• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় অনিন্দিতা সেন

ভানুসিংহের অন্য রাধা

প্রথম পর্ব

“সজনী সজনী রাধিকা লো দেখ্ অবহুঁ চাহিয়া…মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে…মৃদুল গান গাহিয়া…. ” শুক্রবার বিকেলের নাচের ক্লাস। সুমথ পল্লীর ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবের হলঘরের পাথরের মেঝেতে ঘুরে ঘুরে নাচছে মেয়েরা,আর তার সাথে ভাবে বিভোর নৃত্যশিল্পী শ্রীধর, ওর কাছেই তালিম নেয় সবাই। এই টেন ইলেভেনের মেয়েদের প্রাজ্ঞতা তেমন থাকেনা।গুরুজীর দেখানো আংগিকের সাথে ওরা তাল মেলাচ্ছে মাত্র। প্রাণের উচ্ছলতা নেই।বড় কষ্ট হয় শ্রীধরের।
-এই দেখুন স্যার নাচতে নাচতে মুনিয়া কেমন লেংগি মারছে আমায়!
– অ্যাই অ্যাই আমি একাই মারলাম, আর তুই বুঝি ধোয়া তুলসী?
– অ্যাই তোরা চুপ কর না—– এরকম করিস না প্লি—–জ!
মেয়েলি গলায় কাতর অনুনয় প্রায় তলানিতে! হাসির হুল্লোড় উঠল একটা।
– ইসসসস তোরা যে করিস না…..! ভাল্লাগেনা দূউউউর!
সত্যিইই শ্রীধরের কিছুই ভাল লাগেনা আজকাল। পুরুষের শরীর আর নারীর মন নিয়ে বেঁচে থাকা…. এ যেন অন্য রাধা… চায় প্রাণের পুরুষ কে। বছর ঘুরে যায়, অপরূপা প্রকৃতিও বরণ করে বসন্ত কে। ” বসন্ত আওল রে…মধুকর গুনগুন… অমূয়া মঞ্জরি… কানন ছাওল রে, মরমে বহই বসন্ত সমীরণ…মরমে ফুটই ফুল, মরম কুঞ্জপর বোলই কুহুকুহু….অহরহ কোকিল কুল”।

দ্বিতীয় পর্ব

এমন কেন হয় তার? এ বিরহ, এ মর্মবেদনা, কাউকে কি বলা যায়? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! মনে হয় ছুটে গিয়ে মেয়েগুলোকে বলে….” ওরে.. আমি যে তোদেরই একজন”।
শেষ হল ক্লাস, কেউ কেউ বয়ফ্রেন্ড নিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়। শ্রীধরের বুক ফেটে কান্না আসে।
“সখি হম….. মোহন অভিসারে যাঁউ, বোলো হম… এতেক সুখ কঁহা পাঁউ!”
সামনেই ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠান। ফরমায়েশ অনুযায়ী তৈরী হচ্ছে নৃত্যনাটিকা- ভানুসিংহের পদাবলি।
শুরু হল রিহার্সাল।
“গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে… মৃদুল মধুর বংশী বাজে…বিসরি ত্রাস লোক লাজ…. সজনী, আও আও লো…।ঘুরে ঘুরে নাচছে সখিরা, মাঝে রাধা রূপী শ্রীধর।
‘প্রতি অংগ লাগি কাঁদি প্রতি অংগ মোর’…. কৃষ্নের প্রতি রাধার এই প্রেম নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে এ তল্লাটে বোধ হয় তার মত কেউই পারেনা। বড় বড় কাজল টানা চোখ, ফর্সা দোহারা শ্রীধর বড্ড মেয়েলি।
এহেন অন্য রাধার মনের মানুষ ছিল শ্রীকান্ত। একবার পুরুলিয়ায় জংগল মহলের বসন্ত উৎসবে গিয়ে ছৌ নাচের দলের সাথে পেয়েছিল ওকে। সুপুরুষ শ্রীকান্তের কষ্টিপাথরে খোদাই বলিষ্ঠ চেহারা, আর অপূর্ব বাঁশী বাজানোর দক্ষতা, মুহুর্তে আকৃষ্ট হল শ্রীধর। মন প্রাণ যেন সব দিয়ে বসল….
” বজাও রে…. মোহন বাঁশি। সারা দিবসক…বিরহ দহন দুখ…..মরমক তিয়াষ পাশি। রিঝ মন ভেদন….বাঁশরি বাদন…. কঁহা শিখলি রে কান!
সত্যিই এমন বাঁশির সুর, প্রাণ ঢালা আবেদনে আকুল হল রাধা। এদিকে ঘোষালদের পুকুরঘাটে নির্জন কোনে ঝাঁকড়া বাবুল গাছের তলায় নিবিষ্ট মনে বাঁশি বাজিয়ে চলে শ্রীধরের ঐকান্তিক ভালবাসা। সন্ধ্যে ঘনায়, প্রথম বরষার জলদ গম্ভীর মেঘ….ধুসর প্রলেপে বনাঞ্চল ঢেকে দেয়।
“বাহ মনোরথ সাচো অভিসারে পেহেলু সুনীল বেশ,
কাজরা নয়ানে সগজে বয়ানে কুসুমে সাজানো কেশ,
সখি হম… মোহন অভিসারে যাঁউ
বোলো হম…. এতেক সুখ কঁহা পাঁউ!
গভীর হাওয়ার তারা না ফোটা রাত… টেনে নিয়ে যায় কুঞ্জ পথে।
” আজু সখি মুহু মুহু গাহে পিক কুহু কুহু…. কুঞ্জ পথে দুঁহু দুঁহু দোঁহারো পানে চায়!
মলয় মৃদু কলয়িছে, চরণ নহি চলয়িছে, বচন মুহু খলয়িছে,অঞ্চল লুটায়ে…..।
সহসা বিদ্যুতের চকিত আলোয়….এ কি!তার প্রিয় পুরুষটির কন্ঠ লগ্না… এ কোন চন্দ্রাবলি? দুলে উঠল মাটি, ধুলিস্যাৎ হল স্বপ্ন। শ্রীকান্ত যে তার কালা! এতখানি উপেক্ষা!
” হৃদয়ক সাথ মিশাওল হৃদয়ে, কন্ঠে শুখাওল মালা….,বিরহ বিষে দহি বহি গল রয়নী, নহি নহি আওল কালা…..!
আর পারল না শ্রীধর, ঢলে পড়ল মাটিতে। সে যে নারী, পুরুষ নয়….।
সমাজের বৃহন্নলারা, ভালবাসে পুরুষ কে,অর্দ্ধ নারীর বিড়ম্বিত জীবনে অনভ্যস্ত আশ্বাস… যায় মিলিয়ে ধীরেধীরে…. মরীচিকার মত… পাথর চাপা দীর্ঘশ্বাস বয়ে নিয়ে।
সখি হম….কবহু না অভিসারে যাঁউ
দুখ লাজ…. এতেত…. সেহ নাহি পাঁউ।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *