• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় স্বর্ভানু সান্যাল

শিরোধার্য দাড়ি

এই যে বড়দা, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, এই একটু উজ্জয়িনীর রাস্তাটা বাতলে দিতে পারেন?
আমিও সেই দিকেই যাচ্ছি। জুড়ে পড় ইচ্ছে হলে। গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। তা তুমি বাপু কিসের খোঁজে? ভোজ খেতে চলেছ নিশ্চয়ই? পাত পেড়ে খুব করে মন্ডা মিঠাই খেতে চাও? ওই ধান্দাতেই আজ সবাই ও মুখো।
আজ্ঞে না না। আমার বাপের জমিদারি আছে। খাওয়া পরার চিন্তা নেই। আমি যাচ্ছি গান শুনতে। শুনলাম মহাকবি কালিদাস নতুন বই লিখেছেন, কুমারসম্ভব নামে। তো সেই বই তিনদিন তিন রাত ধরে কবি নিজে গান গেয়ে শোনাবেন আর ঠিকঠাক রাজ কর্মচারির হাত ভেজাতে পারলে কবির ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারও পাওয়া যাবে। তা ভাবলাম যাই একটা অটোগ্রাফ নিয়ে আসি আর যদি কোনভাবে কবির সাথে যদি একটা সেল্ফি ম্যানেজ করতে পারি। আপনিও কি উজ্জয়িনী যাচ্ছেন?
হ্যাঁ আমিও সে উদ্দেশেই। কিন্তু উদ্দেশ্য এক নয়। ছোঁড়াটা নতুন লেখাটা কেমন লিখলে সেটা একটু নিজের কানেই শুনে বিচার করব বলে যাচ্ছি। তা তোমার কি করা হয়?
দাদা, ঐ যে বললাম বাপের জমিদারি। তাই করতে কিছুই হয় না। তাই লিখি। আমি কিঞ্চিত লেখক।
বটে? তুমিও লেখ। আজকাল দেখছি এঁদিপেঁদি গেঁড়ি গুগলি সবাই লিখছে। যাকগে যাক। তা এ ছোঁড়ার লেখা পড়েছ?
পড়েছি। মেঘদুতম আমার ভীষণ প্রিয়। রসোত্তীর্ণ লেখা। যেমন ভাষার বাঁধুনি, তেমনি মন্দাক্রান্তা ছন্দ, তেমনি ভাব। “কাঙ্খিতকান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্ত…”
ওই লেখাটার জন্য আমি ওকে অবিশ্যি দশে সাত দিতে পারি। এরোটিক রোমান্টিসম বিষয়টাকে ভালই এক্সপ্লোর করেছে। কিন্তু ছোঁড়াটা বড্ড বেশি লিখেছে। একজন লেখক জীবনে একটা কি বড় জোর দুটো লিখবে। ভাল লিখবে যাতে হাজার বছর টেঁকে সে লেখা। এত গাদা গাদা লেখার দরকার কি? বিশেষত অনুপ্রেরণাহীন অর্ডারি লেখা লিখেছ তো ব্যাস। মাথা থেকে বেরুবে খড় বিচুলি। যতই চিবাও কোন রস নেই। যেমন তোমার এই “মহাকবি কালিদাসের” লেখা রঘুবংশম। রদ্দি মাল। আসলে দরকার হল অনুপ্রেরণা, ইনস্পিরেশান।
বাহ দারুন বলেছেন তো বড়দা। আপনিও লেখক নাকি? এত সুন্দর কথা বলেন?
আমায় চেনো নি বুঝি? অবিশ্যি তখনকার দিনে ঘটা করে বই-এর সাথে বই-এর লেখক এর ছবি ছাপত না। আর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, রীডিং সেশান এসবও ছিল না। তাই, না চেনাই স্বাভাবিক। আমি একটা বিশাল মহাকাব্য লিখেছি। বহু বছর ধরে সেটা বেস্ট সেলার।

উরিব্বাস। অমন একটা লেখার ইনস্পিরেশানটা কি ছিল দাদা?

আমার ব্যাপারটা খুব নাটকীয়, ড্রামাটিক। আমি টীন-এজ বয়সে বিশাল বড় “পাড়ার দাদা” ছিলাম। গ্যাং লিডার। এলাকায় তোলা তুলতাম, চুরি ছিনতাই করতাম। তখন আমার নাম রত্নাকর। সে নামে সবাই থরহরি কম্পমান। তারপর কি করে একটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মনটা নরম হয়ে গেলো। ওসব বাজে কাজ ছেড়ে দিলাম। নামটাও এফিডেভিট করে বদলে বাল্মিকী হলাম। গানটান করতাম। একদিন স্নান করতে গেছি। দেখি কি? একটা ক্রৌঞ্চ মানে সারস আর কি। জলে নেমে একটা সারসীর সাথে একটু ইয়ে ইয়ে করছিল। মানে ফোরপ্লে আর কি, বুঝলে না? হঠাৎ এক ব্যাটা আকাট মুখ্যু ব্যাধ তীর মেরে মদ্দা পাখিটাকে মেরে দিল। বললে বিশ্বাস করবে না, তার মেয়ে বন্ধুটিও বয় ফ্রেন্ড-এর শোকে খুব কান্নাকাটি করতে করতে আত্মহত্যা করল। আমি স্নান করতে নেমে নিজের চোখে সে দৃশ্য দেখলাম। সেই করুণ দৃশ্য দেখে চোখে জল এসে গেল। কিভাবে নিজের অজান্তেই রচনা করে ফেললাম একটা শ্লোক…”মা নিষাদ প্রতিষ্ঠা…” ঐটাই আমার লেখা রামায়নের প্রথম শ্লোক। আমি আদি কবি বাল্মিকী। দাঁড়াও তোমার জন্য আমার প্রথম শ্লোকটা বাঙলায় তর্জমা করে দিই। তোমার বুঝতে সুবিধে হবে।
“অসতর্ক মিথুনরত প্রেমিকবরের প্রাণটি চুরি করে
অয়ি আর্য, তুমি শান্তি পাবে না অনন্তকাল ধরে”
আহা, সুন্দর, অদ্ভুত। দাদা আপনার দেখা পাব ভাবি নি। এ যে আমার পরম সৌভাগ্য। বেড়ে লিখেছেন কাব্যখানা। আমি পড়েছি। একদম খাস্তা মুচমুচে। কিন্তু আপনি তো দাদা এ জামানার নন? দাদা, ও দাদা, নখ খুঁটছেন কেন? বলছি আপনি তো অনেক আগেকার মানুষ?
অ্যাঁ, কি বলছ? ও আমি? হ্যাঁ, সে অনেক কাল আগে। নয় নয় করেও হাজার তিনেক বছর হবে। তবে কিনা আমি যোগবলে ত্রিকাল, ত্রিলোকের যেকোন জায়াগায় যেতে পারি। তুমিও তো দেখছি বাপু এ জামানার নও। হাজার দুয়েক বছর পরের মানুষ। তুমি এলে কি করে এখানে?
হ্যাঁ, আমি ভানু সিংহ। বিংশ শতাব্দি। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?
এই যে নখে আমার একটা আয়না আছে – নখ দর্পণ। আসলে আমি নখ খুঁটছিলাম না। তোমার পরিচয়টা একটু দেখে নিচ্ছিলাম। তুমি এলে কি করে এখানে? তুমিও যোগ টোগ করো নাকি।
আমি টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছি। এখন থেকে হাজার তিনেক বছর পর মানুষ সেই কৌশলটি আয়ত্ত করে ফেলেছে।
কিন্তু তোমায় যেন দেখলাম হাজার দুয়েক বছর পরে এসেছ। নাকি ভুল দেখলাম। অনেকদিন নখটা পরিষ্কার করা হয় না। কি দেখতে কি দেখলাম?
না না দাদা, আপনি ঠিকই দেখেছেন। আপনার নখ একদম নির্ভুল। আসলে একটু ঘুর পথ নিতে হয়েছে। মহাকবির সাথে দেখা করতে হাজার খানেক বছর ভবিষ্যতে গিয়ে ওই টাইম ট্র্যাভেল টেকনোলজি ব্যাবহার করে তবে আসতে পারা।

বেশ বেশ। তুমি তো দেখছি বেশ বিখ্যাত। অনেক পুরস্কার টুরস্কার-ও পেয়েছ। এই পুরস্কারটা নিয়ে খুব হইচই দেখছি। নোবেল না কি?

না দাদা, আপনার কাছে আমি কিসসু না। হাতির কাছে পিঁপড়ে। নোবেল হল আমাদের জামানার সেরা পুরস্কার। প্রথমে তো আমার লেখা কেউ পড়ত না। পরে যবন ভাষায় অনুবাদ করে ওই পুরস্কারটা পেয়ে গেলাম। তখন দেশের লোকেরা আমায় মাথায় তুলে নাচানাচি করতে লাগল। বাঙালি বিশ্ববিধাতার এক আশ্চর্যতম সৃষ্টি। বুঝলেন না। ভাল করেছেন আপনি বাংলায় লেখেন নি। নোবেল না পেলে আপনাকেও কেউ পুঁছত না বাঙলায়।
বটে। কিন্তু তুমি বাপু তোমার ওই নোবেলটি একটু সামলে রেখো, মানে তোমার সাগরেদদের সামলে রাখতে বোলো। আমার নখদর্পণ বলছে ওটা কোন উর্বর মস্তিষ্ক বাঙালি পরবর্তী কালে ঝেঁপে দেবে। তবে সে ঘটনাটি বোধ হয় তোমার জীবনসীমার বাইরে। যাকগে যাক। তা তোমার লেখা দু একটা পাঠিও। পড়ব। কটা লেখা বেরিয়েছে এখনও অব্দি?
আজ্ঞে সে বললে আপনি খুব রাগ করবেন। অনেক লিখে ফেলেছি। আসলে কি করব? কিছুই করার থাকে না যে। জমিদারি টমিদারি আমার দ্বারা হয় না। ও সব দাদারাই সামলায়। সকলের ছোট ভাই। তাই সাত খুব মাপ। তা লিখেছি বলতে, এই ধরুন এক ডজন উপন্যাস, বেশ কিছু ছোট গল্প, হাজার তিনেক গান, ডজন দুয়েক কাব্য গ্রন্থ, কিছু প্রহসন, গীতিনাট্য, নাট্যকবিতা…
থামো, থামো, থামো। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে ভাই। যাকগে যাক। অন্য কথা বলি। একটা কথা কি জানো, লেখক যদি তারিফ পাওয়ার জন্য লেখে সে লেখার ষোল আনাই ফাঁকি। নিজের খুশিতে নিজের মনের কথাটি লেখার জন্য পেন ধরলে তবেই ওই কি যেন বললে “রসোত্তীর্ণ লেখা” বেরোয়। তোমার কি মত এ ব্যাপারে?
হ্যাঁ দাদা। একদম একমত। আমি তো সম্পূর্ণ নিজের খুশিতে লিখি। সব যে ছাপাই তাও নয়।
বেশ, বেশ। যাক কথা বলতে বলতে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। ওই যে সূর্যতোরণ দেখা যায় ওইটে উজ্জয়িনী। তা নখ দর্পণে তোমার যে ছবি দেখলাম তাতে যেন তোমার আমার মতই বড় বড় দাড়ি দেখলাম। তুমি তো দেখছি রীতিমত ক্লীন শেভড। এমনটা কেন দেখলাম, তাই ভাবছি?
দাড়ি, দাড়ি তো আমি রাখি না বড়দা। আপনি কি অন্য কারু ছবি…?
—–
রবি, রবি, ওঠ। আর কতখন ঘুমুবি? কটা বাজে জানিস? আমাদের বজরার ডেকে গিয়ে দেখ, কেমন বৃষ্টি পড়ছে। আজ মেঘনা পেখম তোলা ময়ূরের মতই সুন্দর।
“এ হে, এতো দেরি হয়ে গেলো? আসলে কাল একটু রাত করে লিখছিলাম।” রবি উঠে কয়েক দিনের না-কাটা দাড়িতে হাত বোলায়। পাশে খোলা তার খেরো খাতা। তার পরের কাব্যগ্রন্থ মানসীর গুটি কতক কবিতা তাতে লেখা। কাল আষাঢ় মাসের পয়লা তারিখে মেঘনা বক্ষে ঝুম বৃষ্টি দেখতে দেখতে খুব মনে পড়ছিল তার প্রিয় লেখক মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্য মেঘদুতের সেই বিখ্যাত লাইন “আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানু…”
তাই কবি কালিদাসের সম্মানেই চার লাইন লিখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
কবিবর, কবে কোন্‌ বিস্মৃত বরষে
কোন্‌ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
পেনটা তুলে নিয়ে পরের চারটে লাইন লিখতে গিয়ে হঠাৎ গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ে থমকে গেলো রবি।
স্বপ্নে মহাকবি বাল্মিকী বললেন যেন আমার বড় বড় দাড়ি দেখেছেন। দাড়িটা রেখেই দেখব নাকি? অত বড় একজন কবি বলেছেন যখন সে কথা আদেশ বই তো নয়। তায় আবার ভদ্রলোক ত্রিকালদ্রষ্টা। ঠিকই দেখেছেন নিশ্চয়ই। এ আদেশ শিরোধার্য। এখন থেকে দাড়িটা শিরে ধারণ করেই দেখি কেমন লাগে আমাকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।