গভর্নর জেনারেল। তিনি বাংলা শিক্ষা প্রসার নিয়ে কেরির উদ‍্যম ও আগ্রহের খবরাখবর রাখতেন। তাঁর আমন্ত্রণে কেরি ওই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার অধ‍্যাপকের আসনে যোগ দেন। এরপর ত্রিশ বছর ধরে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ‍্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। সংস্কৃত ও মরাঠিও পড়াতেন। ১৮০৫ সালে মরাঠি ব‍্যাকরণ প্রকাশ করেন।
 ইতিমধ্যে  ২০ জানুয়ারি, ১৮১৭ তারিখে মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়, ঘড়ি ব‍্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার, রাজা রাধাকান্ত দেব, রাণী রাসমণি প্রমুখের উদ‍্যোগে হিন্দু কলেজের সূচনা হয়। ১৮৫৫ সালের পরে এই প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসাবে পরিচিত হয়। বর্ধমান মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ও গোপীমোহন ঠাকুরকে গভর্নর করে গরাণহাটার গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে এই কলেজের সূচনা।
এই হিন্দু কলেজ সাধারণ মানুষের জন্য ভারতের প্রথম কলেজ। ১৮১৮ সালে কেরি ও বন্ধুদের উদ‍্যোগে শ্রীরামপুর কলেজের প্রতিষ্ঠা। এটি দ্বিতীয় কলেজ। এখানে জাতি ধর্ম বর্ণ  লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষার ব‍্যবস্থা হয়েছিল। ১৮২৬ এর আগস্টে জোশুয়া মার্শম‍্যান ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেডরিক এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাজানুগ্রহে ১৮২৭ থেকে এটি সনদপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি লাভ করে। সেই সূত্রে শ্রীরামপুর বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮২০তে কেরি কলকাতার আলিপুরে ভারতের এগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটি স্থাপন করেন।
আজ প্রয়াণ দিবসে পরম শ্রদ্ধাশীল হৃদয়ে উইলিয়াম কেরিকে স্মরণ করি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।