রবীন্দ্রনাথ নামটা শুনলেই আপমর বাঙালীর হৃদয়ে একটা শীতল হাওয়া বয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ একটা সংস্কৃতির নাম। রবীন্দ্রনাথ একটা অব্যক্ত অনুভূতির নাম। তাই রবীন্দ্রজয়ন্তী মানে বাঙালীর কাছে একটা অন্যরকম দিন। অন্যরকম দিন বলা ভুল হবে, বলতে হবে অন্যরকম দিন ছিল।
বাঙালীর সংস্কৃতি বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে জীবনের রূপরেখা। ক্রমশ কর্পোরেট কালচারে আচ্ছন্ন বাঙালী ডুবে যাচ্ছে বিনোদনের উপকরণে। ভুলে যাচ্ছে চিন্তা করতে, মন ও মননকে সে ক্রমশ বন্ধক দিচ্ছে জৌলুসের কাছে। অন্যদেশের, অন্যভাষার সংস্কৃতি সুপারসোনিক বেগে গিলছে বাঙালীর স্বকীয়তা। পোষাক-আশাক থেকে খাদ্যাভ্যাস সর্বত্র বহিরাগত সংস্কৃতির থাবা। এতকিছু বদলের মাঝে অনেকখানিই হয়তো বদলে গেছে বাঙালীর রবীন্দ্রনাথ।
আজও সারা বিশ্ব যে মানুষটার নামে বাংলার সাহিত্যকে চেনে, সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে; সেই মানুষটার সৃষ্টি, দর্শন, আদর্শ নিয়ে ইদানিংকালে বাঙালীর খুব বেশি মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বরং এটা নিয়ে বেশি মাথাব্যথা মে-তে নতুন কোন স্মার্ট ফোন লঞ্চ করছে। কোন হিরোইনের বিয়ে হতে হতে হল না। জলের দাম না বেড়ে মদের দাম কেন বাড়লো ইত্যাদি ইত্যাদি।
একসময় রবীন্দ্রজয়ন্তী ছিল বাঙালীর কাছে এমন একটা বিশেষ দিন, যা আর পাঁচটা আত্মশুদ্ধির উৎসবের চেয়ে কম কিছু না। বাড়িতে রবিঠাকুরের ছবিতে পড়তো রজনীগন্ধার মালা। ছড়িয়ে পড়তো রবির সুবাস। বাঙালী পরিবাগুলোর কাছে যেন এই দিন ছিল এক অনন্য উৎসবের দিন। নিজের সংস্কৃতিতে ছুঁয়ে দেখার দিন। সঞ্চয়িতা খুলে শিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন বাঙালীর কয়েক সমুদ্র রবীন্দ্রনাথে ডুবে যাওয়ার দিন। আকাশে বাতাসে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখরিত হবার দিন। এইদিন পাড়ায় পাড়ায় পাঞ্জাবী আর শাড়ির মলাটে ছেয়ে যেত বাঙালীর বাঙালীয়ানা। রবীন্দ্রনাথ যে বাংলার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য আত্মা তা এই দিন আসলে আরও বেশি করে বোঝা যেত।
কিন্তু এখন বাঙালীর কাছে নববর্ষ বা রবীন্দ্রজয়ন্তীর থেকে অনেক বেশি উদযাপনের দিন থার্টি ফাস্ট নাইট। যে রবীন্দ্রনাথের গানে বুঁদ হয়ে থাকতো বাঙালী এখন তাঁর জন্মজয়ন্তী কারোর কাছে নিছকই ছুটির দিন, কারোর কাছে উগ্র উদযাপনের দিন আবার কারোর কাছে নিতান্ত সাধারণ আর পাঁচটা দিনের মতোই। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের আড়ম্বর কমে গেছে একথা না বলে বলা ভালো রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী পালনের খোলনোলচে বদলেছে। আগে যেমন পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের ধুম ছিল এখন অতটা নেই। ছোট ছোট ক্লাবগুলোর বা ছোট ছোট সংগঠনগুলোর বোধ হয় রবি ঠাকুরকে মনে করা প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আগে দেখা যেত যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করছে। এমনও দেখা যেত কোথাও একটা ছোট্ট মঞ্চ বা কোথাও একটা ছোট্ট ঘরে রবীন্দ্র আবহে কলুষমুক্ত হচ্ছে বাঙালী। নিদেনপক্ষে বাবা আর মেয়ে বসে রবীন্দ্রগানে মুখরিত করছে বাড়ি। কিন্তু তা আজ প্রায় ইতিহাস।
এখনও বহু জায়গাতেই পালন করা হয় রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী। তবে তা কখনই রবীন্দ্রচর্চা বা রবীন্দ্র আবহে আত্মশুদ্ধির জন্য নয়। কিছুটা লোক দেখানোর জন্য, আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য, আর কিছু কিছু জায়গায় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের গানে বা কবিতায় ডুবে যাওয়ার পরিবর্তে এই প্রজন্ম বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ফেসবুক ওয়ালে নিপাট বাঙালী সেজে রবি ঠাকুরের ছবির সাথে একটা ফটো পোস্ট করে লিখতে ‘সেলিব্রেটিং রবীন্দ্রজয়ন্তী’।
এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী মানুষটা যে কত বড় জীবনদর্শনের আধার তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না এই প্রজন্মের। তবে বাঘেদের রাজ্যেও যেমন সাদা বাঘ থাকে, তেমনই কিছু বাঙালীর মননে আজও রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজ আসনে অসীন আছেন। তারা আজও রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় বিভোর হয়ে থাকেন। তবে সে সংখ্যা অনেক কম।
মাঝে মাঝে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ যদি নোবেল না পেতেন তাহলে হয়তো বাঙালীর তাকে নিয়ে যতটুকু মাথাব্যথা আছে সেটুকুও থাকতো না। এখনও বহু বাঙালী নিজেদের বাঙালীয়ানা দেখাতে বলেন রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাংলায় জন্মেছেন, আমরা বাঙালীরা তাকে নিয়ে গর্ব করি। তাদের বেশিরভাগই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অতলে কেন, এক ফোঁটা রবীন্দ্রনাথেও ডুব দেননি কোনদিন। তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ শুধু একটা মেকি আত্মগৌরবের বিষয় ছাড়া কিছু নয়?
এই প্রজন্মের একটা বড় অংশের বাঙালীর কাছে রবীন্দ্রনাথ খানিকটা ব্রহ্মা, বিষ্ণু গোছের একটা ঈশ্বরে পর্যবসিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন পরিনত হয়েছে আত্মশুদ্ধি নয় বিনোদনের উপকরনে। আর রবীন্দ্রনাথ সীমাবদ্ধ হচ্ছেন ক্রমাগত মনন থেকে পাঠ্যপুস্তকে।
অত বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্ব, তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পার হতে না হতেই তিনি ফিকে হতে শুরু করলেন? নাকি ফিকে হতে শুরু হল বাঙালীর নিজস্বতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি? প্রশ্নচিনহ থেকেই যায়।