“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় সঞ্জীবন হাটী
একান্ত আপন
শেষ বিকেলের বৈশাখী আকাশ। সূর্য ডোবা লালের ওপর দিয়ে দল বেঁধে উড়ে যাচ্ছে বৃষ্টি জমানো কালো মেঘের দল। ছাদে বসে আছি। হেডফোনে বাজছে রবীন্দ্রনাথ। জয়তী গাইছেন, ‘হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর, এ জীবনে যা কিছু সুন্দর, সকলই আজ বেজে উঠুক সুরে, প্রভু তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে’। প্রতিটা শব্দ কানের পর্দা ভেদ করে কোন অভ্যন্তরে হৃদয়ের গভীরে গিয়ে স্পর্শ করছে আমায়। ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে দেখছি একটা একটা করে মেঘগুলো দ্রুত সড়ে যাচ্ছে। তাদের ফাঁক দিয়ে দেখা দিচ্ছেন চন্দ্রদেব। আমার যেন মনে হচ্ছে আমি মাঝ সমুদ্রে, কোনো সীমানা নেই চারদিকে, এই মহাকাশ, মেঘ, কালবৈশাখীর হাওয়ার সাথে মিশে কি যেন এক অন্তহীন সত্যিকে অনুভব করছি আমি! চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমার গুরুদেবের আশ্রমে সান্ধ্যপুজো হচ্ছে, আশ্রমিকরা ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ধ্যানাগারের দিকে, সেখানে কোনো অহেতুক তাড়াহুড়ো নেই, অথচ কোনো অনিয়মও নেই। এ তো আমার দর্শন, আমার ঈশ্বরবোধ! আমার একান্ত আপন অনুভূতি। এই বোধ তো আমি কারুর সঙ্গে ভাগ করে নিইনি। কিন্তু তবুও ঐ গানের প্রতিটা কথা আমার সেই গহন একান্ত অনুভূতিকেই ব্যক্ত করছে। যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার কোনো কায়িক সম্পর্কই হয়নি কোনোদিন, তারই লেখার ছত্রে ছত্রে মিলে যাচ্ছে আমার অধ্যাত্মবোধ। আর এটাই আমার রবীন্দ্রনাথ, আমার সবচেয়ে বড়ো আশ্রয়, অনুপ্রেরণা, ঘনিষ্ঠতম সখা।
আমার মনে পড়ে ২০১৪-র ১৯-এ জানুয়ারির কথা। ঠাকুমা’র মৃত্যুদিন। নিষ্প্রাণ সেই দেহ দেখতে চাইনি বলে নিজেকে আটকে রেখেছিলাম দোতলার একদম পশ্চিমের ঘরটায়। সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ, পাছে কেউ এসে ডেকে নিয়ে যায় আমায়! নীচে আস্তে আস্তে ভীড় বাড়ছে, লোক আসছে, কান্নার শব্দ, সব শুনতে পাচ্ছি ঘরের ভেতর থেকে। একসময় নার্সিং হোম থেকে ঠাকুমাকে নিয়ে আসা হলো। নীচে উঠোনের ওপর শোয়ানো। জনৈক বৃদ্ধ চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। আমি দুহাতে কান চেপে ধরলাম আমার। পাশেই রাখা নোকেয়ার ফোনটায় গান চালিয়ে দিলাম, হেডফোন দিয়ে। অরুন্ধতী হোম চৌধুরী। ‘আমার রাত পোহালো, শারদপ্রাতে’। যদিও তখন এখানে মাঘমাস, ভরা শীতকাল। তবুও আমি দেখছিলাম, ছাদের ওপর আমি আর ঠাকুমা হাঁটছি, ঠিক আগে বিকেলে যেমন হাঁটতাম, গাছে জল দিচ্ছি আগের মতন। ‘সময় যে তার হলো গত, নিশীথ শেষে তারার মত’। এই প্রথম আমি সজ্ঞানে কোনো প্রিয়জন বিয়োগের নির্মম যন্ত্রণা অনুভব করলাম। ধীরে ধীরে সেই শোকের সাথে ভাগ করে থাকতে শিখলাম। ঠাকুমার সেই রোগক্লিষ্ট শেষশয্যা আমি দেখিনি। আমার মনে ঠাকুমার সেই আগের সদাহাস্যময়ী, স্নেহশীল, মিত্রসম প্রতিচ্ছবিটাই অমর হয়ে থাকলো। আর এই প্রথম আমি রবীন্দ্রনাথকে আরও বেশী করে আবিস্কার করলাম, আমার সবচেয়ে বেশী দুর্বলতার ওপর ছায়া দেওয়া এক বিশাল বটগাছের মতন।
তখন একদম ছোট্ট। ক্লাস ওয়ান-টু হবে। পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে প্রতি বছর ইটিভি বাংলায় একটা করে নৃত্যনাট্য হত। মুখ্য ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। আমার প্রথম চন্ডালিকা, শ্যামা, মায়ার খেলার গল্পগুলো ওগুলোর থেকেই জানা। কোনো এক বছর দেখেছিলাম চিত্রাঙ্গদা। পুরুষালি কুরূপার চেয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বেশী ভালো লেগেছিলো লাস্যময়ী সুরূপাকে। তখন কিছুই বুঝিনি। অনেক পরে, যখন চিত্রাঙ্গদা পড়লাম, আস্তে আস্তে প্রবেশ করলাম বয়ঃসন্ধিতে, তারও পরে স্কুল-কলেজে, কাজের জগতে, তখন উপলব্ধি করলাম কীরকম ধীরে ধীরে আমাদের পছন্দ অপছন্দের মাঝের মোটা বিভেদ রেখাটা মুছে যেতে লাগলো। সমস্তটাই আপেক্ষিক বলে বোধ হলো। তারও পরে মহাভারত পড়লাম। ঋতুপর্ণ বানালেন ‘চিত্রাঙ্গদা, দ্য ক্রাউনিং উইশ’। বুঝলাম, আজকের তথাকথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলে ‘মেট্রোসেক্সুয়াল’ বলতে যা বোঝায়, আজ থেকে একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ সেটাই বলে গেছেন চিত্রাঙ্গদার মধ্যে দিয়ে। আর তারও বহু যুগ আগে মহাভারত বলে গেছে সেই একই কথা। এ তো আমাদের নিজেদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি ঔদাসিন্য যে আমরা এতো সহস্র বছর পরে সেই সত্যের সন্ধান পাচ্ছি মাত্র, স্বীকার করা তো দূরের কথা!
রবীন্দ্রনাথ তো কেবল সাহিত্যিক বা কবি বা চিত্রকর বা অভিনেতা নন, আমার রবীন্দ্রনাথ এক অনন্ত সত্ত্বা, যার কোনো সীমানা নেই। সেই যে কোন ছোটবেলায় নন্দলাল বসুর আঁকা সাদা-কালো ছবি দেওয়া বইয়ের ‘ছোটো খোকা বলে অ আ’ দিয়ে শুরু করেছিলাম, তারপর প্রাইমারি স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ থেকে ‘বীরপুরুষ’, প্রতিবছর কবিপ্রণামের আগে সঞ্চয়িতাটা নিয়ে নতুন করে বসা, তারপর যখন আরেকটু বয়স হলো, অভিধানে যুক্ত হলো ‘পাকামো’ শব্দটা, তখন লুকিয়ে লুকিয়ে ‘চোখের বালি’ পড়া, মনের মধ্যে ভয়, পাছে ধরা পড়ে যাই। তারপর আরও সময় গেলো, স্কুল শেষের দিকে, পড়াশোনার চাপে বেঁচে থাকা দায়। দেখতে দেখতে স্কুল ফুরিয়ে গেলো। এরকমই কোনো এক বৈশাখের বিকেলে বৃষ্টিধোয়া আকাশের নীচে বসে একসঙ্গে গেয়েছিলাম ‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে, ছুটেছে মন, ছুটেছে মন, মাটির টানে’। তারপর কলেজ, হস্টেল। আস্তে আস্তে পরিচিত হলাম একটা নতুন শব্দের সাথে। ডিপ্রেশন। বড়ো অদ্ভুত এক অনুভূতি। এই অনুভুতিতে কান্না পায়, কিন্তু চোখে জল আসেনা। চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, গলা দিয়ে আওয়াজ আসেনা। মনে হয় কেউ যেন আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে প্রাণপণে চেপে ধরেছে ভেতর থেকে। তার সঙ্গে লড়াই। মনে পড়ে, কত রাতে খাবার পরে ছাদের ওপরে গিয়ে চুপ করে বসে থেকেছি। শুধু রবীন্দ্রনাথ বেজে গেছে। সামনেই এয়ারপোর্ট। কত বিমান উড়ে গেছে, এসে নেমেছে! চেতনে, অবচেতনে কেঁদেছি অজস্রবার। রাগ, অভিমান এসব নিয়ে থাকতে থাকতে একসময় তারাও চলে গেছে। নিজের অজান্তেই বড়ো হয়ে গেছি অনেকটা। স্বপ্নের রঙিন জগৎটার পাশে হাত ধরে দাঁড়িয়েছে বাস্তব। বারবার পড়েছি লেডি গাগার একটা কথা, ‘ইফ ইউ হ্যাভ আ ড্রিম, ফাইট ফর ইট’। প্রতিবার মাথার পেছনে শুনতে পেয়েছি, কেউ একজন বলছে, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’।
যত দিন যায়, তত যেন মনে হয়, জীবনটা অনেক বেশী লড়াইয়ের। সমাজের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে, নিজের চিন্তার সঙ্গে, মননের সঙ্গে। তবুও সব কিছুর পাশেই আনন্দটাও বর্তমান। ঠিক যেমন ‘পারমিতার একদিন’-এ সবকিছুর শেষেও নতুন করে একটা প্রাণের উদ্ভাবন হয়, আবহে বাজে ‘আলোকে উজ্জ্বল জীবনে চঞ্চল, একি আনন্দ তরঙ্গ’। বিপুল তরঙ্গ রে’, তেমনই আমাদের রোজকার জীবনের হাজার ওঠা-পড়ার পেছনেও একটা সুবিশাল আলোর উৎস থাকে, আশা থাকে, এবং সেই আশাটাই একাধারে রবীন্দ্রনাথ। আমার মিলনে-বিচ্ছেদে, আনন্দ-বেদনায় আমি যখন গুরুদেবের ছবিটা সামনে দেখি, মনে মনে চেষ্টা করি নিজেকে স্থির করার, তখনই এক অনন্য স্নেহে, আদরে, শান্তিতে আমায় আশ্রয় দেয় তাঁর গান। সেখানে বারবার আমার জীবনবোধ, দর্শন, ঈশ্বর মিলেমিশে যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া সেই জীবন শূন্য, নিতান্ত বস্তুকেন্দ্রিক এক অভ্যাস মাত্র, মহাবিশ্বের অন্তহীন প্রাণশক্তির সেখানে কোনো অস্তিত্বই নেই।
জন্মতিথিতে কবিগুরুকে আমার বিনম্র প্রণাম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা।
তাঁর আশ্রয়েই আমরা আরও সমৃদ্ধ হই, সম্পৃক্ত হই, এই প্রার্থনা করি।