• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় অর্ঘ্য রায় চৌধুরী

আমার রবীন্দ্রনাথ

যখন একদম ছোট, সহজপাঠের বয়েস, তখন হঠাৎ একদিন কয়েকটা লাইন মনে হল হাতছানি দিয়ে ঘরছাড়া হওয়ার ডাক দিয়ে গেলো, “কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি/ বোঝাই করা কলসী হাঁড়ি/ হাট বসেছে শুক্রবারে/ বংশীগঞ্জে পদ্মাপাড়ে/ গাড়ি চালায় বংশীবদন/ সঙ্গে যে যায় ভাগনে মদন।”
সঙ্গে কবির একটা ছবি, খুব পছন্দ হয়েছিলো, বেশ গল্প দাদুর মতো দেখতে, একমুখ দাড়ি গোঁফ।জানতে পারলাম ওই কবির নাম রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু ততক্ষণে আমি বাড়িতে ঘোষণা করে দিয়েছি পদ্মাপাড়ের ওই বংশীগঞ্জের হাটে আমি যাবোই।যে কোনদিন বেড়িয়ে পড়তে পারি। যাওয়া হয়নি।
তারপর বিভিন্ন সময় সমস্ত জীবন জুড়ে ওই কবি সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন। আরও বড় হলাম, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এবার শুধু কবিতাই না, গল্পও পেলাম।আর লক্ষ্য করলাম, এ যেন ঠিক আমার জন্যই লেখা হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে আমার ভেতরে ঢুকতে থাকলেন।
তারপর একসময় দেবব্রত বিশ্বাসের ওই গায়কী, রবীন্দ্রনাথের গান, তার কথা, সুর, ভাব সমস্তটা সমেত আমাকে বলে গেল এই কবিকে ছাড়া যাপনের কোথাও যেন ফাঁক থেকে যায়, একে না জানলে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়া অর্থহীন।
ততদিনে আমি পুরনো কলকাতা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছি।বঙ্গীয় রেনেসাঁর প্রবল অভিঘাত আমাকে প্রায়ই নিয়ে গিয়ে হাজির করে জোড়াসাঁকোর সেই বাড়িতে, যেখানে এক অনিন্দ্যকান্তি যুবক কবি একের পর এক লিখে চলেছেন এমন কিছু লেখা, যা পড়ার পর মনে হয় সমস্ত ঋতুগুচ্ছ স্পর্শ করে আছে আমাকে।সুনিবিড় মেঘদল ঘন হয়ে আসে,
বেজে ওঠে “ঘনঘন রিমঝিম রিমঝিম বরখত নিরদপুঞ্জ।” এক অসামান্য বীরের সামনে এক অপরূপা রাজকন্যা এসে আনত চোখে দাঁড়ায়, বলে ওঠে “জনম জনম গেল বিরহ শোকে/ বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে।”
আমি পড়তে বসে দেখি পদ্মাপার, শিলাইদহের সেই নদী ও প্রান্তরে ভেসে চলেছে রবিবাবুর বজরা, আর কালো মতো এক মেয়ে, তার কালো হরিন চোখে ভূজঙ্গপ্রয়াত ছন্দে সেই নদী ও প্রান্তর থেকে আমাকে ডাকে।ভেতর থেকে সাড়া ওঠে আসছিইইই।
আসলে রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে ভূমিকার ঘনঘটা থাকেনি কখনো।‌ উনি যেন সে লেখা আমার জন্যই লিখেছেন, এ কথা সেই ছোটোর থেকেই মনে হয়েছে, আর সে মনে হওয়ার মধ্যে কোনো আড়াল নেই, কোনো আরোপিত কোনো ব্যাপার। কারন উনি যখন লেখেন “বিশ্ব যেন চিত্রপট, আমি যেন আঁকা” তখন মনে হয় এ তো আমার কথাই। এত সহজভাবে আমার কথাটা আর কেউ বলতে পারেননি।
আসলে রবীন্দ্রনাথ শুধু একজন কবি নন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর স্বত্বার পরিচয়।
রবীন্দ্রনাথ যে সবটা পড়ে ফেলেছি সে কথা বলি না।কিন্তু যেটুকু পড়েছি, শুনেছি এবং তুলির টানে যেটুকু চোখে পড়েছে, তা আমার যাপনে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে, এবং এমন এক আনন্দময় পূর্ণতার পথে সে জেগে আছে যার কথা বলতে গেলে শেষ হওয়ার না।
আমার শৈশব বহুকাল হল অতিক্রান্ত।এখন আমার পাঁচ বছরের ভ্রাতুষ্পুত্রীর গলায় শুনি সেই পদ্মাপাড়ের ডাক।সেই বংশীগঞ্জের হাটের পথ, আমি ওর পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে ওকে কাছে ডাকি, বলি “তুমি রবীন্দ্রনাথকে চেনো?” ও আধো আধো স্বরে বলে ওঠে “না তো জেঠুমুনি, কোথায় থাকে?”
আমি অপেক্ষা করে থাকি, ওর ভেতরে যে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে পত্রপুষ্পপল্লবে মঞ্জরিত হয়ে উঠছে, সেই ঠিকানায় ওকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।